শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রসঙ্গ : রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ বেড

এ কে এম শহীদুল হক

প্রসঙ্গ : রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ বেড

করোনা, করোনা, করোনা। সর্বত্র করোনা। বিশ্বব্যাপী করোনা। পত্রিকার পাতা খুললে করোনা, টেলিভিশন অন করলে করোনা, মোবাইল ফোনে করোনা, পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে, শহর গ্রাম-গঞ্জে সর্বত্র করোনা। ভয়, আতঙ্ক, আর্তনাদ। হাসপাতালে সিট নেই, অক্সিজেন নেই, আইসিইউ বেড নেই। বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। আত্মীয়স্বজনের বুকফাটা কান্না। হাহাকার, ক্ষোভ, চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধিক। এসব শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। এমনিতেই স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী। করোনা নিয়ে মার্চ-এপ্রিলে একাধিকবার লিখেছি। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখসারি যোদ্ধা ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সুরক্ষা নিয়ে লিখেছি। গাইডলাইন করে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা উন্মুক্ত করার মতামত দিয়ে লিখেছি। করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা ও জটিল রোগীর চিকিৎসার সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব লেখনিতে ছিল। চিকিৎসকরা লিখেছেন, বিশেষজ্ঞরা লিখেছেন, যারা দেশ ও মানুষ নিয়ে চিন্তা করেন তারা লিখেছেন। এখনো লিখছেন। মিডিয়াতে কথা বলছেন, মতামত ব্যক্ত করছেন, পরামর্শ রাখছেন। কিন্তু কে কার কথা শোনে। তাই ভেবেছিলাম করোনা নিয়ে আর লিখব না। কিন্তু অতি সম্প্রতিকালের দু-চারটি ঘটনা এবং সংবাদ মাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদন পড়ে না লিখে পারলাম না।

আমার নিজ জেলার একজন ব্যবসায়ী যিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক। তিনি আমার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড এবং ঘনিষ্ঠজন। অতি সম্প্রতি তার মোবাইল ফোন দিয়ে তার মেয়ে আমাকে ফোন করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, তার বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৫ জুন থেকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার অবস্থা ভালো না। ফুসফুস আক্রান্ত হয়েছে। ওই হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। মেয়েটি আমাকে অনুরোধ করছিল তার বাবাকে সিএমএইচ-এ ভর্তি করার ব্যবস্থা করতে।

ওই হাসপাতালের মালিক আমার ঘনিষ্ঠজন। তাকে ফোন দিলাম। দুটো সেল ফোন বন্ধ। ল্যান্ড ফোনেও সংযোগ পেলাম না। হাসপাতালের একজন প্রভাবশালী পরিচালক আমার পরিচিত। আগে টেলিফোনে কথা হতো। অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তাকে বার বার ফোন করেও পেলাম না। রিং হয় রিসিভ করেন না। আমি জানি সিএমএইচ-এ এই রোগী ভর্তি করার সুযোগ নেই। তবুও সেনাপ্রধান ও সিজিএস মহোদয়কে অনুরোধ করে মেসেজ দিলাম। সিজিএস মহোদয় তাৎক্ষণিকভাবে টেলিফোন করে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন। সিএমএইচ-এ এক হাজারের বেশি রোগী। হাসপাতালে রোগী রাখার কোথাও স্থান নেই। সেলিম ভাইয়ের মেয়েটিকে সব জানালাম। মেয়েটির কণ্ঠে শুধু অসহায়ত্বের সুর। শুধু কাঁদছিল। যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন সেই হাসপাতালের মালিক, পরিচালক এবং আমার পরিচিত অন্যদের ক্ষুদে বার্তা দিয়ে অনুরোধ করলাম এদিকে বিশেষ নজর দিতে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি শিরোনাম- ‘হাসপাতাল খুঁজতে খুঁজতে শেষ অক্সিজেন, করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের মৃত্যু’। এ চিকিৎসকের নাম মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বরিশালের একজন স্বনামধন্য শল্যচিকিৎসক। তিনি বরিশালের আধুনিক রাহাত আনোয়ার হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি অসুস্থ হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত রোগী দেখেছিলেন। ৮ জুন তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। অক্সিজেন দেওয়া অবস্থায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা আনা হয়। এভারকেয়ার হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল কোথাও আইসিইউ বেড খালি না পেয়ে বাড্ডা এলাকার এএমজি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে সংবাদ পেয়ে সেখানে যান। তার সঙ্গে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ায় তার মৃত্যু হয়। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের জন্য হাহাকার চলছে। কোথাও সিট খালি নেই। অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা রাস্তায় মারা যাচ্ছে। একই দিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের প্রেস ব্রিফিংয়ে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেসনোটে জনসাধারণকে অনুরোধ করা হয়-কেউ যেন অক্সিজেন সিলিন্ডার ক্রয় করে বাসা-বাড়িতে মজুদ না রাখে।

নাগরিকরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বাজার থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাসাবাড়িতে মজুদ রাখলে হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট দেখা দেবে। চিকিৎসক ও অভিজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া বাসাবাড়িতে অক্সিজেন ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ ঘোষণা অবশ্যই যথার্থ। নাগরিকদের অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে মজুদ না করাই উচিত। এটা যেমন একদিকে ঠিক, অপরদিকে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর রাস্তায় মৃত্যু হওয়ার বিষয়টিও ভেবে দেখা উচিত। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে যখন কোথাও রোগীকে ভর্তি করা যায় না বা আইসিইউ বেড পাওয়া যায় না তখন তো রোগী রাস্তাই মারা যায়। যদি রোগীর সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে তখন হয়তো কয়েক ঘণ্টা বাঁচিয়ে রেখে হাসপাতালে ভর্তি করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। আবাসস্থল থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তো অক্সিজেন দেওয়া যায়। এতে রোগীর কষ্টও হয়তো কিছু লাঘব হতে পারে এবং তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকিও কমতে পারে। অনেক রোগীকে বাসায় অক্সিজেন দিয়ে তার দেহের অক্সিজেন সেচুরেশন ঠিক রাখা যায়। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই প্রয়োজন। স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে অক্সিজেন দেওয়া অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। যখন সিলিন্ডারে অক্সিজেন শেষ হয়ে যায় তখন তিনি মারা যান। সিলিন্ডারে অক্সিজেন আরও কিছুক্ষণ মজুদ থাকলে হয়তো তিনি মারা যেতেন না।

হাসপাতালে রোগীর জন্য অক্সিজেন সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে এবং ক্রিটিক্যাল রোগী হাসপাতালে গেলে ভর্তি হতে পারবে এমন নিশ্চয়তা জনমনে সৃষ্টি হলেই কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার ক্রয় না করার অনুরোধ জনগণ হয়তো আমলে নিতে পারে। অন্যথায় এ অনুরোধে কতটুকু সাড়া মিলবে তা সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা উচিত। স্বাস্থ্য অধিদফতর মানুষের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত না করে শুধু পরামর্শ দিয়ে যাবে এটা নাগরিকদের বিশেষ করে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি ও ব্যবহারের জন্য নীতিমালাও থাকা প্রয়োজন। তা কি আছে?

পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, করোনা সংকটকালে চীন অতি দ্রুত সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে করোনা রোগীদের জন্য হাই ফ্লো অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে হাই ফ্লো অক্সিজেনের অভাব প্রকট। এ ক্ষেত্রে পরামর্শক কমিটির প্রস্তাব কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি বলেও তিনি নাকি আক্ষেপ করেছেন। একই প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, তারা হাই ফ্লো অক্সিজেন চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। বিদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অনেক সময় পেয়েছে। প্রায় চার মাস। এতদিন পরে যদি ডিজি (হেলথ) মহোদয় বলেন, আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি, এটা করছি, ওটা করছি, এটা করব, ওটা করব-এসব কথা মানুষ কতটুকু গ্রহণ করবে সে বোধশক্তিও তাদের আছে কিনা জানি না। বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে অনেক আগেই তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রস্তুত রাখা উচিত ছিল। এখন মানুষ সেসব প্রস্তুতি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দেখতে পেত। তার সুফল এখন জনগণ ভোগ করত। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দূরদর্শিতার অভাব এবং যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়। ডিজি (হেলথ) সাহেবকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতে চাই হাই ফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে এখন কেন উদ্যোগ নিচ্ছেন? আগে কেন নেননি?

স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও চিকিৎসাসেবার আধুনিকীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অর্থের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো যোগ্য নেতৃত্ব ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগের অভাব। গতিশীল নেতৃত্ব (dynamic leadership) ও দূরদর্শিতা না থাকলে পরিকল্পনা করা যায় না। এখানেই মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বিভিন্ন সময় বক্তৃতা বিবৃতিতে করোনা মহামারীর ব্যাপারে কথা বলেছেন, গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি মুজিববর্ষের সব কর্মসূচি স্থগিত করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী তো মাইক্রো লেভেল কাজ করবেন না। তিনি তো মেক্রো লেভেলে নির্দেশনা দেবেন। হাসপাতালে সেন্ট্রালি হাই ফ্লো অক্সিজেন আছে কিনা, আইসিইউ বৃদ্ধি করতে হবে কিনা, জনবল বাড়াতে হবে কিনা, টেকনেশিয়ান আছে কিনা, সরঞ্জামাদি আছে কিনা, ইত্যাদি বিষয়গুলো তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেখার কথা নয়। Need Assingment করে এবং Technical Knowledge দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা তো অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন ভিশনারি লিডার। একনেকের সভায় তার প্রজ্ঞা আমরা লক্ষ্য করেছি। দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণ হবে এমন প্রকল্পগুলোই তিনি কোনো প্রশ্ন না তুলেই অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছে না বলতে কিছু নেই। কিন্তু এত দিনেও মাঠ পর্যায়ের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা মোতাবেক পরিকল্পনা করে স্বাস্থ্যসেবার মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম সম্পাদনে কেন বিলম্বিত হলো? কেন প্রত্যাশিত মানের হলো না? এর জবাব কে দেবেন?

এটা ঠিক যে, পৃথিবীর অন্যান্য অনেক উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশেরও করোনাভাইরাস সম্বন্ধে ধারণা ছিল না। প্রাথমিকভাবে কেউ এর ভয়াবহতা সম্বন্ধে ধারণা করতে পারেনি বলেই এ ভাইরাসের এত ব্যাপকতা ও এর দ্বারা অসংখ্য লোকের অকাল মৃত্যু। কিন্তু বাংলাদেশ তো সংক্রমণ বিস্তার হ্রাস করার এবং পরিকল্পনা করে চিকিৎসাসেবার সক্ষমতা বৃদ্ধির সময় পেয়েছে। কাজেই অন্য দেশের খারাপ পরিস্থিতির উদাহরণ টেনে স্বস্তির ঢেঁকুর তোলার যৌক্তিকতা নেই। কোনো কোনো ছোট দেশও ভালো অবস্থানে আছে।

সংক্রমণের বিস্তার রোধ করার জন্য সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করল। আমরা কঠোর হতে পারলাম না। ঢিলেঢালাভাবে চলল। তারপর গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে খেলা চলল। সরকার সিদ্ধান্ত নিল ঈদের সময় কাউকে তার নিজস্ব স্থান থেকে অন্যত্র যেতে দেবে না। কিন্তু সরকার সে অবস্থানে থাকতে পারল না। ব্যক্তিগত যানবাহনে স্থান ত্যাগ করার অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নিয়ে হাজার হাজার লোক গ্রামে গেল। ঈদের আগে দোকানপাট খোলার সুযোগ দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন আছে। এসব কারণে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংক্রমণ হ্রাস করতে না পারলে হাসপাতালগুলোতে রোগী রাখা সম্ভব হবে না। ১০ জুন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। শতকরা চারজন ক্রিটিক্যাল রোগী হলে তার সংখ্যা হয় ৩ হাজার। সারা দেশে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ১ হাজার ৫০০-এর বেশি হবে না। রোগী প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংক্রমণ রোধের জন্য ব্যক্তিসচেতনতার পাশাপাশি কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ অপরিহার্য। লকডাউনের আইনগত ভিত্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ সংশোধন করে একটি ধারা সংযোজন করলেই হয়। লকডাউন না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। লকডাউন বলবৎ করতে পুলিশকেও ক্ষমতা দিতে হবে। 

কভিড-১৯ এর টেস্ট ও চিকিৎসার দ্বার উন্মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা মার্চ মাস থেকে উপলব্ধি করা হয়েছিল। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহল মতামত ব্যক্ত করেছিল। পত্রিকায় আমার একাধিক লেখাতেও আমি এ ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেছিলাম। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সুরক্ষার বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। অনেকেই এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেক বিলম্ব করে সেদিকে অগ্রসর হয়েছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কভিড ও নন-কভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও কভিড-১৯ টেস্ট করার সক্ষমতা তৈরি করে সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ পর্যাপ্ত রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সমস্যা জেনে তা সমাধানের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। অন্যথায় তারা করোনা রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে আগ্রহী হবে না। এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়ন এবং সে মোতাবেক সেবা দিচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন।

রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছে। তারা তো সম্মুখ সারিতে থেকে অতি ঝুঁকির মধ্যেও করোনা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন। নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও ঝুঁঁকির মধ্যে কাজ করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের প্রায় ছয় হাজার সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক চিকিৎসকও করোনা রোগীর চিকিৎসা করে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবুও তারা সবাই দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

করোনা আক্রান্ত রোগী ও রোগীর আত্মীয়-স্বজনরাও অসহায় অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। তাদের মানসিক অবস্থা চরম পর্যুদস্ত থাকে। এ সময় ডাক্তার বা হাসপাতালের মালিক, পরিচালকরা রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে একটু কথা বলেন ও মানবিক আচরণ করেন তবে তারা মানসিক প্রশান্তি পায়। চিকিৎসকরা অত্যন্ত ব্যস্ত। টেনশনে থাকেন। তবুও সুযোগ পেলে দুটো কথা বললেই যথেষ্ট। জনগণের প্রত্যাশা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সম্প্রদায় হবে মানবিক ও যত্নশীল, যা রোগী ও রোগীর আত্মীয়-স্বজনের মানসিক শক্তিকে অটুট রাখবে।

কভিড-১৯ নিয়ে আর কোনো শিথিলতা ও অনিশ্চয়তা নয়। জনগণের সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সংস্কৃতি এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রো-একটিভ ভূমিকা, গতিশীল নেতৃত্ব, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন কর্মসূচি এবং দৃঢ় মনোবলই পারবে করোনার আগ্রাসনকে রোধ করতে। 

                লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর