শনিবার, ২০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

অপ্রদর্শিত অর্থ ও সম্পদের বৈধতার আইন বাস্তবায়নে অন্তরায়

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু

অপ্রদর্শিত অর্থ ও সম্পদের বৈধতার আইন বাস্তবায়নে অন্তরায়

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশে সামরিকতন্ত্রের অধীনে বেসামরিক সরকার গঠিত হয় ২০০৭ সালে। এ অস্বাভাবিক সরকার ১/১১ সরকার নামে জনগণ কর্র্তৃক অভিহিত হয়। উক্ত কথিত দুর্নীতিমুক্ত সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ/সম্পদ সাদা করার সুযোগ দিয়ে আইন প্রণয়ন করে। পরে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত একটি ট্রাইব্যুনালের (Truth Commision আইনের অধীন) উপস্থিতি হয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ ও সম্পদসমূহ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা দিলে উক্ত ট্রাইব্যুনাল স্বীয় বিবেচনায় অর্থদন্ড জরিমানার হার নির্ধারণ করে রায় দিলে তা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে মুক্তি পেতেন ঘোষণা প্রদানকারী নাগরিকরা। এভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও দিয়েছিল ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার আগে বিএনপি সরকারও একই রকম আইনের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয় NBR কর আইনে। পরে আওয়ামী লীগ সরকারও ওই আইনের ধারাবাহিকতা বহাল রাখে। গত ১-৬-২০১৯ তারিখে ঘোষিত বাজেটে কিছু সংযোজন, বিয়োজন ও পরিধি বৃদ্ধি করে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে উক্ত অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ, ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পাচার রোধ, সন্ত্রাসী অর্থায়ন রোধ প্রভৃতি। এ নিয়ে সীমাহীন বিতর্ক চলছে। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ যে মসৃণ নয় তা হয়তো অনেকেই জানেন না বা যারা জানেন তারা এ আইনের সুযোগ নিতে শঙ্কা ও জটিলতা অনুভব করবেন। কেন এ শঙ্কা বা জটিলতা সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া এবং আইনের মানদন্ডকে বাস্তবসম্মত করার উদ্দেশ্যে আমার এ লেখার অবতারণা।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র কর্র্তৃক আইন প্রণয়ন করা হয়। সরকার আইনের ওপর ভিত্তি করেই সরকার পরিচালনা করে। এ আইন দেশের সব নাগরিকের অবশ্যপালনীয়। কেননা সংবিধান সব আইনের উৎস। দুদকের ২০১৩ সালের ৬০ নম্বর সংশোধনী আইনের ২ (ক) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে- আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা বলা থাকুক না কেন এই আইনের বিধিমালা সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্য পাইবে। অর্থাৎ Supremecy of A.C.C  Law  কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে অবৈধ সম্পদ ও অর্থ সম্পর্কে ঘোষণা দিয়ে আবেদন করলে কমিশন তা বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণের পর আর্থিক জরিমানার দন্ড দিয়ে রায় ঘোষণার মাধ্যমে আবেদন নিষ্পত্তি করলে দন্ডিত ব্যক্তি উক্ত পরিমাণ জরিমানার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে মুক্তি পেতেন। আইনের ভাষায় এ জরিমানা অবশ্যই অপরাধের জন্য দন্ড/শাস্তি। এভাবে প্রচুর আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। সরকারি কোষাগার জমাকৃত উক্ত পরিমাণ টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে চলে আসে এবং রাষ্ট্র কিঞ্চিত হলেও উপকৃত হয়। বর্তমান বাজেটে ১০% কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনার পর স্তরভেদে নির্ধারিত হারে কর দিলে NBR টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না মর্মে উল্লেখ আছে। তা ছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থের বিপরীতে কর প্রদানের পর উক্ত অর্থ শিল্প খাত বিনিয়োগ/অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে NBR-এর টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করবে না বা কর ফাঁকির দায়ে অভিযুক্ত করবে না। উপরোক্ত সুযোগসমূহ ১৫-২০ বছর যাবৎ প্রচলিত থাকলেও এবারের বাজেট ঘোষণার পর দেশ রসাতলে গেল বলে উন্মাদের মতো বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা সত্য যে, এ সুযোগ অনেকেই গ্রহণ করা থেকে বিরত আছেন। অপ্রদর্শিত অর্থে ফ্ল্যাট/বাড়ির বিপরীতে কর আদায়ের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। Terrorist Financing, Money Laundering সহ বিভিন্ন দুষ্কর্মে যেন এ কালো টাকার ব্যবহার না হয় সেজন্যই এ উদ্যোগ এবং এ কারণেই এবারের বাজেটের পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের এ স্বচ্ছ ও শুভচিন্তা ঋরহধহপরধষ ও Financial I Tax Management-এর অবাস্তব I unrealistic system-এর কারণে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যায় না। আইনের মানদন্ড থাকবে সবার জন্য সমান। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে সুশাসনের জন্য। কিন্তু রাষ্ট্র প্রণীত আইনের সুযোগ গ্রহণ করে কেউ যদি প্রতারিত হন তবে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সরকারের সদিচ্ছা পূর্ণতা পেতে বাধ্য। প্রয়োজন প্রণীত আইনসমূহের সামঞ্জস্যতা। নাগরিকরা রাষ্ট্রে প্রণীত আইনের প্রতি দৃঢ় আস্থা রেখে সে আইনের সুযোগ নেওয়ার পর যদি পরে নাজেহাল হন তবে রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে।

সমসাময়িক সময়ে নাগরিকদের আর্তচিৎকার আমার আইন পেশায় থাকার কারণে গোচরীভূত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যক্তিরা অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে জমি, ফ্ল্যাট খরিদ করেছেন এবং নিয়ম অনুযায়ী কর দিয়ে উক্ত অর্থ সাদা করেছেন তাদের অর্থ ও সম্পদ সম্পর্কে  NBR কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না মর্মে তারা আইন দ্বারা অঙ্গীকারবদ্ধ। Truth Commission-এ অবৈধ সম্পদ ও অর্থের ঘোষণা দিয়ে মাননীয় বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত Tribunal-এর রায়ে আর্থিক জরিমানা দিয়েছেন, তাদের আর্তচিৎকারকে নিন্দা করা হচ্ছে। আপাত বলবৎ সব আইনের ওপর দুদক আইনের প্রাধান্য থাকায়, দুদক ওইসব নাগরিকের অর্থ ও সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার রাখে। শুধু এ কারণে NBR-এর দায়মুক্তির ঘোষণা কার্যকর হয় না। আইন হয়, কিন্তু নাগরিক দুদক আইনের আতঙ্কের কারণে ওই কর অবকাশের সুযোগ নেয় না। সুযোগ নিলেই সে তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে।

সৎ উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করে সরকারের উদ্দেশ্য যদি সফল না হয় তবে সে আইনের কি কোনো প্রয়োজন আছে? এ ধরনের অসামঞ্জস্যতা, স্ববিরোধী আইন জনগণকে বিভ্রান্ত করে। সমালোচনা হয় কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রণিধানযোগ্য উন্নতি হয় না। সংবিধান আইন প্রণয়নের সূত্র বা ভিত্তি, যেখানে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে দেশে সুশাসন হয় প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্র প্রণীত এক আইনে পরিত্রাণ পাবে, আবার একটা রাষ্ট্রের প্রণীত অন্য সংস্থার আইনে দন্ডযোগের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত থাকবে কেন? এটা সভ্যতা ও ন্যায়ানুগ আইনের ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরিপন্থী। সংবিধানের ৩৫(২) ধারা অনুযায়ী একই অপরাধ/দুষ্কর্ম (যা Criminal হোক বা Civil হোক) দুবার বিচার বা দন্ড প্রদান করা যায় না। General Clause Act-এ বর্ণিত Res judicata-এর নীতির ও পরিপন্থী। গত ২০ বছর ধরে ভিন্ন ভিন্ন নীতি ধারণকারী সরকারও অহেতুক বিতর্কে কর্ণপাত না করে এর ধারাবাহিকতা বহাল রেখেছেন। সরকার ও জনগণের স্বার্থে পাচার রোধ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল স্রোতে এ অর্থকে বহমান রাখাই হলো বর্তমান সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য। জননেত্রী শেখ হাসিনার এ মহৎ চিন্তা ও নেতৃত্বের কারণেই আজ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পরিচিত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। এ সরকারের উচিত উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনার প্রতি নতজানু না হয়ে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য স্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। দুদক আইনের প্রাধান্য ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও সরলীকরণের উদ্দেশ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেটে এ ত্রুটিসমূহ সংশোধন করা প্রয়োজন। নাগরিকের জন্য আইন প্রণয়ন করলে আইনের আশ্রয় দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। Sovereign Guarantee/ Indemnity-এর মাধ্যমে বাজেটে ঘোষিত এ আইন/বিধিকে জটিলতামুক্ত করলে কর আদায়ে আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া যেতে পারে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক দুুদক কমিশনার। সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

 

সর্বশেষ খবর