বুধবার, ২৪ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

লকডাউন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ

তপন কুমার ঘোষ

লকডাউন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ

গোটা বিশ্বকে কাবু করে ফেলেছে করোনা। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিল আমরা গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি। করোনা স্মরণ করিয়ে দিল, জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী। একটা বিষয় পরিষ্কার, করোনা অন্ধ। শ্রেণিবৈষম্য মানে না। মন্ত্রী, সাংসদ, আমলা, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, ধনী, গরিব- সবাইকে ঘরবন্দী করে ফেলেছে করোনা। আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে মার্চের শেষ নাগাদ সাধারণ ছুটি (অঘোষিত লকডাউন) ঘোষণার পর চার দেয়ালের মধ্যে আটকে গেছে আমাদের জীবন। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগসূত্র-  টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের সহায় হয়েছে। আমাদের বন্দীদশা অনেকটাই ঘুচিয়ে দিয়েছে ইন্টারনেট।

লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং- ইংরেজি শব্দগুলো আমাদের অনেকের কাছেই অপরিচিত ছিল। করোনার কারণে শব্দগুলো এখন বহুচর্চিত। আমাদের নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘সমুদ্রে সাইক্লোন’ নামে একটা গল্প ছিল। ওই গল্প পড়ে ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দের সঙ্গে আমরা প্রথম পরিচিত হই।

ইন্টারনেট প্রযুক্তি পৃথিবী নামক এ গ্রহটাকে আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে এনে দিয়েছে। এ দুঃসময়ে ইন্টারনেটনির্ভর ইমেইল, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ভিডিও কনফারেন্সিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভিডিও কনফারেন্স করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যঝুঁঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এটাকে বলা হচ্ছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘ঘরে থেকে কাজ’। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে সভা করার সুবিধার্থে তাদের ডিভাইসে ‘জুম’ অ্যাপ ডাউনলোড করার নির্দেশনা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আদালত বন্ধ থাকায় জরুরি মামলা শুনানির জন্য ভার্চুয়াল আদালত চালু করা হয়েছে। হাই কোর্টসহ সারা দেশে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম চলছে। এবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয়েছে অনলাইনে। করোনাভাইরাসবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বুলেটিন অনলাইনে ঘোষণা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা অভিভাবকদের মোবাইল ফোনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, অনলাইনে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, অনলাইনে বিমান ও ট্রেনের টিকিট কেনা- এসবই দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। করোনার এ কঠিন সময়ে টেলিমেডিসিন ভরসা।

শুধু অফিসের কাজেই নয়, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেও এখন আলাপ-আলোচনায় ভিডিও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ ব্যবহার শিখে নিয়েছেন অনেকেই। টেলিভিশনে ‘টকশো’ হচ্ছে ভিডিও অ্যাপ ব্যবহার করে। আলোচকরা যার যার ঘরে বসেই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। বদলে যাচ্ছে পড়াশোনার ধরন। ভার্চুয়াল শিক্ষাদান পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ল্যাপটপ থাকলে ভালো। অগত্যা একটা স্মার্টফোন হলেই চলে। বাড়িতে বসেই অনলাইনে পরীক্ষা দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে।

অঘোষিত লকডাউনে ঘরবন্দী মানুষের কাজ নেই। রোজগার নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। অনেকে মানসিক অবসাদে ভুগছেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শÑ মন খারাপের দিনগুলোয় মনের কথা মনের মধ্যে জমিয়ে না রেখে আপনজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও সমমনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। মনের মধ্যে অবসাদ জমাট বাঁধতে থাকলে তো বিপদ। অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে সোশ্যাল মিডিয়ায় শিল্পচর্চা ও সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। ফেসবুকে লাইভ অনুষ্ঠান হচ্ছে। একদিকে অনুশীলন, অন্যদিকে অবসাদ থেকে মুক্তি।

কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের উপযোগিতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন একটাই- ইন্টারনেট প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করছি তো আমরা? করোনাভাইরাস নিয়ে সত্য-মিথ্যা নানা কথা রটনা করা হচ্ছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, ‘যা রটে তার কিছুটা বটে’। ফেসবুক খুললেই কত কথা! কত পরামর্শ! যেন সবাই করোনা-বিশেষজ্ঞ। নানা মুনির নানা মত। এসবে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে যে অগ্রগতি হয়েছে তার প্রশংসা করতেই হয়। শুধুই সমালোচনা নয়। ভালোকে ভালো বলা আমাদের শিখতে হবে। এটা একটা মহৎ গুণ। দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ডিজিটালাইজেশনের সুফল আমরা হাতে হাতে পেয়েছি। এ সময় প্রযুক্তি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের জীবন। আমাদের ইন্টারনেট-নির্ভরতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। নতুন প্রযুক্তিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। করোনা-উত্তর বাংলাদেশে হয়তো বা এ ধারা বহমান থাকবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে যে।

সারা দেশে ইন্টারনেট-নির্ভর অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে প্রয়োজন সুলভ মূল্যে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ সরবরাহ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ। গ্রামে-গঞ্জে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ‘ব্রডব্যান্ড’ এখনো পৌঁছায়নি। মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনেকে ডেটা ব্যবহার করেন, যা তেমন একটা সাপোর্ট দেয় না। প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে মোবাইল ফোনের কলচার্জ ও ইন্টারনেট প্যাকেজের ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে স্পষ্টতই মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। সুযোগ এখনো আছে।

করোনার চোখ রাঙানি আর কত দিন সহ্য করতে হবে কে জানে! আজ না হোক কাল করোনার প্রতিষেধক বের হবে। আমরা আশাবাদী, হতচ্ছাড়া করোনা একদিন কুপোকাত হবেই।

                লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা   পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর