বুধবার, ১৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

অনুভূতির আওয়ামী লীগ কই, মাফিয়ারাই ক্ষমতাধর

পীর হাবিবুর রহমান

অনুভূতির আওয়ামী লীগ কই, মাফিয়ারাই ক্ষমতাধর

শনিবার সকালে বরেণ্য রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম, রাতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ থেকে স্বাস্থ্য সচিবের স্ত্রী! আরও কত মুখ নিয়তির কাছে হেরে চলেই গেলেন। মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। সোমবার ভোর রাতে সিলেটের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ‘জনতার মেয়র, জনতার কামরান’, খ্যাত সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানও চলে গেলেন। শোকের চাদরে ঢাকা পড়ছে দেশ শোক সংবাদে বেদনাবিধুর সকাল আসে, নিকষ কালো ভয়ঙ্কর অন্ধকার নামে দুঃসংবাদে। ভয় মৃত্যুর আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে মানুষকে। অনেকে করোনায়, কেউ কেউ নানা রোগে বা হঠাৎ চলে যাচ্ছেন বিনা নোটিসে! মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণরক্ষার করুণ আকুতি ছাড়া আর কী জানাতে পারি আমরা?

এমন এক সময় তারা চলে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধির নির্দয় ফরমানে যার জানাজায় লাখো শোকার্ত মানুষের ঢল নামত সেখানে কাছের স্বজনরাও যেতে পারছেন না। অন্য সময় হলে মোহাম্মদ নাসিমের ঢাকা ও সিরাজগঞ্জের জানাজায় অশ্রুসজল লাখো জনতা আছড়ে পড়তেন; গোপালগঞ্জেও আবদুল্লাহকে শেষ বিদায় জানাতে নামত শোকার্ত জনতার ঢল। সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে কামরানকে বিদায় জানাতে লাখো জনতার শোকের মাতম হতো। আহারে। ঘরবন্দী মানুষের চোখে আজ কেবল অশ্রু, বুকভরা দীর্ঘশ্বাস। এত বেদনা।

অনেকের অকাল মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারী দেশজুড়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে জীবন-মৃত্যুর লড়াই। এতদিন দৃষ্টি ছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমে। পৃথিবীর বুকজুড়ে কান্নার শব্দ। আজ প্রিয় স্বদেশের বুকে! আজন্ম যোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ফিরে আসাটাও বড় সুসংবাদ। করোনা জয় করেই তিনি নাসিমের জানাজায় গেছেন। বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের কালরাতে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের কবর জেয়ারত করেন। এটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনীতির হারানো সংস্কৃতি। তিনি যে মত-পথের হন, কারও দাসত্ব করেন না, এটা প্রমাণ করেছেন। আর করোনাকালেও মৃত্যুতে যারা উল্লাস করেছে তারা মানসিক বিকৃত। অমানবিক হয়ে গেছে। এমন সমাজ আমাদের কখনো ছিল না। 

আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম দলেই জনপ্রিয় ছিলেন না, বিরোধী দলেও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। বড় আমুদে প্রাণবন্ত ছিলেন। এমন চলে যাওয়ায় শোকার্ত তার দলের নেতা-কর্মীসহ দেশের অগণিত মানুষ। রাজনৈতিক ও সাংবাদিক মহল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন এক কথায়, ‘আমি একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে হারালাম’। রাজনীতির কি মমতাভরা চিত্রপট ওঠে আসে তার কথায়।

বিকালে ফোন করলাম প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমুর কাছে। মায়ের পেটের ভাইকে হারালেও মানুষ অনেক সময় কাঁদে না। মনের কষ্ট নিয়ে পাথরের মতো বসে থাকে। আমি নাসিম ভাইকে নিয়ে কথা বলতেই আমু ভাই বললেন, ‘ফোন কর না কেন? ফোন করলে তো ভালো লাগে’! আমি নির্বাক। কথা বলতে পারি না। কী গভীর মমতা। আমাদের ছাত্রলীগের রাজনীতিকালে আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদরা ছিলেন আমাদের অভিভাবকতুল্য নেতা। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে, স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে অগ্নিগর্ভ সময়ে উঠে আসা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ মুজিব বাহিনীর চার প্রধানই নন, ইতিহাসের সৃষ্টি ও স্রষ্টা ছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাই ছিলেন না, ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসের নায়ক ছিলেন। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহ-আদর কুড়ানো এসব নেতাও তার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যে অবিচল ছিলেন। তারাও সূর্যের আলোয় আলোকিত রাজনীতির নক্ষত্র ছিলেন সেই সময়ের ছাত্রলীগের রাজনীতির নেতৃত্বে থাকা (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক না হওয়া) নেতাদেরও অবদান ঐতিহাসিক। সবার নাম বললে ইতিহাস হয়ে যাবে।

স্বাধীনতার পর কালের যাত্রাপথে কে বিভ্রান্ত সর্বস্বান্ত হয়েছেন, কে হারিয়ে গেছেন ভুলে অতল গহ্বরে, কে ভুলের মাশুল গুনেছেন নিঃস্ব হয়ে, কে কতটা সফল, কতটা ব্যর্থ সেই হিসাব আলাদা ইতিহাসের বিচারের খাতায় তোলা থাক। সেটি তাদের অনেকের ব্যক্তিগত ক্ষতির চেয়ে আওয়ামী লীগ ও রাজনীতির ক্ষতিটাই বাড়িয়েছে। কিন্তু এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাদের অবদান তো মানুষ ও ইতিহাস অস্বীকার করতে পারবে না! ছাত্ররাজনীতির কাল থেকে পেশাগত জীবনে তাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক যেখানে কোনো স্বার্থ নেই। খবরের সন্ধানে গড়ে ওঠা আত্মিক সম্পর্ক কেবল আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কেবল জামায়াত নেতা ছাড়া।

যাক, নাসিমের জন্য আমির হোসেন আমু শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। আশির দশকে আওয়ামী লীগে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আমির হোসেন আমু যে কঠোর পরিশ্রম করেন, সেখানে মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন তার ডানহাত। আরও অনেকে হয়তো ছিলেন। আমু ভাই শুধু বললেন, ‘নাসিম সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল সেই সময়ে। আমি ও নাসিম, সঙ্গে মোজাফফর হোসেন পল্টু সামরিক শাসনের কঠিন সময়ে একবার টানা তিন মাস আত্মগোপনে থেকে কাজ করেছি। আজ নাসিম চলে গেল, আমি শেষ দেখা, শেষ বিদায়ে যেতেও পারলাম না’-বলেই তিনি কাঁদতে থাকলেন। আমি আর কথা বলতে পারিনি। আমু ভাইকে কখনো এমন করে কাঁদতে দেখিনি, মোহাম্মদ নাসিম একদিনে তৈরি হননি। ষাটের দশকে খেয়ালের বশে আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পুত্র নাসিম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে কিছু দিন ছাত্র ইউনিয়ন করলেও বঙ্গবন্ধুর আদুরে কানমলা খেয়ে ছাত্রলীগের নেতা হন, সেই সময় পিতার সঙ্গে জেল খাটেন। আইয়ুব খানের দালাল মোনয়েম খানের নির্দেশে কলেজ তাকে বহিষ্কার করলে সেই সময়ের জগন্নাথ কলেজ, আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে বড় শক্তি ছিল। তখনকার সময় সেখানের ছাত্রলীগ নেতা ও পরে ভিপি জিএস কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদে বলেছেন কীভাবে নাসিমকে ভর্তি করান তিনি, রাজিউদ্দিন রাজু, এম এ রেজা, আল মুজাহিদী প্রমুখ নেতারা। বলেছেন অকাল প্রয়াত সাবেক এমপি আলহাজ মকবুল হোসেনের ভর্তি, ছাত্রলীগে যোগদান, প্রেম-বিয়ে ও আন্দোলন-সংগ্রামের কথা। বলেছেন, মৃত্যুর কোলে ঢলেপড়া ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহকে কীভাবে গোপালগঞ্জ জেলা যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বয়ক করেন শেখ ফজলুল হক মণি। কীভাবে মোহাম্মদ নাসিম যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। কাজী ফিরোজ রশীদ প্রয়াত সাহানা আবদুল্লাহ, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর স্ত্রীর জন্য শোক প্রকাশ করেন মোস্তফা মহসীন মন্টুর স্ত্রী সুফিয়া মহসীনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন।

দুদকের সাবেক কমিশনার পাবনার ছাত্রলীগ রাজনীতিতে উঠে আসা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ফেসবুকে লিখেছেন- নাসিমের সেনাশাসন জমানার জেল, আত্মগোপন ও নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা।

আশির দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাসিম দলের যুব ও প্রচার সম্পাদক হয়েই উপরে ওঠেন। মিডিয়াবান্ধব ও কর্মীবান্ধব চরিত্র তাকে সহায়তা করে। বিরোধী দলে থাকতে এমন কোনো আন্দোলন নেই রাজপথে তিনি নামেননি। পল্টন থেকে রাসেল স্কয়ারে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হননি। প্রাণবন্ত গণমুখী নাসিম পঞ্চম সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ, আবদুস সামাদ আজাদ বিরোধী দলের নেতা সেই থেকে গণমাধ্যমে আমাদের সঙ্গে সখ্য সেই থেকে উদীয়মান জাতীয় নেতার আসনে উঠে আসা। তারপর মন্ত্রী হয়েছেন অনেকবার। ওয়ান-ইলেভেনের কারা নির্যাতনে ব্রেনস্ট্রোক তার শরীরের ক্ষতি করলেও মনোবল কাড়তে পারেনি। এবারও করোনাকালে গণমানুষের নেতা এলাকায় ত্রাণ দিতে গেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে জয়ীও হন। কিন্তু নিয়তি! ম্যাসিভ ব্রেনস্ট্রোকে আবার আক্রান্ত। নিউরো সার্জন অধ্যাপক রাজিউল হক অপারেশন করে বাঁচানোর লড়াই করেন। কিন্তু নাসিম নিয়তির কাছে হেরে যান।

মনে পড়ে গেল আওয়ামী লীগের অকালপ্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কথা। বিদায়ী সাধারণ সম্পাদকের বক্তৃতায় তিনি জাতীয় সম্মেলনে আগত নেতা-কর্মীদের মাঝে পিনপতন নীরবতা এনেছিলেন। আবেগে মন ভারাক্রান্ত করেছিলেন। দলের অনেক বড় বড় নেতা কত বক্তৃতা করেছেন! কিন্তু স্বল্পভাষী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এক কথায় যেন আওয়ামী লীগারদের কাছে, জাতির কাছে আওয়ামী লীগকে চিনিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম, আওয়ামী লীগ একটি পরিবার, কারও কিছু হলে বুকে ব্যথা লাগে। পৃথিবীতে এমন দল নাই যে দলের নেতা-কর্মীরা এত রক্ত দিয়েছে, এটা কর্মীর দল। আমি নেতা নই, একজন কর্মী’। হৃদয়ের গভীর থেকে প্রচ- বিশ্বাসে কথা বললে এমন কথাই উঠে আসে।

আমির হোসের আমুর কান্নার শব্দ, প্রতিটি অশ্রুবিন্দু, দলের নেতা মোহাম্মদ নাসিমের জন্য কার্যত লাখ লাখ নেতা-কর্মীর আবেগ অনুভূতি, মনের ভাষাকেই প্রতিনিধিত্ব করেছিল। একটি বৃহৎ ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পরিবারের একজন সদস্যের এমন চলে যাওয়া বাকি সদস্যদেরই শোকের সাগরে ভাসিয়ে নিয়েছে।

সংসদের শোক প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাকরুদ্ধ হয়েছেন। বুকের গভীর থেকে আসা কান্না তার কণ্ঠ রোধ করেছে বোনের স্নেহের কাছে ভাইয়ের সব প্রেম ম্লান। ভাইহারা বোন কেঁদে বলেছেন, দেশে আসার পর কীভাবে মোহাম্মদ নাসিম তার পাশে ছিলেন, কীভাবে আবদুল্লাহ তার নির্বাচনী এলাকার দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তরিকভাবে, শেখ হাসিনা যখন ’৯১ সালে বিরোধী দলে তখন অনেকের সঙ্গে আমিও সারা দেশে সফর করেছি তার সঙ্গে গোপালগঞ্জ গেলেই দেখা হতো আবদুল্লাহর সঙ্গে। নাসিম ও আবদুল্লাহর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠেননি, সোমবার ভোর রাতে করোনা আক্রান্ত সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান সিএমএইচে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আহারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, কামরান গণমানুষের নেতা ছিলেন। কামরানকে নিয়ে বহু বছর পর ৯৪ সালে আওয়ামী লীগ সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান পদ উদ্ধার করে। কী দরদ আবেগে নেতা-কর্মীরা কাজ করেন। কামরানের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক ছিল। কত বিনয়ী কত হাসিমুখ ব্যবহারে মানুষের কথা শুনতেন। মানুষ জয় করতেন। আমার সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক ছিল। করোনাকালেও ফোন করে আমার শরীরের খোঁজ নিলেন। সন্তানদের খবর জানলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে এনে সিএমএইচে ভর্তি করেও বাঁচাতে পারেননি।

সিলেটের প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন কামরান। সেই নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তখনকার অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পছন্দের এম এ হক বিএনপির প্রার্থী শেখ হাসিনা নেতাদের নামালেন। নিজে মনিটর করছেন। একদিন কামরান আমাকে কিছু সমস্যার কথা জানালেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে জানাতে হবে একান্তভাবে। আমি সকালেই সুধাসদনে গেলাম। ওবায়দুল কাদের ও আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ছিলেন। নিচতলার ছোট্ট ড্রইং রুমে শেখ হাসিনা বসা। আমি তাদের দুজনকেই দেখা করতে বললে তারা ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে তিনি আপা। আমি বলি মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের বড় বোনের অবয়ব। আপা বলেই বিস্তারিত খবর দিলাম। তিনি তৎকালীন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আ ন ম শফিকুল হককে ফোন ধরিয়ে দিতে বললেন তার সহকর্মীকে। তখন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। কর্মীবান্ধব আরেক দিলখোলা জননেতা। তিনি তখন এলে আপা সিলেটের নির্বাচনী আরও খবর নিলেন। আমার বার্তা জানিয়ে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিলেন।

আবদুল জলিলের সঙ্গেও আমার হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। তার মৃত্যুর আগে শেষ জন্মদিনে নওগাঁয় গিয়েছিলাম উৎসবে অতিথি হয়ে। আমার সুনামগঞ্জের বাড়িতেও গেছেন তিনি। মহব্বতে ভরা তার হৃদয় শেখ হাসিনার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য নেতা-কর্মীর জন্য দরদ দেখেছি কেন যে শেষের দূরত্ব, অবহেলা আমি আজো বুঝিনি। আওয়ামী লীগের মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তো স্নেহ করতেন। আবদুস সামাদ আজাদ আমাদের নেতা ছিলেন। তার লেকসার্কাস কলাবাগানের বাসাটিই ছিল আমাদের ঠিকানা। রাকসুতে শেষ নির্বাচনে ছাত্রলীগ এককভাবে লড়েছিল। পরাজিত হলেও সিনেট পদে প্যানেলে আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলাম। নির্বাচনে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সব সাবেক ও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছিলেন। কি দরদ। অর্থ নেই, মনোবল ছিল। সামাদ আজাদ আমাকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আনতে চেয়েছিলেন। অনেকবার নেত্রীর কাছে নিয়ে গেছেন। ওবায়দুল কাদেরও চেয়েছিলেন, কেন হয়নি সেটা তিনিও ভালো জানেন। ৮৯ রাকসুতেও সংগ্রাম পরিষদের বাইরে ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ মিলে আলাদা প্যানেল দিয়েছিল। পরিচিতি সভায় নুরুল ফজল বুলবুল পরিচয় করান প্রার্থীদের। প্রধান অতিথি মোহাম্মদ নাসিমকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, পিনপতন নীরবতা নামিয়ে আনেন। ’৭৫ পর সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের প্রথমে আহ্বায়ক পরে দুবার ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আমার বড় ভাই মতিউর রহমান পীর। তখন আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ একটি আদর্শিক নির্লোভ পরিবার। কী কষ্টের সময়! শেখ হাসিনাও জানেন না কী দুর্দিনে কঠিন সময়ের মুখোমুখি ছিলেন তারা। আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে হলেও পরে কারামুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক মধ্যমণি হন তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ। তার আগে মিজানুর রহমান চৌধূরী ও নূরে আলম সিদ্দিকীরা দলে ছোট্ট ভাঙন এনে প্রথম সর্বনাশটাই করেন। আবদুর রাজ্জাকও মালেক উকিলকে সভাপতি না করে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে সে সময় সভাপতি করলে উত্তম হতো এটা আমার বিশ্বাস।

সেই কঠিন দুঃসময়ে আওয়ামী লীগে দেশজুড়ে নির্যাতিত গণমুখী আদর্শিক নেতৃত্ব ছিল। ছাত্রলীগ ওবায়দুল কাদের ও বাহালুল মজনুন চুন্নুর নেতৃত্বে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। কত কত আদর্শিক নেতা। কত সংগঠক। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে বিজয়। কিন্তু কেন্দ্রে নেতৃত্বের লড়াই। অনেক সভাপতি প্রার্থী। ৮১ সালের ইডেন কাউন্সিলে দিল্লিতে নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দলের ঐক্যের প্রতীক হয়ে এলেন। ১৭ মে আবেগ ফিরে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ, নেতা-কর্মী, তাকে অভ্যর্থনা জানালেন ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে। স্বজন হারানোর বেদনায় কান্নায় তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করলেন। ১০ লাখের বেশি মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনা’ ধ্বনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যে পাকিস্তানি ভাবধারায় গণতন্ত্রের কবর দিয়ে অন্ধকার যুগ নেমেছিল সেখানে গণতন্ত্র ও মুক্তির আলো জ্বলে উঠল। ২৯ মে সিলেট গেলেন। আমরা গেলাম। তুমুল বৃষ্টি ঝড়ে জনতার স্রোত। তারপর তার দীর্ঘ সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরতে না ফিরতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে কেন ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন ও ছাত্রলীগের সম্মেলন আমার চিন্তায় আসে না। এতে দলে ভাঙন, জাসদ সৃষ্টি বঙ্গবন্ধুকেই দুর্বল করেনি মেধাবী দেশপ্রেমিক তরুণ শক্তিকেই ধ্বংস করেনি, দেশের সর্বনাশ করেছে, তেমনি শেখ হাসিনা আসতে না আসতেই কেন ছাত্রলীগের সম্মেলন? কেন দুইভাগ? ফজলু-চুন্নুর নেতৃত্বে আবদুর রাজ্জাকের আশীর্বাদ, ছাত্রলীগের বড় অংশটি যুক্ত, আওয়ামী লীগের জেলা নেতাদেরও সমর্থন, আবার কেন্দ্রে এটা সমাধান না করে ৮৩ সালে দুই বছর পর জালাল-জাহাঙ্গীরকে সমর্থন দিয়ে ভাঙন আনা বুঝি না! ছাত্রলীগের দুই অংশই জাহাঙ্গীর কবির নানককে সাংগঠনিক সম্পাদক করেছিল। তাকে রেখেও তো সম্মেলনের সাত দিনের মধ্যে সমাধান হতে পারত। দুই বছর পর কেন ছাত্রলীগ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত! আবদুর রাজ্জাক বেরিয়ে গেলে সামাদ আজাদ বলেছিলেন, ফরিদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম! অনেকেই ফিরলেন। কিন্তু ক্ষতিটা দলের, দেশেরই হলো। রাজনীতিরই হলো। এসব জাতীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। গবেষণার বিষয়। পরে অনেকের প্রত্যাবর্তন ঘটে মূল ধারায়। সর্বশেষ আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পুরো দল। ততদিনে সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের ক্ষতি। কিন্তু তারাও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রাণ সেই সময় আমির হোসেন আমু শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব দলে সতীর্থদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন।

