মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যু মিছিলের শেষ কোথায়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম


মৃত্যু মিছিলের শেষ কোথায়

২৫ জুন আমাদের বিবাহবার্ষিকী। পালন করি না বা কোনো অনুষ্ঠান করি না। তাই বলে দিনটিকে ভুলি না। সেদিন নঈম নিজাম লিখেছেন, রাজনীতিকদের বড় সুবিধা তারা কিছু মনে রাখেন না, সব ভুলে যান। আমার দোষ না গুণ কিছুই ভুলতে পারি না। এক যুগ আগে কেউ যদি এক গ্লাস পানি খাইয়ে থাকেন তাও ভুলতে পারি না। আর জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন ভুলব, তা কি হয়? কখনো না।

জন্মের পর মৃত্যু এক চরম সত্য। এর চেয়ে নিশ্চিত সত্য আর কিছু নেই। মৃত্যুর স্বাদ সব জীবকে গ্রহণ করতে হবে। এ বিশ্বব্রহ্মান্ডে যার প্রাণ আছে তার মৃত্যু আছে। মৃত্যু নিয়ে বেদনাহত হওয়া, খুব বেশি চিন্তিত হওয়া কোনো প্রকৃত ইমানদারের কাজ নয়। তবু কোনো কোনো মৃত্যু বড় বেশি বুকে বাধে, ক্ষত-বিক্ষত-তোলপাড় করে। আজ চার মাস কীভাবে ঘরে আছি বলার নেই। বসে বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়ে যায়। আমরা মানুষের কাছে প্রিয় ছিলাম, প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু বসে খাওয়ার মতো অবস্থায় আসিনি। তার পরও হাত-পা গুটিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছি। এ চার মাসে তিন-চার বার ঢাকা-টাঙ্গাইল যাওয়া-আসা করেছি, বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে গ্রামের বাড়ি যাওয়া- এই যা ঘরের বাইরে। যে কবার ঢাকা গেছি ঘর থেকে গাড়িতে, ঢাকা পৌঁছে গোসল-আসল করে অন্যদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, কথা বলা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল এসেও তাই। ঘরের বাইরে গাড়ির চালকসহ চারজন। গত সংখ্যায় লিখেছিলাম, জনাব মোহাম্মদ নাসিম এবং শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে নিয়ে আলোচনা করব। যে যায় সে তো আর আসে না। তাকে নিয়ে আমাদের স্মৃতি তর্পণ তা তো কিছুটা ভারমুক্ত হওয়া। কী বলি, মৃত্যু মিছিলের যেন শেষ নেই। সকালে জনাব মোহাম্মদ নাসিম, বিকালে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, একদিন বা দুই দিন যেতে না যেতেই সিলেটের প্রিয় মানুষ আমার স্নেহের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। হঠাৎই শুনলাম, আমার অত্যন্ত প্রিয় মাহমুদ হোসেন আলমজীদি শীষের মৃত্যুসংবাদ। এমনি আরও কত মৃত্যুর মিছিল বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এর মধ্যেও এক মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে কিনা, পদে পদে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা; তাও আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়। এ কোনো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র কিনা ঠাওর করতে পারছি না। কদিন আগে কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সঙ্গে প্রায় সমপরিমাণ বিজিবি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কাদেরিয়া বাহিনীর শদেড়েক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়েছিল কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার অধিকাংশ বিডিআরে এবং কিছুসংখ্যক সেনাবাহিনীতে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদেরই এখন বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সেদিন মলিনমুখে শেখ হাবিবকে দেখলাম। ৫-৬ ফুট দূরে বসিয়ে আমার সঙ্গেই খাইয়ে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার, কী দরকার? বলল, কথা আছে। আলাদা দূরে গিয়ে বসতেই বলল, ‘স্যার! মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম নেই।’ কী বল! আমি বিস্মিত- হাবিব মুক্তিযোদ্ধা নয়! শেখ হাবিবের সঙ্গে রাজনীতির মিল না থাকতে পারে, কিন্তু সে যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাতে কোনো অমিল নেই। হাবিব যদি মুক্তিযোদ্ধা না হয় তাহলে কে মুক্তিযোদ্ধা? শওকত মোমেন শাজাহান, আবু হানিফ আজাদ, মোতালেব গুরখা, আমজাদ মাস্টার, সখীপুর উপজেলা কমান্ডার ওসমান গনি? এদের কারও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ নেই। একেবারে সেই শুরু থেকে শেখ হাবিব কাদেরিয়া বাহিনীতে অংশ নিয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ৪০-৪২ বছর আগে ‘স্বাধীনতা ’৭১’-এ শেখ হাবিবের নাম রয়েছে। বর্গাতে রতনগঞ্জের সান্দার ফজলুকে আটকে যেভাবে জেরা করে জেরবার করছিল সেটা লেখার চেষ্টা করেছি। আমার সে রকম লেখার কলাকৌশল জানা নেই বলে রংচং মেখে তিলকে তাল করে তেমন ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু সে যে মুক্তিযোদ্ধা, তার যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল তা উঠে এসেছে। লালমোহন আর বীরেন বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরও আমার বাবর রোডের বাড়িতে ছিল। সেই মহানন্দপুর হেডকোয়ার্টারে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে ছাড়েনি। বীরেনের নাম তালিকায় আছে কিন্তু লালমোহনের নেই। কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কটা যুদ্ধ করেছেন, কটা গুলি খরচ করেছেন, কজন হানাদার মেরেছেন, অস্ত্র কোথায় জমা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ফরমে এসব তথ্য দিতে দিতে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা জেরবার। আমরা তো বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র দিয়েছি। পিতার কাছ থেকে তো লিখে রাখতে পারিনি। হতেয়ার নয়ন হাজীর বাড়িতে প্রায় ছয় মাস মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প ছিল। যেদিন তার বাড়িতে ক্যাম্প করা হয় সেদিন থেকে অন্য যোদ্ধারা যা করেছে সে তার থেকে কম করেনি, বরং বেশি করেছে। কিন্তু সরকারি তালিকায় তার নাম নেই। যাচাই-বাছাই করে ঢাকা পাঠানোর পরও সে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়নি। ঘাটাইলের উপলদিয়ার নুরু মিয়া। যে না থাকলে আমি হয়তো বাঁচতাম না, তার ছোট ভাই বজলু শহীদ হয়েছে। সেই নুরু মিয়ার নাম নেই। ’৯০-এ দেশে ফিরলে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ছুটে এসেছিল। তাদের তালিকায় নাম নেই। আমিও তালিকা করেছিলাম। ১৮ হাজার যোদ্ধার প্রায় ১০ হাজারই সরকারি তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। কারণ আমি ছিলাম বৈরী, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী, সব সরকারের বিরোধী। তবে এখন যারা কর্তৃত্বে নেতৃত্বে আছেন তাদের বলি হারি যাই, মুক্তিযোদ্ধা তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাদ দিয়ে পছন্দের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বনাশ করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সর্বনাশ করা খুব একটা কাজের কথা নয়। ৭০-৮০ জনের টাঙ্গাইল মুজিব বাহিনী, স্বাধীনতার পর আমাকে ঘায়েল করার জন্য বাতেন বাহিনী করা হয়েছিল। তারা বেছে বেছে আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযোদ্ধা মারল। এই অতিসম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাতেন বাহিনীর জন্য যেখানে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় এটাওটা করেছে, মনুমেন্ট করেছে। কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতিতে একটি ফুটো পয়সাও বরাদ্দ করেনি। তার মধ্যে বহেরাতলী স্মৃতিসৌধ।

বহেরাতলী স্মৃতিসৌধ নিয়ে মাদারীর খেলের শেষ নেই। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ৩১ ডিসেম্বর, ’৯৬ স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা ছিল। নানা ষড়যন্ত্রে তিনি আসেননি অথবা আসতে পারেননি। পরের বছর ডিসেম্বরে স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন এবং সেইমতে কিছু কাজও হয়েছিল। সেখানে এখন ভূমি অফিস হচ্ছে। স্থানীয় জনসাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করলে সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, রেকর্ডে খাসজমি তাই তারা ওখানে ভূমি অফিসের প্রস্তাব করেছেন। সেইমতে টেন্ডার পাস হয়ে কাজ শুরু হয়েছে। কীসের রেকর্ড? ’৬২ সালের রেকর্ড। ’৬২ সালে তো পাকিস্তান ছিল, অফিসার হয়েছেন বাংলাদেশের।  তবে এ কথা বলাই চলে, যারা ’৬২ সালের রেকর্ড নিয়ে পড়ে থাকেন তাদের পাকিস্তানে যাওয়া উচিত, বাংলাদেশে নয়।

গত সংখ্যায় লিখেছিলাম মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে লিখব। মনে হয় তা আর হলো না। মৃত্যুর যে লম্বা মিছিল, কাকে রেখে কাকে লিখি। সকালে আর বিকালে একজন প্রাক্তন আরেকজন বর্তমান মন্ত্রী চলে গেলেন। একজন মোহাম্মদ নাসিম, আরেকজন শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। রাত না পোহাতেই সিলেটের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান চলে গেলেন। আমার বড় প্রিয় ছিলেন। কত সময় কত জায়গায় দেখা হয়েছে। বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলে। শ্বশুরবাড়ির টেলিফোন সংযোগের জন্য বলেছিলেন। তখন সবাই সম্মান করত কথা শুনত। এ দেশের এক ভালো মানুষ, সেরা মানুষ কামাল লোহানী চলে গেলেন। যদিও কামাল লোহানী পরিপূর্ণ বয়সেই গেলেন। তবু এ করোনার সময় এ দুর্যোগের সময় তাঁর চলে যাওয়া অবশ্যই বুকে বাধে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া আমার কাছে খুবই প্রিয়। একে তো প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নানাবাড়ি। বাবার বাড়ি বাসাইলের সুন্ন্যা। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আবদুল জলিল নামে উল্লাপাড়া কলেজের জিএস কাদেরিয়া বাহিনীর অন্যতম এক কৃতী যোদ্ধা। বিআইডব্লিউটিএতে চাকরি করত। বছর দশেক হলো অবসরে গেছে। এ ছাড়ও লতিফ মীর্জার বাড়ি উল্লাপাড়ার লাহিনীমোহনপুর। লতিফ মীর্জার বাড়ি যেতে রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জ এসে লাহিনীমোহনপুর যাওয়ার জন্য লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে প্রায় সবাই বলছিল, ‘ও, আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জাসদের লতিফ মীর্জা?’ পরে লতিফ মীর্জার নাম হয়েছিল জাসদের লতিফ মীর্জা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। উল্লাপাড়ায় কামাল লোহানীকে কবর দেওয়া হয়েছে। কামাল লোহানী দীর্ঘজীবনে সাংস্কৃতিক জগতে বিরাট অবদান রেখেছেন। বছর পাঁচ-ছয় আগে ‘আমাদের সময়ের’ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সম্মেলনকক্ষে অনেকের সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এলে অনুষ্ঠান শুরু হবে। হঠাৎই দেখলাম কামাল লোহানী এসেছেন। আমি যে চেয়ারটায় বসে ছিলাম, সে চেয়ারটা তাঁকে ছেড়ে দিলে কিছুতেই বসতে চাচ্ছিলেন না। বারবার বলছিলেন, ‘আপনার বসে থাকা চেয়ারে বসব, এ কী করে সম্ভব! আপনি আমার হৃদয়ের মানুষ। আপনি দেশ স্বাধীন করেছেন। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর লোক, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। আমাদের সবার সকালবিকাল আছে। কিন্তু আপনার তা নেই। আমরা কেউ আপনার মতো হতে পারিনি। আপনার চেয়ার স্পর্শ করে ধন্য হওয়া যায়, আপনার চেয়ারে বসা যায় না। না, না, এ হয় না।’ বলেছিলাম, বসুন। আপনাকে এবং আপনার বয়সকে লেহাজ করছি। এক দিনের হলেও আপনি আমার থেকে বয়সে বড়। সে বয়সকে সম্মান করছি। সে সময় আমার মনে হয়েছিল স্বাধীনতার পর যখনই বড় ভাইয়ের কাছে গেছি তখনই তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। মন্ত্রী থাকতে তার অফিসে চার-পাঁচ বার গেছি। একবার সালমান এফ রহমান ছিলেন। আমি যেতে বড় ভাই উঠে দাঁড়ানোয় সালমান এফ রহমান বলেছিলেন, ‘কাদের ভাই আপনার ছোট। তার পরও তাকে দেখে আপনি উঠে দাঁড়ান!’ লতিফ ভাই বলেছিলেন, ‘আমি বজ্রকে দেখে দাঁড়াই না। আমি একজন মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সেনাপতিকে দেখে দাঁড়াই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে দাঁড়াই। শুধু আমি না, এটা সবার করা উচিত।’ কামাল লোহানী সেদিন আমার চেয়ারে বসেছিলেন। আমি তাঁর পাশে বসেছিলাম। যখন যেখানে দেখা হয়েছে কি অমায়িক ব্যবহার করেছেন, কত গুরুত্ব দিয়েছেন সে মানুষটা চলে গেলেন জানাজায় পর্যন্ত যেতে পারলাম না। দুঃখ রাখি কোথায়। আমার এক প্রিয় কর্মী রুবেল আহমেদ করোনায় আক্রান্ত হয়ে সৌদি আরবে মারা গেছে। দেশে থাকতে সপ্তাহে দু-তিন বার আসত। হঠাৎ সেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের নেতা ইকবাল সিদ্দিকীর একনিষ্ঠ কর্মী অনীক মারা গেল। কয়েক বছর আমাদের কত যে ছবি তুলেছে তার ইয়ত্তা নেই। সে দিনাজপুরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সেদিন মারা গেছে আমার প্রিয় কর্মী ’৯০-এ দেশে ফেরার পর ছায়াসঙ্গী কামাল আহমেদের সম্বন্ধী ইসমাইল। এক অসাধারণ মানুষ ছিল। ইসমাইলের বাবা বছর দশেক আগে হজ করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। পবিত্র হজ পালনের সময় ইসমাইলের বাবা মো. ইদু মিয়া মারা যাওয়ায় কষ্ট পাওয়ার চাইতে তার পরিবার শান্তিই পেয়েছিল বেশি। ইসমাইলের মা পরী বানু এক অসাধারণ মানুষ। ওদের ৩৪২ বি খিলগাঁওয়ের বাড়িতে অনেকবার গেছি। শামীমা আক্তার ছায়াকে কামাল বিয়ে করেছে। তা ছাড়া মো. ইসহাক সোনার বাংলায় বহুদিন কাজ করেছে। ’৮৮-এর পরে ঢাকায় এক বন্যায় ওদের চলাফেরার জন্য আমার স্পিডবোট পাঠিয়ে ছিলাম। তাতে ওদের অনেক উপকার হয়েছিল। সেই ভর বন্যায় হাঁটুপানি ভেঙে ওদের বাড়িতে একবার খেয়েছিলাম। সেদিন ওদের বোন মনোয়ারা, আনোয়ারা, সালমা, শামীমা আক্তার ছায়া, ইয়াসিন, ইসমাইল, ইসহাক, ইসরাফিল সবাই ছিল। সেই প্রিয় ইসমাইলও চলে গেল। কার কথা বলি। বাসাইলের মাহমুদ হোসেন আলমজীদি শীষ হঠাৎ চলে গেছে। শীষের বাবা লেবু মিয়া ২০-২২ বছর বাসাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর বাড়িতে থেকে অষ্টগ্রামের মাসুদুল হক হায়দারী মণি লেখাপড়া করত। তাঁর এক বোনের লেবু মিয়ার ছেলে শামসুল আলম আলমজীদির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সে সুবাদে বাসাইল এসে করটিয়া সা’দত কলেজে লেখাপড়া। এখন তো কত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু পাকিস্তান আমলে তেমন ছিল না। মেয়েদের একমাত্র কলেজ ছিল টাঙ্গাইল কুমুদিনী। সা’দত কলেজ একমাত্র কলেজ ছিল না। সারা দেশে ১৫-২০টা কলেজের মধ্যে সা’দত কলেজ একটি বিখ্যাত কলেজ। এক বাড়িতে দুই বোনের বিয়ে হয়। শামসু ভাইয়ের স্ত্রী সুফিয়া আক্তার আর শীষের স্ত্রী জেসমিন আক্তার। আমি যখন সা’দত কলেজে পড়তাম তখন ওদের সব থেকে ছোট ভাই মাহবুবুল হক হায়দারী দুলু পড়ত। দুলু মনে হয় ’৭০ বা ’৭১-এ ভর্তি হয়েছিল। শীষের দুই ছেলে ওয়াহিদুল আলম ও তানভীর হোসেন আলমজীদি। ওরা দুজনেই মামা বলে অজ্ঞান। ওয়াহিদুল হক ডাক্তারি পাস করে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ইন্টার্নি করতে চেয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে আমার কাছে এসেছিল। আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। পরিচালককে বলতেই অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে সে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ওয়াহিদুল হককে ইন্টার্নির সুযোগ দিয়েছিলেন। পরিবারটির সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার সম্পর্ক ছিল। বড় কষ্ট লাগছে শীষের মৃত্যুসংবাদে। আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুন, সেই সঙ্গে অন্য সবাইকে।

তাই কাকে রেখে কাকে নিয়ে লিখি। প্রাক্তন মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এক অসাধারণ মানুষ।  ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে সারা জীবন ভাই বলে ডেকেছি। যদিও তিনি আমায় সন্তানের মতো ¯েœহ করতেন, ভালোবাসতেন, অসাধারণ গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু ডাকতাম ভাই বলে। মোহাম্মদ নাসিমও ভাই। রাজনীতিতে মনে হয় সাত পুরুষের সম্পর্ক ভাই ভাই।  শেখ ফজলুল হক মণি অনেক বলেকয়ে স্বাধীনতার পর আমাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রেসিডিয়ামের সদস্য করেছিলেন। সেই আওয়ামী যুবলীগে মোহাম্মদ নাসিমও ছিলেন। তাই প্রতিনিয়ত দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কথাবার্তা হতো। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতা কারাগারে নিহত হলে মোহাম্মদ নাসিম ভারতে গিয়েছিলেন। সেখানে নিদারুণ কষ্টের জীবন যাপন করেছেন। তারপর একসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে আসেন। আমি ’৯০-এ দেশে ফিরলে আবার আমরা একসঙ্গে চলতে শুরু করি। একসঙ্গে আওয়ামী লীগ করি। আজকাল অনেকেই ভাবছেন তারাই সব, তারাই শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে এনেছেন। তা মোটেই নয়। সেখানে আবদুল জলিলের ভূমিকা, তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা, আমির হোসেন আমুর ভূমিকা, মোহাম্মদ নাসিমের অবদান কচুপাতার পানির মতো ফেলে দেওয়ার নয়। মোহাম্মদ নাসিমের কাজীপুরে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক বিশাল সভা করেছিলেন। তার কয়েক দিন পর মোহাম্মদ নাসিম আমার বাড়িতে ছুটে আসেন, ‘ভাই! কাজীপুরে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মিটিংয়ের পর একটা বড় মাপের মিটিং করতে না পারলে মান থাকে না।’ বলেছিলাম, আমার মতো মানুষ নিয়ে বড় মিটিং! গিয়েছিলাম। তার কাজীপুরে যাওয়ার আগে সীমান্ত নামে একটি জায়গায় তখনো ফেরি ছিল। সেটা পাড় হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিই অসাধারণ সভা হয়েছিল।

লেখক : রাজনীতিক।

 

 

সর্বশেষ খবর