রবিবার, ১৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার প্রভাব মোকাবিলা ও মৎস্য সেক্টরের সম্ভাবনা

সাজ্জাদুল হাসান

করোনার প্রভাব মোকাবিলা ও মৎস্য সেক্টরের সম্ভাবনা

করোনা পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সংঘটিত সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক ও মানবিক বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক যুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল সীমিত কিন্তু করোনা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত করেছে বিশ্বের প্রায় সব কয়টি দেশ। বাংলাদেশকেও আজ করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এমন বিপর্যয় প্রতিটা মানুষের কাছে অকল্পনীয়। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মনোবল চাঙ্গা রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। বাংলাদেশ ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য জয়ের লড়াইয়ে নিয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১৪৬ জন মানুষ বাস করে। এ দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ কৃষি এবং শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জীবন-জীবিকা চারটি খুঁটির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো হলো-কৃষি, রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প, বিদেশে কর্মরত শ্রমিক এবং দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ। এটা স্বীকার করতে হবে করোনা পরিস্থিতির বৈশ্বিক বিপর্যয়ে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প এবং বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছি যে ক্ষতি আমাদের পুষিয়ে আনতেই হবে। কৃষি সেক্টর এক্ষেত্রে একটা অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এ দেশের কৃষি ব্যবস্থার এক ধরনের চিরাচরিত নিজস্বতা থাকলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এ ব্যবস্থা এখন এক আশাজাগানিয়া সমৃদ্ধির পর্যায় উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শিতায় বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে। শুধু ধান উৎপাদনে নয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনের সপ্তম, আলু উৎপাদনে অষ্টম এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও অনেক দূর এগিয়ে।

এই করোনা সংকটেও বোরো ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়নে কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। আজকে যদি বোরো ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হতো তাহলে হয়তোবা ঘরে ঘরে হাহাকার লেগে যেত। যাক আজ আমি কৃষির একটি অন্যতম সেক্টর মৎস্য সম্পদের বিষয়গুলো নিয়ে আমার ভাবনার অবতারণা করতে চাই।

মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদটির সঙ্গে আমরা আদিকাল থেকেই পরিচিত। বাঙালি জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে মাছ আর মাছ। মাছ আমাদের বাঙালির জন্য সুস্বাস্থ্যের ভান্ডার ও প্রজনন শক্তির প্রতীক।

আমি সংক্ষেপে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ১০ বছরের শাসনকালে মৎস্য সেক্টরে যে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করব। অতঃপর করোনায় মৎস্য সেক্টরে কী প্রভাব পড়েছে তা বিশ্লেষণের ইচ্ছা রাখি। সবশেষে এই করোনা বিপর্যয়কে কাটিয়ে মৎস্য সেক্টরকে কীভাবে আরও বেগবান করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে সে ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে কৃষি সেক্টরেই অনন্য অবদান রাখবে বলে ধারণা করা যায়।

১. বিগত ১০ বছরে মৎস্য সেক্টরের অভাবনীয় সাফল্য : দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। প্রাণিজ আমিষের ৬০% আসে মাছ থেকে। তা ছাড়া দেশের ১৪ লাখ নারীসহ প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে। ইনস্টিটিউট থেকে ইতিমধ্যে মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ৬২টি লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ মৎস্য অধিদফতর এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ মেট্রিক টন। ২০০৮-০৯ সালে মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭.০১ লাখ মেট্রিক টন। উল্লেখ্য, ১৯৮৩-৮৪ সালে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল মাত্র ৭.৫৪ লাখ মেট্রিক টন। তাই ৩৫ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে পাঁচ গুণেরও বেশি। উৎপাদনের এই ক্রমধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা যায়, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মৎস্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪৫.৫২ লাখ মেট্রিক টন অর্জিত হবে। খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার এক তথ্য অনুযায়ী ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম যার পরিমাণ ৫.১৭ লাখ মেট্রিক টন। বিগত ১০ বছরে এর উৎপাদন বেড়েছে ৭৮ শতাংশ যা সরকারের এক অন্যতম সাফল্য। তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ এবং বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এটা জাতির জন্য গর্ব এবং অহংকারের বিষয়। দেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় গ্রামের সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে মাছও পাচ্ছে, পুষ্টিও পাচ্ছে। মিঠাপানির দেশীয় বিপন্ন প্রজাতির মাছের জিনপুল সংরক্ষণ এবং চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনে ইতিমধ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আইইউসিএন-এর তথ্য মতে, মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪টি প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্ত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ২২ প্রজাতির মাছের প্রজনন এবং চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে পাবদা, গুলশা, টেংরা, শিং, মাগুর অন্যতম। ফলে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রাপ্যতা সাম্প্রতিককালে বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্রয়মূল্যও সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে আছে। আমাদের মাছের উৎপাদন এর শতকরা ১৬ ভাগ অর্থাৎ ৬.৪ লাখ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছের অবদান। তবে এ কথা ঠিক সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা কাক্সিক্ষত উৎপাদন পাচ্ছি না। প্রচলিত মৎস্য প্রজাতির পাশাপাশি বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদ যেমন কুঁচিয়া, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, সিউইড ইত্যাদি সংরক্ষণ ও চাষাবাদ কৌশল উন্নয়নে বর্তমান সরকার বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

২. যাক করোনা পরিস্থিতি মৎস্য সেক্টরে কী প্রভাব ফেলছে তা জয় করে মৎস্য উৎপাদন আর কীভাবে বাড়ানো যায় তা জানার জন্য মৎস্যচাষি, ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করে জানার চেষ্টা করেছি। যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে মোটামুটি নিম্নরূপ : কভিড-১৯ এর কারণে মৎস্য খাতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রভাবে রয়েছে।

ইতিবাচক প্রভাব : ক : অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি : নদ-নদী, খাল-বিল নিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ হেক্টর। চলমান করোনা দুর্যোগকালীন মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ও পরিবহন বিপণন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় এবং মাছের বাজারমূল্য অপেক্ষাকৃত কম থাকায় উন্মুক্ত জলাশয় থেকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে মাছ আহরণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব জলাশয়ে চলতি প্রজনন মৌসুমে মাছের প্রজননের সুযোগ পেয়েছে। এতে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন এবং জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে।

(খ) জলাশয়ের পরিবেশ উন্নয়ন : করোনাকালীন জলাশয়ে মানুষের অবাধ হস্তক্ষেপ এবং জলাশয় নিকটবর্তী স্থানে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় এবার নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় এবং বিলের পানি অপেক্ষাকৃত কম দূষিত হয়। ফলে জলাশয়ে মাছের অবাধ বিচরণ এবং প্রজনন সুরক্ষিত হয়েছে এর সুফল ইতিমধ্যে হালদা নদীতে পাওয়া গেছে। দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়েও পরিবেশ উন্নয়নের কারণে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একইভাবে অপ্রচলিত মৎস্য সম্পদ ও কাঁকড়া অবাধে বিচরণ করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। জলাশয়ের জন্য এটি একটি ইতিবাচক দিক।

(গ) উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা : সুন্দরবন এলাকা হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও শামুক-ঝিনুকের প্রজনন ও নার্সারি গ্রাউন্ড। করোনার কারণে এ বছর মাছের প্রজনন ও নার্সারি গ্রাউন্ড সুরক্ষিত হওয়ায় উপকূলীয় মাছ ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদ অবাধে প্রজননের সুযোগ পেয়েছে। অপরদিকে শিলা কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক উৎস থেকে কাঁকড়ার পোনা আহরণ করে এর চাষাবাদ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

ফলে আগামী দিনে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক উৎসে চিংড়ি, কাঁকড়া ও মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নেতিবাচক প্রভাব : (ক) হ্যাচারিতে উৎপাদিত মাছের রেণু বিক্রি হ্রাস : দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ৯২৬টি হ্যাচারিতে বছরে প্রায় সাত লাখ কেজি মাছের রেণু উৎপন্ন করা হয়। হ্যাচারি থেকে রেণ বিক্রয়ের পর চাষের পুকুরে প্রতিপালনের মাধ্যমে উৎপাদিত অঙ্গুলি পোনা চাষাবাদে ব্যবহার করা হয়। গত মার্চ মাস থেকে দেশব্যাপী পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় দূর-দূরান্তের চাষি হ্যাচারি থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেণু সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রেণু বিক্রয় কম হয়েছে বলে হ্যাচারি মালিকরা জানিয়েছে। পরবর্তীতে সরকার কৃষিপণ্য পরিবহনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আদেশ জারি করায় তা অনেকাংশে সচল হয়েছে।

(খ) মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি হ্রাস : বিশ্বের অর্ধ শতাধিক দেশে বাংলাদেশ থেকে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়। এ খাত থেকে বছরে আয় হয় চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চিংড়ি অন্যতম। মূলত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে চিংড়ি রপ্তানি করা হয়। করোনার প্রভাবে এসব পণ্যের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

(গ) মৎস্য খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি ও উচ্চ খাদ্যমূল্য : দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ ও চিংড়ি চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রোটিনসমৃদ্ধ ফিশ মিল, ভিটামিন ইত্যাদি উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এসব উপকরণ সময়মতো ও পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করা সম্ভব হয়নি। ফলে মাছের খাদ্যমূল্য বেড়ে যায়। এতে চলতি বছর মাছের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে অপরদিকে দেশব্যাপী সাপ্লাই চেইন বিনষ্ট হওয়ায় চাষিরা মাছের ন্যায্যমূল্য প্রাথমিকভাবে পেতে কিছুটা হিমশিম খেয়েছে। পরবর্তীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয় এতে কিছু সুফল পাওয়া গেছে।

৩. মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিকে আরও বেগবান করায় করণীয় : মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের যেমন আত্মতৃপ্তির সুযোগ আছে ঠিক তেমনি সামনের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রাখা। তা করতে হলে চাষিদের মানসম্মত পোনা এবং খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। করোনার প্রভাবে মৎস্য সম্পদে যে ক্ষতিটুকু আমাদের হবে, তা পুষিয়ে উৎপাদন আরও বাড়াতে হলে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় যেমন-নদ-নদী, প্লাবন ভূমি, সুন্দরবন হাওর-বাঁওড়, কাপ্তাই লেক ইত্যাদি সব জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। আমাদের দেশে মোট প্লাবন ভূমির পরিমাণ ২৭ লাখ হেক্টর এবং বিলের পরিমাণ ১.১৪ লাখ হেক্টর। বর্তমানে প্লাবন ভূমিতে মাছের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ২৮৩ কেজি। বিলে হেক্টরপ্রতি ৮৬৯ কেজি। অনুরূপভাবে ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জলাশয় বিশিষ্ট কাপ্তাই থেকে বর্তমানে মাছের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১৪৮ কেজি। অথচ বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদের ফলে পুকুরে এখন মাছের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি চার হাজার ৮০০ কেজি। আমরা যদি দেশের ৩৯ লাখ হেক্টরের হাওর-বাঁওড়, বিল, প্লাবন ভূমিসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে পারি তখন মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ বর্তমানে ৫৮টি দেশে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করছে। মানসম্মত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যে পরীক্ষার জন্য মৎস্য পরিদফতরের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় আন্তর্জাতিক মানের তিনটি মান নিয়ন্ত্রণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে মৎস্য ও মৎস্য জাতীয় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, নদী-নালায় পলি জমে ভরাট হয়ে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন অবাধ বিচরণের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব জলাশয় সংস্কার খননের মাধ্যমে দেশীয় মাছের আবাসস্থল পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। সম্ভাবনাময় হাওরাঞ্চলের মৎস্যসম্পদ আজ ক্রমহ্রাসমান। যার অধিকাংশ মানব সৃষ্টির কারণে। উৎপাদন হ্রাসের প্রধান কারণগুলো হলো- বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের বাঁধ নির্মাণ, মাছের চলাচল পথে জালসহ নানা ধরনের ফাঁদ স্থাপন, নির্বিচারে ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, বিল জলমহাল ইজারা গ্রহীতাদের সব মাছ আহরণের প্রবণতা, ফসল উৎপাদনের জন্য শুষ্ক মৌসুমে বিল থেকে পানি সেচ দিয়ে জলাশয় শুকিয়ে ফেলা, নৌপথে চলাচলকারী বিপুলসংখ্যক বালু ও পাথরবাহী নৌযানের বর্জ্য নিষ্কাশন, উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে পলি জমে নদী বিল হাওর এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়া, অধিকসংখ্যক মাছ আহরণকারী কর্তৃক অবৈধ জালের ব্যাপক ব্যবহার করে সব আকারের মাছ নিধন ইত্যাদি অন্যতম। হাওর অঞ্চলে মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে টেকসই পরিবেশ বান্ধব, জনগণের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। হাওরে প্রায় পাঁচ মাস পানি থাকে। মৌসুমের শুরুতেই বিল নার্সারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন, পোনা মজুদ ও সমাজভিত্তিক সংরক্ষণের মাধ্যমে সহজেই মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি এবং পি এল নার্সিংয়ের মাধ্যমে জুভেনাইল মজুদের বিষয়ে চাষি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।

সবশেষে বলব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১৮ হাজার কিলোমিটার এলাকায় মৎস্য আহরণে আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অমিত সম্ভাবনার বিশাল সমুদ্র এলাকায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল পর্যায়ে আহরণ নিশ্চিত করে মাছের বংশ বৃদ্ধি ও মজুদ অক্ষুণœ রেখে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। এজন্য সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন অপরিহার্য।

পরিশেষে বলব, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনা মোকাবিলায় যুদ্ধ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য নিয়মিত দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন এবং মনিটোরিং করছেন। মৎস্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে যদি কঠোর পরিশ্রম করি, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাই, তাহলে মৎস্য সেক্টরে যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে তা অবশ্যই অর্জন সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে আজ আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিগণিত হয়েছি। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের পথপরিক্রমা যা তিনি দেখিয়েছেন তাও সবাই প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত হবে ইনশাল্লাহ।

                লেখক : চেয়ারম্যান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

সর্বশেষ খবর