বুধবার, ১৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা
বাজেট ২০২০-২১

বিশ্লেষণ এবং প্রতিক্রিয়া

অধ্যাপক ড. মো. সেলিম উদ্দিন

বিশ্লেষণ এবং প্রতিক্রিয়া

বিশ্বব্যাপী মহামারী কভিড-১৯ এর প্রভাবে আমাদের  অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অস্বাভাবিক, অসাধারণ,  অস্থির, অনিশ্চিত, বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি ঘোষিত হয়েছে। প্রস্তাবিত এ বাজেটটি করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় বিগত কয়েক মাসে গৃহীত বিভিন্ন নীতি-কৌশল এবং প্রণোদনাকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের অন্যতম উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে। ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেট ২০২০-২১ এর মৌলিক অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো করোনা দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন নীতি-কৌশলের সঠিক বাস্তবায়ন। যথা : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার বিশাল প্রণোদনার দ্রুত বাস্তবায়ন, সরকারি ব্যয়ে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য, বিলাসী ব্যয় হ্রাস ও নিরুৎসাহিত করা, স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করা, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা। উল্লিখিত বিষয়সমূহকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামের প্রস্তাবিত ২০২০-২১ বাজেটটি ১১ জুন, ২০২০ মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এই সরকারের প্রতিটি বাজেটই রেকর্ড ভেঙেছে। এবার তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাজেট ২০২০-২১ এ মোট ব্যয় প্রাক্কলন হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। যা সংশোধিত ২০১৯-২০ থেকে ৬৬ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা বা ১৩.২৪ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ এর পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বা ১৮.২ শতাংশ বেশি। একইভাবে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা যা সংশোধিত ২০১৯-২০ অর্থ সাল থেকে ২৯ হাজার ৯৩১ বা ৮.৬০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের মোট রাজস্ব প্রাক্কলন পূর্ববর্তী সংশোধিত বাজেটটির তুলনায় ৬১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা বা ১৯.৩২ শতাংশ বেশি। মোট ব্যয় এবং রাজস্ব প্রাক্কলনের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, মোট ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি রাজস্ব প্রবৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং মোট বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ছয় শতাংশ।

২০১৯-২০ সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে এক লাখ ৫৩ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে বহিঃউৎস থেকে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ নয় হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঘাটতি অর্থায়নের প্রাক্কলন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ সংশোধিত বাজেট বহিঃউৎস থেকে ৫৬ হাজার ১৬৩ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৯৭ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা; ব্যাংক ঋণ ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকার অর্থায়ন পুনঃপ্রাক্কলন করা হয়েছে। অথচ ২০১৯-২০ এ ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের প্রাক্কলন ছিল ৪৭  হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়ন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বহিঃউৎস থেকে অর্থায়ন টার্গেট অনুযায়ী না হওয়ায় এবং রাজস্ব আদায় ঘাটতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাজেটের টার্গেট অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হয়, তাই বাজেট ২০২০-২১ এ ঘাটতি অর্থায়ন এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা এক বিরাট চ্যালেঞ্জিং। কেননা অভ্যন্তরীণ উৎস বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাজেট অতিরিক্ত ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্তসহ তারল্য সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সুতরাং রাজস্ব আহরণ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাক্কলিত অর্থ যথাসময়ে সংগৃহীত না হলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এজন্য রাজস্ব আহরণে এবং ঘাটতি অর্থায়নে বিশেষ করে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নে সাফল্য দেখাতে না পারলে প্রস্তাবিত বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তাই প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কলাকৌশলসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থা অতীতের যে কোনো সময় থেকে বেশি নিতে হবে। মোট বাজেট ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ২৭.৩৮ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে এক লাখ ৬৭ হাজার ১১ কোটি টাকা (মোট ব্যয়ের ২৯.৪০ শতাংশ), সাধারণ সেবা খাতে এক লাখ ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা (মোট ব্যয়ের ২৪.৬৯ শতাংশ), সুদ পরিশোধ ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা বা ১১.২৩ শতাংশ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (চচচ), আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি এবং বিনিয়োগসহ মোট ৩৬ হাজার ৬১০ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ৬.৪৫ শতাংশ এবং ওই বরাদ্দগুলো যথাক্রমে সংশোধিত বাজেট ২০১৯-২০ চলতি অর্থবছরের যথাক্রমে এক লাখ ৩৯ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা (২৭.৮১ শতাংশ), এক লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৫ কোটি (৩১.৮১ শতাংশ), এক লাখ ১০ হাজার ৮১৩ কোটি (২২.০৯ শতাংশ), ৫৭ হাজার ৬৬৪ কোটি (১১.৫০ শতাংশ) এবং ৩০ হাজার ৯৯ কোটি টাকা (৬ শতাংশ) পুনঃপ্রাক্কলন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সামাজিক অবকাঠামো এবং ভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়লেও মোট বরাদ্দের শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।

বিগত তিন বছরে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত যথাক্রমে ৭.২৮, ৭.৮৬ এবং ৮.১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আলোকে চলতি বছরে প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আগ্রাসী আক্রান্তে ৫.২ শতাংশে সংশোধিত প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাজেট ২০২০-২১ এ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। বাজার চাহিদাসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থায় পুনর্বাসন হলে হয়তো এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। মুদ্রাস্ফীতি ৫.৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার আসার প্রত্যয় বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে বিচার বিশ্লেষণপূর্বক অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে যেটি কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমান হবে।

কেননা কভিড-১৯ মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ এবং এই খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটির টাকা বরাদ্দ যা ২০১৯-২০ এ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা, তাছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় আরও ১৩টি মন্ত্রণালয় যুক্ত আছে সেগুলোসহ বিবেচনায় নিলে মোট বরাদ্দ ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা আরেকটি অগ্রাধিকার খাত যেটিতে আগামী অর্থবছরে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০১ শতাংশ। সংশোধিত বাজেট ২০১৯-২০ এ যেটি ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল।

বিশ্লেষণে বলা যায়, বরাদ্দের এই প্রবৃদ্ধি সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আওতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। কৃষি এবং কৃষির উপ-খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা, ভর্তুকি এবং নানা নীতি-কৌশল প্রাধান্য পেয়েছে। এই খাতে মোট বরাদ্দ ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। যা সংশোধিত বাজেটে ২৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা। বরাবরের মতো সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত; যেটি মোট ৮৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ১৫.১ শতাংশ এবং যেটি সংশোধিত ২০১৯-২০ এ প্রাক্কলন হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। যদিও বরাবরের মতোই উল্লেখযোগ্য বাজেট বরাদ্দ পাবলিক সার্ভিস খাতে হয়ে থাকে যেখানে সুদ পরিশোধ ৬৩ হাজার ৭৭৬ কোটিসহ মোট বরাদ্দ এক লাখ ৮০ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের প্রায় ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৬৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ১১.৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে ৩৯ হাজার ৫৭৩ কোটি (বরাদ্দের ৭.০০ শতাংশ), প্রতিরক্ষা খাতে ৩৪ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা (বরাদ্দের ৬.১ শতাংশ), সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ খাতে ৩২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা (বরাদ্দের ৫ শতাংশ) ইত্যাদি খাত উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ পেয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন খাত বরাদ্দ বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেট জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানমূলক কর্মসূচি এবং কর সহনীয়করণসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারী মেগা প্রকল্পসহ স্থবির বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ার নানা কলাকৌশল অগ্রাধিকার পেয়েছে। বাংলাদেশের অপার উন্নয়ন সম্ভাবনা, জনগণের প্রত্যাশা, ভোগ ও চাহিদার ক্রমোন্নতি, বর্তমান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে বলা যায়, আকার রক্ষণশীল না হওয়াই ভালো। বড় আকারের বাজেটে অনেকে মনে করেন, অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই অর্থ বরাদ্দে উদারতা থাকা ভালো এবং অনেক সময় সফলতা আসে তবে অর্থ ব্যবহারে সতর্ক থাকা এবং অর্থ অপব্যবহার বা অপচয় রোধে সচেতনতাসহ কঠোরতা অবলম্বন করলে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিশেষ করে সেপ্টেম্বর ২০২০ যদি বিশ্ব মহামারী কভিড-১৯ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে বিশাল এই বাজেট অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কিত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সামষ্টিকে অর্থনীতির সূচকগুলো যথা : মুদ্রাস্ফীতি ৫.৪ শতাংশ রাখা, মধ্যমেয়াদি নীতিকৌশল কঠোরভাবে পরিপালনসহ কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, রপ্তানি খাত, আবাসন খাত, প্রবাসী আয় ও সেবা খাতকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নেওয়ার অঙ্গীকার, দারিদ্র্য নিরসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট এবং আয়বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে সবিশেষ সূচক ও চালকগুলোকে বাজেট বাস্তবায়নে কঠোরভাবে পরিপালনসহ নজরদারিতে রাখতে হবে। উল্লেখ্য, কোনো ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ নতুন করারোপ ছাড়াই এই বিশাল বৃহৎ এবং উচ্চাভিলাষী বাজেট যদি প্রত্যেক মাসে আনুপাতিক হারে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সঠিক অর্থে ও মানসম্মতভাবে বাস্তবায়িত হলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি, অবকাঠামো ঘাটতি হ্রাস এবং দারিদ্র্যবান্ধব, অন্তর্র্ভুক্তিমূলক ও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানমূলক ব্যয় ইত্যাদির মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেট সার্বিক জনকল্যাণে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে। মোদ্দাকথা, প্রস্তাবিত বাজেটের সাফল্য নির্ভর করবে সারা বছরের আর্থিক কর্মকান্ডগুলো মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিকের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে গুণগত ও পরিমাণগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে মানসম্মত বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। কেননা বিগত বছরসমূহে বাজেট অবাস্তবায়নের হার প্রায় ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২১ শতাংশে পৌঁছেছে।

উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বর্তমান বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। সক্ষমতার অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন পুরোপুরি না হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আবার বছর বছর সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, এর গুণগত মান বৃদ্ধি এবং অর্থবছর শেষ তিন মাসে বা শেষ প্রান্তিকে অত্যধিক ব্যয়ের কারণে সরকারি অর্থের অপচয়, কাজে নিম্নমান ও গুণগতমান হ্রাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। অন্যদিকে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ গত কয়েক বছর ২১-২২-২৩ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধির জন্য এই হার জিডিপির ২৬-২৭ শতাংশে উন্নতি করা দরকার। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আগামী অর্থবছরে ঋণ সুবিধা, বিনিময় হার, তারল্য সংকট, খেলাপি ঋণ সংকট, মুদ্রাস্ফীতির হার, বহিঃখাতের অসামঞ্জস্যতা, বিনিয়োগকারীর আস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংকটসহ বিশ্ব মহামারীর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ ও প্রভাব ইত্যাদি কারণে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে অন্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আহরণ অন্যতম, অবকাঠামোগত ঘাটতি, সরকারি ব্যয়ের অগ্রাধিকার ঠিক করা, ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় আমদানি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক বৃদ্ধি, কাক্সিক্ষত মাত্রায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সঞ্চয় বিনিয়োগ তারতম্য উল্লেখযোগ্য। উপরোক্ত চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ব্যয়াধিক্য এবং বাস্তবায়ন সময়োত্তীর্ণের সঠিক ঝুঁকি নির্ণয়, মাসিক ভিত্তিতে প্রকল্প রেজাল্ট ভিত্তিতে মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বৈদেশিক সূত্র থেকে ঝামেলামুক্ত ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত, ৯% সুদের হার, বিনিময় হার, মুদ্রাস্ফীতির হার, আস্থার উন্নতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি চলমান কার্যক্রমের সুষ্ঠু সমাপ্তসহ বিষয়সমূহের ওপর জোর নজরদারি, তদারকি এবং স্থিতিশীলতা অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া বাজেটকে সঠিক বাস্তবায়নে সক্ষমতা, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের স্বচ্ছ রোডম্যাপ, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে গুণগত পরিবর্তন ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে বাজেট বাস্তবায়নের অনেক চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট, ব্যবসা ব্যয়-হ্রাস, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে এই বাজেটে সামাজিক ও ভৌত-অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যয়ের গুণগতমান, বাস্তবায়ন সময়, মোট প্রকল্প ব্যয়ের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করে সঠিক ব্যয় ও সঠিক সময়ে, সঠিক গুণ ও মানে প্রকল্প কার্য সমাপ্তের জন্য সঠিক মানদন্ড নিশ্চিত করতে হবে। চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের হার সময় সময় প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন-বাংলাদেশ দৈনিক কতটুকু বা কত কিলোমিটার রাস্তা সম-এককে  তৈরি হচ্ছে, দৈনিক কত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (সম-এককে) ইত্যাদি প্রকাশ করার জন্য সুপারিশ করছি। সামাজিক ও ভৌত-অবকাঠামোর কারণে সুফলগুলো সুস্পষ্ট করা উচিত বলে মনে করি।