যাক, আগামী ২৩ জুন উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ৭১ বছরপূর্তি করবে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ইয়ার মোহাম্মদ খানের রোজ গার্ডেনে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন কারাগারে। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দল ছেড়ে চলে গেলেন ন্যাপ গঠন করে। প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি আতাউর রহমান খান থেকে সালাম খানরাও থাকেননি, সোহরাওয়ার্দীরও মৃত্যু হয়। মানিক মিয়াকে সভাপতি হতে বললেও তিনি রাজি হননি। ইত্তেফাক নিয়ে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জন্য স্বাধিকার স্বাধীনতায়, ৬ দফায় সাহসী ভূমিকা রাখেন শেখ মুজিব সে দিন দলের প্রিয় মুজিব ভাই। ১৩ বছরই জেল খেটে ৩৮ মাসের কারাগার থেকে ৬৯-এর তোফায়েলের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের বিস্ময়কর গণঅভ্যুত্থানে বেরিয়ে এসে জাতির বঙ্গবন্ধু হন। অবিসংবাদিত নেতা হন। তার স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যালটেই জাতি রায় দেয়নি। তার ডাকে মুক্তিযুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি দুর্ধর্ষ সাহসী নেতৃত্বে নির্লোভ আদর্শে লক্ষ্যে অবিচল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করে জাতির পিতা হন। শেখ হাসিনা পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্বে সফলতা ধরে রেখেছেন। তিনি দলের প্রায় সবারই আপা নেত্রী। ৭১ বছরে দল ক্ষমতায় ১৮ বছর। এবার টানা ১১ বছর দেশে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার হাত ধরে ঘটেছে। সীমান্ত সমস্যা সমাধান, সমুদ্র জয় হয়েছে। খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। জঙ্গি-সন্ত্রাস দমন হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র কি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি শক্তিশালী হয়েছে? সুশাসন? আকাশ জয়ের গৌরব নিয়ে করোনাযুদ্ধে কেন দেখি দুর্নীতিগ্রস্ত চিকিৎসা খাতের বীভৎস রূপ? আওয়ামী লীগ কি সেই আদর্শিক নির্লোভ ত্যাগী নেতা-কর্মীর দল আছে? যশোরের রওশন আলীর জায়গায় আজ শাহীন চাকলাদার! এটা কি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শিক রাজনীতির সঙ্গে যায়? অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। মন্ত্রিসভা কি দক্ষ পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের? সংসদে যারা দলের তাদের সবাই কি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে পড়তে পারেন? আওয়ামী লীগের চরিত্র লালন করেন? দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আদর্শ কই? বামপাড়ার বাতি নিভে গেছে। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।

আওয়ামী লীগে নেতা কই? যারা উঠে এসেছিলেন দলে ক্ষমতায় জায়গা কই? সেই দুর্দিনের ভাগাভাগি করে খেয়ে দলের জন্য ত্যাগী মমতার দরদের সংগঠক আজ কই? অনেকে বলেন বেলা শেষে আমি নাকি শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ। জানি না। তবে বিশ্বাস করি কাল শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে দেশ দোজখে পরিণত হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হবে। এই আওয়ামী লীগ রুখতে পারবে? মোস্তফা মহসীন মন্টুর মতো বীর, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো বীর দলে নেই। কতজন ছিটকে গেছেন। মুজিবকন্যার দুঃসময়ের সাথীরা কি পাশে?

যা বিশ্বাস করি বলি। ভুল জীবনে থাকতে পারে, অপরাধ নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আজন্ম অবিচল আছি থাকব। আমি নেতা হতেও আসিনি, দাস হতেও আসিনি, মোসাহেবদের কদমবুচি রাজনীতির পাঠ ও জীবন পাইনি। মতলববাজি বুঝি না। আহমদ ছফা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ জয়ী হলে একাই জিতে, পরাজিত হলে জাতি পরাজিত হয়। আজ আদর্শিক আওয়ামী লীগ নয়, দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুটেরা, শেয়ার লুটেরা, অর্থপাচারকারী মাফিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাধর। এরা দেশের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে আমার প্রতিটি শব্দ ও কথা উচ্চারিত হবে। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মাফিয়াদের হাতে তুলে দিতে পারি না। আমাকে এ শক্তি যত ক্ষমতাধর হোক, শেষ করে দিতে পারে, নত করতে পারবে না। জানি আমি একা। কিন্তু ভিতর আগুনে পুড়ে ফিনিক্স পাখির মতো যে শক্তি দেয় সেটাই আমার শক্তি, পেশাটা ইবাদত যেমন প্রেম আত্মার গভীরের পরিশুদ্ধ পবিত্রতা।

            লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর