শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার সময় ডেঙ্গু ও আমাদের করণীয়

ডা. অভিষেক ভদ্র

করোনার সময় ডেঙ্গু ও আমাদের করণীয়

আচ্ছা, কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে, ভাইরাসের কি জীবন আছে? ভাইরাস কি চলতে-ফিরতে পারে? আপনি হয়তো অবাক হবেন, যদি বলা হয় ভাইরাস প্রাণহীন তার নিজের চলাচলের কোনো ক্ষমতা নেই! হ্যাঁ, এটাই সত্য! ভাইরাসে জীবকোষে প্রবেশ করতে না পারলে, ভাইরাস না পারে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে, না পারে রোগের সৃষ্টি করতে! তখন জড়বস্তু আর ভাইরাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আর নির্জীব অবস্থায় থাকতে থাকতে নির্দিষ্ট সময় পর ভাইরাস ধ্বংস হয়। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর জন্য এখন বড় হুমকি করোনাভাইরাস। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো যে কোনো সময় ছোবল দিতে পারে ডেঙ্গু ভাইরাস। সারা দেশের মানুষ বিশেষ করে চিকিৎসা সেবা কর্মীরা অন্তত ভোলেনি ২০১৯ সালে আমাদের বিভীষিকার নাম ছিল ডেঙ্গু। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, করোনা এবং ডেঙ্গু দুটোই কিন্তু ভাইরাস! অর্থাৎ আমাদের বর্তমানে দুশ্চিন্তার কারণ ‘প্রাণহীন’ দুটো ভাইরাস! ডেঙ্গু ছড়ায় স্ত্রী এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে আর করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে। ভাইরাস দুটি শরীরে প্রবেশের ফলে শুরুতে প্রায় একই ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত তীব্র জ্বর (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে), সঙ্গে সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি, মাংসপেশি, মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে এত তীব্র ব্যথা হয় যে, মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বরের পাশাপাশি হওয়ায় শরীরজুড়ে লালচে দানা বা ঘামাচির মতো, স্কিন র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। সাধারণত এ জ্বরের ধরন এমন হলেও, অনেক সময় এসব উপসর্গ দেখা যায় না, শুধু হালকা ৩-৪ দিনের জ্বরে সরাসরি হেমোরেজিক ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের মতো মারাত্মক জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। করোনা হলেই যেমন সব মানুষ মারা যায় না, তেমনি ডেঙ্গু হলেই সব মানুষ মারা যাবে না- এ কথা সত্য। তবে যেসব রোগীর শরীরে এসব রোগের জটিলতা তৈরি হয়, তাদের নিয়ে যে যমে-মানুষে টানাটানি হবে সেটাও অবধারিত। আমাদের আরও একটা-দুটো বিষয় খুব ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে, ভাইরাসজনিত এ দুটো রোগের কোনোটিরই সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর কোনো ওষুধ নেই। আবার এদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। সুতরাং সতর্কতার সঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই একমাত্র উপায়।

করোনা প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হচ্ছে মানুষের নাক ও মুখ নিঃসরিত ড্রপলেট বা জলীয় কণা যেন কোনোভাবেই সুস্থ মানুষের নাক-মুখ-চোখ দিয়ে প্রবেশ না করে। এ জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান-পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়া এবং মাস্ক ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা প্রতিরোধের মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয় এবং মশার শরীরে ভাইরাসটির বিস্তার লাভ করে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস মশা, সাধারণত শহুরে অভিজাত এলাকায় দালান কোঠায় বাস করে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানিতে নয়, বরং স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার করা যেমন জরুরি তেমনি একই সঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সতর্কতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সতর্কতার অংশ হিসেবে মনে রাখতে হবে, এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাতে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট, মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। বাচ্চাদের বাড়ি বা স্কুলে হাফপ্যান্টের পরিবর্তে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরাতে হবে।

বসতবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যেহেতু এডিস মশা মূলত স্বচ্ছ পানিতে জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, বাড়িঘরে এবং আশপাশে যে কোনো পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি ২ থেকে ৩ দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মারা যায়। পাত্রটি ঘষে পরিষ্কার করলে, পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারিত হয়। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। অ্যাকুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির ছাদে অনেককে বাগান করতে দেখা যায়, সেখানে টবে বা পাত্রে যেন জমা পানি ৫ দিনের বেশি না থাকে, সেদিকেও যতœবান হতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

বসতবাড়ির বাইরে মশার বংশ বিস্তার রোধের কাজের দায়িত্ব প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে এখন থেকেই দৃষ্টি দিতে হবে। ঘরের বাইরে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পানি জমতে পারে। যেমন ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/চিপসের প্যাকেট। এসব জায়গায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। মশা নিধনের জন্য ¯েপ্র বা ফগিং করতে হবে। বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলোতেও যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যাপারে যতœবান হতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ডেঙ্গু হোক বা করোনা-প্রতিরোধের লাগাম কিন্তু আমার হাতে, আমাদের হাতে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিক সদিচ্ছার। সব সময় আঙ্গুল অন্যের দিকে না তুলে, আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের করণীয়টুকু করি, নিজে বিবেকবান হয়ে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করি, তবে শুধু ডেঙ্গু বা করোনা নয়, সামাজিক জীবনের যে কোনো বাধা, অসংগতি সবাই মিলে অতিক্রম করা সম্ভব।            

লেখক : শিক্ষক, পপুলার মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর