মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যিনি সবার স্যার

মযহারুল ইসলাম বাবলা

যিনি সবার স্যার

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সবারই তিনি স্যার। তাঁকে সবাই স্যার বলেই সম্বোধন করেন। সমসাময়িকদের কাছে সিরাজ সাহেব। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছিলাম সাংবাদিক-সাহিত্যিক ফয়েজ আহ্মদ, যিনি স্যারকে নাম ধরে এবং তুমি সম্বোধনে ডাকতেন। ফয়েজ ভাইয়ের মতো হয়তো অনেকে ছিলেন কিন্তু আমার দেখা কেবল ফয়েজ ভাইকেই।

স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়-সংশ্লিষ্টতা কত দিনের? ভেবে আমিও বিস্মিত। প্রায় ৪৩ বছরের। ভাবা যায়। সেই ১৯৭৭ সালে স্যারের স্ত্রী প্রয়াত ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী রচিত নাটক ‘আলোটা জ্বালো’ ঢাকা শিশু নাট্যম প্রযোজনা করেছিল। শিশু নাট্যমের সংগঠকরূপে সেই থেকে পরিচয়-আলাপচারিতা এবং ক্রমেই ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ। তবে স্যারের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল আরও আগে। স্যার এবং নাজমা আপার সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থনে ১৯৭৮ সালে গঠিত হয়েছিল ঢাকা লিট্ল থিয়েটার। নাজমা আপা এবং স্যারকে কেন্দ্র করেই বলা যায় সংগঠনটির সার্থক পথচলা সম্ভব হয়েছিল। অসংখ্য শিশু-কিশোর, অভিভাবক ও সংগঠকের সরব উপস্থিতিতে তাঁদের আবাসটি পরিণত হয়েছিল সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র রূপে। ১৯৮৯-এর ১২ সেপ্টেম্বর দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত নাজমা আপা অসময়ে চলে গেলেন। আমরা বঞ্চিত হলাম তাঁর মাতৃস্নেহ থেকে। নাজমা আপার অবর্তমানে তাঁদের দুই মেয়ে রওনক আরা চৌধুরী খুকু ও শারমীন চৌধুরী শিউলী স্যারকে আজ পর্যন্ত আগলে রেখেছেন। স্যারের পারিবারিক বৃত্তটি এ দুই মেয়েকে নিয়েই।

পেশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় শিক্ষক। সত্য এই যে, স্যারের শিক্ষার্থী কেবল ইংরেজি বিভাগে সীমাবদ্ধ কখনো ছিল না। স্যারের সীমা দেশ-বিদেশ জুড়ে বিস্তৃত। ২০০২ সালে অবসর গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক এবং পরে ইমেরিটাস অধ্যাপক। প্রখর চিন্তাশীল লেখার মাধ্যমে স্যার জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। প্রবন্ধ সাহিত্যের মতো বিরস সাহিত্যও যে জনপ্রিয় সুখপাঠ্য হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত স্যারের অসামান্য রচনাসমূহ। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১০০। তাঁর বিশ্লেষণ-গবেষণা সমৃদ্ধ প্রবন্ধে সাহিত্যের উপাদান প্রবন্ধ সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তাঁর গ্রন্থপাঠে পাঠক কেবল জ্ঞানে ঋদ্ধ নয়, অসাম্য-অনাচারের বিদ্যমান ব্যবস্থা ভাঙার অনুপ্রেরণাও লাভ করে। তাঁর প্রতিটি রচনায় পাওয়া যায় ব্যবস্থা বদলের পথের দিশা। ইতিহাস, সমাজ, আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন, দেশি-বিদেশি সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি কোনোটির অনুপস্থিতি নেই। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যন্ত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করে ঘৃণিত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পথও অকপটে প্রকাশ করে থাকেন। তাঁর বক্তৃতা, বক্তব্য, লেখনীতে সমাজ বিপ্লবের আকাক্সক্ষা এবং পথটির নির্দেশনা দিতে ভুল করেন না। আমাদের সমাজে জ্ঞানী-প-িতের অভাব নেই। প-িত ব্যক্তি নিশ্চয় আছেন। তবে মতাদর্শে অবিচল দ্বিতীয় জনকে খুঁজে পেতে কষ্টই হবে। তাঁর রচিত প্রবন্ধে নিখুঁত চুলচেরা বিশ্লেষণে পাঠকের মনোজগৎকে কেবল বিকশিত নয়, শানিতও করে। সে কারণে স্যারের পাঠকের সংখ্যা ঈর্ষণীয়। কোনো ব্যক্তির পক্ষে সুদীর্ঘকাল আদর্শে অবিচল থাকার নজির আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই। আদর্শে অবিচল ব্যক্তির আকাল চলছে দেশজুড়ে। স্যারের মতো মতাদর্শে অবিচল ব্যক্তি আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ। পার্থিব প্রলোভন, লোভ-লালসা এড়িয়ে চলা এক অনন্য দৃষ্টান্ত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

১৯৮১ সালে ক’বছরের জন্য আমি বিদেশে ছিলাম। তবে নাজমা আপার সঙ্গে নিয়মিত পত্র যোগাযোগ ছিল। স্যারও নিজের বই প্রকাশিত হলে আমাকে পাঠাতেন। এক চিঠিতে নাজমা আপা জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটে বিজয়ী স্যারকে উপাচার্য পদে নিয়োগের জেনারেল এরশাদের প্রস্তাব তাঁরই সামনে স্যারের প্রত্যাখ্যান করার সংবাদ। মনে পড়ে, আমার উপস্থিতিতে জেনারেল জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ নিয়ে স্যারের বাসায় সস্ত্রীক এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান প্রয়াত মাহফুজুর রহমান। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রস্তাব শোনামাত্র স্যারের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখের সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে মন্ত্রিত্বের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বুকের ওপর হঠাৎ চেপে বসা পাথরটি অপসারণে যেন মুক্তিলাভ করলেন।

স্যারের পিতা চেয়েছিলেন মেধাবী বড় ছেলেটি সিএসপি হোক। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে অভিভাবক এবং মেধাবী ছাত্রদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শাসক সহযোগী আমলা হওয়া। সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দিতে মেধাবীদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। সে অভিলাষে স্যারের পিতা স্যারের হাতে সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ফরম তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যার সে ফরমটি ছিঁড়ে শাসক সহযোগী আমলা হওয়ার সনাতনী প্রতিষ্ঠার বিপরীতে শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের নানা লোভনীয় প্রস্তাব সযতেœ ফিরিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তাঁর নীতিগত অবস্থান, এরকম অসংখ্য প্রলোভনেও তাঁকে টলানো সম্ভব হয়নি।

বিগত ১৮ বছর ধরে স্যারের সম্পাদনায় সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অতিমাত্রায় পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, সচেতন সম্পাদকরূপে তাঁকে দেখে আসছি। দেশের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকট চেহারা আমরা নিত্য দেখে থাকি। সব পেশাজীবীর ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত দলীয় শৃঙ্খলে নিজেদের আবদ্ধ-সমর্পণ করেছেন, পার্থিব স্বার্থের টানে। শাসক শ্রেণির প্রধান দলে সব পেশাজীবীর মতো বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, নীতি, নৈতিকতা বন্ধক দিয়ে ফেলেছেন। সব বিবেচনায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দৃষ্টান্তে অনন্য। সারাটি জীবন রেললাইনের পথের মতো একই ছন্দে লাইন ধরে চলেছেন। কখনো লাইনচ্যুত হননি। স্যারের জন্মদিনে জানাই অভিনন্দন, বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর