বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

মানুষ বাঁচাতে চাই জাতীয় ঐক্য

খায়রুল কবীর খোকন

মানুষ বাঁচাতে চাই জাতীয় ঐক্য

কভিড-১৯ সারা বিশ্বকে এখন ‘কিয়ামত’ দেখিয়ে ছাড়ছে। বাংলাদেশে ২৩ জুন পর্যন্ত ১ লাখ ১৯ হাজার ১৯৮ সংক্রমণ সংখ্যা আর প্রাণহানি ১ হাজার ৫৪৫ ছাড়িয়েছে। সারা বিশ্বের সংক্রমণ ৮৯ লাখ ৩২ হাজার আর প্রাণহানি ৪ লাখ ৬৭ হাজার ছাড়িয়েছে ওইদিনই। ২৩ জুন পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মোট সংক্রমণ সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশে কভিড-১৯ সংক্রমণে লাশ দাফনের পরিস্থিতি খুবই বাজে, খুবই করুণ। মানবজাতির ইতিহাসে অত্যন্ত বেদনা আর নির্মমতায় ভরা এ কাহিনি।

এখন টিকে থাকতে উপায় একমাত্র আমাদের জাতীয় ঐক্য। সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য ছাড়া আর কোনো গতি নেই। ক্ষমতাবানরা যতই একলা চলো নীতি নিয়ে চলতে চান না কেন, তাদের বুঝতে হবে অকৃত্রিম দেশপ্রেমের জাতীয় ঐক্য আমাদের কভিড-১৯-বিরোধী লড়াই শক্তিশালী করতে পারে, আমাদের জাতীয়ভাবে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। আমরা তা যেন ভুলে না যাই। ক্ষমতাসীন সরকার একাই সবকিছুর কৃতিত্ব দাবি করতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, এ সরকারের ভুল নীতির ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অথর্ব ও অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক নোংরামির জন্য সমগ্র স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সার্বিক কাঠামোটি ভেঙে গেছে। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত এ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আম-জনতার জন্য সামান্য একটু চিকিৎসা পাওয়া, হাসপাতালে একটু জায়গা পাওয়ার মতো ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে না।

কভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণে ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোগ ছড়ানো ও প্রাণহানি মারাত্মক পর্যায়ে। পাশাপাশি সঠিক লকডাউন ও অন্যসব প্রাসঙ্গিক প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশে সংক্রমণ ও প্রাণহানি অনেক কম।

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে প্রথম মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে ভাইরাস। বন্যপ্রাণী বাজারের বনরুই থেকে প্রথম বেরিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করুক কিংবা অন্যভাবে মানবশরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকুক সেই ডিসেম্বর কারও কারও মতে অক্টোবরে খুদে দানব প্রথমবারের মতো মানবদেহে সংক্রমিত হয়। তা এখন বিশ্বের ৭৮০ কোটি মানুষের জন্য এক ভয়ঙ্কর ‘ট্রমা’ সৃষ্টি করেছে।

সারা দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই এখন এ ভাইরাস-দানবের কাছে পোকামাকড়ের চেয়েও অসহায়। যদিও ভাইরাসে আক্রান্ত ৫০ শতাংশের বেশি রোগী সুস্থ হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে এখনো নিশ্চিত নয় যে, এ ভাইরাস সংক্রমিত মানুষ সুস্থ হওয়ার পরে আবার সংক্রমিত হবে কিনা। অনেক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরই ধারণা, পুনরায় সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে পুরো মাত্রায়, প্রাণহানিরও আশঙ্কা আছে। তা ছাড়া স্বল্প মাত্রার সংক্রমণ যে কত লাখ লাখ, এমনকি ‘কোটি কোটি’ লোকের হয়ে গেছে তা বোঝাই মুশকিল। কারণ, এ সংক্রমণ নিরূপণের টেস্টিং ল্যাব-ফ্যাসিলিটি সারা বিশ্বেই সীমিত। নভেল করোনাভাইরাস উপসর্গ নিয়ে ল্যাব-টেস্টিং সুবিধা পেয়ে পরীক্ষা করতে পারার আগেই বহু মানুষ মারা যাচ্ছে আবার অনেকে দুর্ভোগে ভুগে সর্বস্বহারাপ্রায়। তার বেশির ভাগ সুস্থ হয়ে কভিড-১৯ নেগেটিভ হয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে আরেক কিয়ামত দেখছে, কাজকর্ম করতে গিয়ে সংকটে পড়ছে। বহু মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়ে দুর্ভোগের চরম সীমায় রয়েছেন, নীরবে কাতরাচ্ছেন সারাক্ষণ। বাড়িতে লকডাউন মানুষ, সেলফ-কোয়ারেন্টাইনের মানুষ কতটা দুরবস্থায় তা কল্পনার বাইরে।

মহাপরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় শিকার এ ভাইরাসের। সেখানে ২০ জুন অবধি প্রাণহানি ১ লাখ ২২ হাজার ছাড়িয়ে গেল, আর সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ২৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গোঁয়ার্তুমি আর মূর্র্খ-আচরণের শিকার হয়ে ভুগছে নিরীহ আমেরিকাবাসী। অবশ্য আমেরিকানদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক ‘লকডাউন’ কর্মকান্ড করার জন্য সাড়া ছিল না নাগরিকদের অসহযোগিতার কারণে, ট্রাম্প মার্কা গোঁয়ার্তুমির জন্য। মার্কিনিরাও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে নৈরাজ্যময় দশার শিকার, তা ভাবাও কঠিন।

বাংলাদেশ সরকার নিদারুণভাবে কভিড-১৯ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জানুয়ারিতেই এ ভাইরাস নিয়ে দুনিয়াব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মার্কিন গোঁয়ার-গোবিন্দ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই দায়দায়িত্বহীন অবজ্ঞা করছিল এ ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে। কর্তাদের কেউ কেউ এটাকে সাধারণ ‘ফ্লু’ বা সর্দি-জ্বর-হালকা-কাশি ইত্যাদি বলে হাসি-তামাশাও করেছে। অন্যদিকে কভিড-১৯ দানব তার সর্বগ্রাসী থাবা বিস্তার করেছে বিশ্বের ২১৩টির বেশি দেশে, কিয়ামত ঘটিয়ে ছেড়েছে মানবসমাজের ইতিহাসে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদফতর দুর্নীতির এক অভায়রণ্যে পরিণতÑ পিপিই ও অন্যসব চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে, টেস্টিং-কিট নিয়ে, হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে। ওই অধিদফতরের অধীনে চাকরি প্রদানের তথা নিয়োগবাণিজ্য ইত্যাদি দুর্নীতিতে ডুবন্ত প্রধান কর্মকর্তা নিজে নানা ফন্দিফিকির করে চলেছেন, নানা প্রলাপ বকছেন, দেশবাসী ও সরকারযন্ত্রকে বিভ্রান্ত করছেন। আসল সংক্রমণ টেস্টিং কাজ ও চিকিৎসাকাজে তিনি নিদারুণ অবহেলা করে চলেছেন। সমগ্র মিডিয়ায় এসব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা, সমগ্র চিকিৎসকসমাজের সমালোচনার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা সরকার তার বিরুদ্ধে এবং তার সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেন?

বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব মাস তিনেক ধরে কভিড-১৯ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠনের দাবি তোলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। তারা বিষোদগার করে চলেছেন সেই তিন মাস ধরে, এখনো থামছেন না। অথচ এ টাস্কফোর্স প্রস্তাবটিই ছিল কভিড-১৯ লড়াইয়ে সবচেয়ে ভালো সমাধানের পথ। অবিরাম করোনাভাইরাস -বিরোধী যুদ্ধের নতুন নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন ও সেসব থেকে ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সমাধানের একটা রাস্তা বের করার একমাত্র উপায়।

এখন যে লেজেগোবরে দশায় সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের সামগ্রিক কর্মকা- তাতে সরকারকে অবিলম্বে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে কভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন নিয়ে একটা চিকিৎসা টাস্কফোর্স অবিলম্বে গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। এ টাস্কফোর্স কিংবা পৃথক আরেকটি টাস্কফোর্স জীবিকা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে (নতুন অর্থনীতি কায়েমের মাধ্যমে) শক্তিশালী লড়াই চালানোর পরামর্শ দিতে পারেÑব ্যাপক পর্যালোচনা ও গবেষণা কাজের মাধ্যমে।

সরকার যে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা সারা বিশ্ব দেখছে। সারা বিশ্বই বলছে তা। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে অবিলম্বে একটা জাতীয় টাস্কফোর্স এক্ষুনি গড়ে তোলা দরকারÑ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সর্বদলীয় হওয়া প্রয়োজন এ প্রতিষ্ঠানটি। কোনো গোঁয়ার্তুমির আর সুযোগ এখানে নেই- ‘একলা চলো’ নীতির দাম্ভিকতা সরকারকে ছাড়তেই হবে। আরও বেশি উদারতা চাই আওয়ামী লীগের কাছে, তার সরকারের কাছে। তাদের শীর্ষ নেতাদের কাছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সরকার জাতীয় সংকটের যে কোনো পরিস্থিতিতে সর্বদলীয় সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেয়। দুনিয়ার গণতান্ত্রিক অন্য দেশগুলোয়ও তাই ঘটে। তার পরও আমাদের শিক্ষা হয় না কেন! আমরা কেন সে রকম উদারতা প্রদর্শনে এগিয়ে আসতে পারি না!

                লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও  ডাকসু সাধারণ সম্পাদক ।

সর্বশেষ খবর