নিম্নআয়ের ব্যক্তি, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসায়ীদের কভিড-১৯ এর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আয়করের অকরযোগ্য সীমা বৃদ্ধি, প্রথম এক লাখ টাকায় ৫% আয়কর, সর্বোচ্চ কর হার ৩০%-এর বদলে ২৫%, অতালিকাভুক্ত করহার হ্রাস, কৃষি ও কৃষি উপ-খাতে নিয়োজিত কৃষি যন্ত্রপাতিতে শুল্ক হ্রাস, ভ্যাট রেয়াত, কাস্টমসের হয়রানি রোধে বিভিন্ন কর্মকৌশল, রপ্তানিমুখী দেশীয় এবং আমদানি পরিপূরক শিল্প ও ব্যবসায়কে সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার প্রবর্তন, শুল্ক হ্রাস, কর হার হ্রাস, রাজস্ব প্রণোদনাসহ বিভিন্ন নীতি-কৌশলের সহায়তা বাজেটে পরিস্ফুটিত হয়েছে। মোটামুটি বড় ধরনের নতুন কোনো করারোপ ছাড়াই এই বাজেট প্রণীত হয়েছে। রাজস্বের উৎসের জন্য অনেকটা ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অর্থমন্ত্রী অনেকটাই কালোবাজারির অর্থের উৎসের ওপর নির্ভরশীল হতে চেয়েছেন।

অতীত অভিজ্ঞতা এ ব্যাপারে সুখকর নয়। তবে আগামী অর্থবছরের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন হয় কিনা দেখার বিষয়। সব পক্ষকে মোটামুটি স্বস্তি দিয়ে এই বাজেট বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা রচিত হয়েছে সেটি সঠিক অর্থে দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সময়মতো বাস্তবায়নের সব কর্মকৌশল গ্রহণ ব্যতীত সফলতা দুরূহ হবে। বিশ্ব মহামারী কভিড-১৯ বিগত কয়েক মাসে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত বিশ্বকে একটি শিক্ষা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, অদূর ভবিষ্যতে বা নিকট ভবিষ্যতে বহু জানা, অস্পষ্ট, স্পষ্ট এবং অজানা চ্যালেঞ্জ এবং বিপদ যে কোনো সময় দেখা দিতে পারে যেটি অর্থনীতি পুনর্গঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে যা অবশ্যই বৈচিত্র্যময় ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত ঘটনাবলীর সঙ্গে দ্রুত তাল মিলিয়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের ব্যবস্থা রেখেই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে।

 

লেখক : অধ্যাপক, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর