বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সমাজ আর কতো পেছনে হাঁটবে

তসলিমা নাসরিন

সমাজ আর কতো পেছনে হাঁটবে

একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর চাকরি করা পুরুষলোকেরা পছন্দ করতো না। বিয়ের সময় পাত্রী দেখতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত পুরুষেরাও বলে আসতো, বিয়ের পর লেখাপড়া করা বা চাকরি করা চলবে না। এভাবেই চলছিল সমাজ। এভাবেই চিরকাল চলতো, যদি না কিছু দৃঢ়চিত্তের মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইতো। সমাজে ধীরে হলেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন ভালোও যেমন, মন্দও তেমন। এক পা এগোলে আরেক পা পেছোয়- এমন পরিবর্তন। লেখাপড়া করছে, চাকরি করছে, এমন মেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, পুরুষতন্ত্রে মগজ ধোলাই হওয়া মেয়ের সংখ্যাও তেমন বেড়েছে।

সমাজের অজস্র প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে কিছু মেয়ে ঠিকই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছে, চাকরি বাকরি করেছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়েরাই কোনও কোনও সংসারে সবচেয়ে বড় সহায়। সংসারে খরচ দিচ্ছে, ভাই বোনকে পড়াচ্ছে, মা বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে। পুত্র’র ওপর যে ভরসাটি করতো মানুষ, কন্যার ওপর দেখেছে একই ভরসা করা যায়। টাকা পয়সা আসলে সমস্ত তন্ত্রমন্ত্র ডিঙিয়ে যেতে পারে। পুরুষতন্ত্র মেয়েদের শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হওয়ার কথা বলে না। বরং ঘরে বসে স্বামী সন্তানের সেবা করতে বলে। কিন্তু এবার পুরুষতন্ত্র দেখলো, মেয়েরা টাকা পয়সা রোজগার করে সংসারে খাটালে সংসারের অভাব যায়, সংসারে চেকনাই বাড়ে। তাই বিয়ের বাজারে আগের মতো ফর্সা সুন্দরী ঘরোয়া মেয়ের যেমন চাহিদা ছিল, সেই চাহিদা তো রইলোই, যোগ হলো রোজগেরে মেয়ের চাহিদা। মেয়েদের দিয়ে স্বামী সন্তানের সেবা হলো, শ্বশুরবাড়ির সকলের সেবা হলো, টাকা রোজগারটাও হলো। এ বাড়তি সুবিধে। টাকার গন্ধ পেলে সমাজ-সংসারের জিভ বেরোবে না, এ কোনও কথা। এমন সময় যদি শুনি, সুমাইয়া বেগম নামের একটি মেয়ে পড়াশোনা বন্ধ করেনি বলে, বা চাকরি করতে চায় বলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে প্রাণে মেরে ফেলেছে, তাহলে অবাক হতেই হয়। এমন আজকাল শোনা যায় না। বরং শোনা যায়, বাপের বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা না আনাতে বাড়ির বউকে পিটিয়ে, পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

ওইযে বলেছিলাম কয়েক যুগে যে পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে, তার মধ্যে মন্দের সংগে ভালোও আছে। ভালোটা হলো এই, প্রচার মাধ্যমে নারী-নির্যাতনের খবরগুলো, যদিও সব আসে না, সামান্য কিছুই আসে, তবু তো আসে। আগেও মেয়েদের খুন করা হতো, আগেও ধর্ষণ হতো, নারী নির্যাতন হতো, মানুষ জানতে পারতো না। এখন জানার সুযোগ হওয়ায় সমাজ কতটা পুরুষতান্ত্রিকতার কাদায় ডুবে আছে; কতটা মূর্খ, অসভ্য, বর্বরদের বাস সমাজে- তা অনেকটাই অনুমান করা যায়। আগে নারী-নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হতো। এখনও হয়। তবে কিছু মানুষ সচেতন হয়েছে। তারা প্রশ্ন করতে শিখেছে। এখন বর্বরতা আর খুন ধর্ষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। এই প্রতিবাদ, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, হতে পারছে কারণ মানুষ বর্বরতা আর খুন ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনাগুলো জানতে পারছে। সমাজের সব লোক কিন্তু প্রতিবাদে অংশ নেয় না। কারণ সমাজের সব লোক বিশ্বাস করে না নারী নির্যাতন আদপেই অন্যায় কিছু। এখনও সমাজের অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে, স্বামীর আদেশ অমান্য করা কোনও মেয়েরই উচিত নয়। এই হত্যাকা-ে, সত্য তথ্য এই, অনেক লোকের সমর্থন আছে, কিছু লোক হত্যাকা-কে বাড়াবাড়ি মনে করলেও সুমাইয়া যে স্বামীর আদেশ না মেনে অন্যায় করেছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত।

সুমাইয়ার পিতা একজন ধর্মগুরু। সম্ভবত ওয়াজ মাহফিল করে বেড়াতেন। এমন লোক সাধারণত মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে বলেন। সেখানে সুমাইয়ার পিতা সিদ্দিকুর রহমান কন্যাকে বাধা দেননি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে, বরং নিজেই অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য করেছেন। অবশ্য বিষয় বেছে দিয়েছেন, ইসলাম। উচ্চশিক্ষার জন্য কোনও বিষয়ই মন্দ নয়। সুমাইয়া পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, গণিত বিজ্ঞান, বা নারীর সমানাধিকার, পুরুষতন্ত্রের অপকারিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেনি, সে নারীবাদীও হবে না, বিজ্ঞানীও হবে না। সে পড়াশোনা করেছে ইসলাম নিয়ে, আরো বেশি ইসলাম সম্পর্কে জানবে, আরও বেশি ধর্মপ্রাণ হবে- এতেও স্বামী শ্বশুরের আপত্তি। আপত্তি আসলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে। স্বাবলম্বী মেয়েরা সাধারণত ক্রীতদাসী হতে চায় না। ক্রীতদাসী না হলে বাড়ির বউকে মানাবে কেন! স্বামীর অবাধ্য হওয়া কোনও মেয়েকে আজও এই একবিংশ শতাব্দিতেও মানুষ পছন্দ করে না। মেয়েরা যদি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়, এই নারীবিরোধী সমাজে কারও না কারও তো অবাধ্য হতেই হয়, এ ছাড়া তো স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। বধূহত্যা কোনও নতুন ঘটনা নয়, বধূ স্বাবলম্বী হতে চেয়েছে, ঘরের বার হতে চেয়েছে, যদিও হিজাব পরেই ঘরের বার সুমাইয়া হতো, তাতেও মানতে পারেনি স্বামী শ্বশুর, অতএব নির্যাতনই ভরসা। ঘৃণা থেকে যে নির্যাতনগুলো করা হয়, সেগুলোতে নির্যাতনকারীদের হুঁশ থাকে না। কণ্ঠদেশ কতটা চেপে ধরলে মানুষ শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়ে, সেটা বেমালুম ভুলে যায়।

সুমাইয়া হত্যার খবরটা আমরা পেয়েছি যেহেতু সুমাইয়ার মা মামলা করেছেন এবং প্রচার মাধ্যমকে জানিয়েছেন। এরকম কত সুমাইয়াকে প্রতিদিন নির্যাতন করা হচ্ছে, কত সুমাইয়াকে মেরে ফেলা হচ্ছে, কত সুমাইয়া বর্বরতার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে- সে খবর কে রাখে! মেয়েরা নিহত হলে সাধারণত নিঃশব্দে সৎকার করে ফেলা হয়, নিজেদের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাগ্যে ছিল তাই মরেছে অথবা থানা পুলিশ করে কী লাভ, যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না- জাতীয় কথাবার্তা কয়েকদিন বলে টলে ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করা হয়।

স্বনির্ভর মেয়েদের অহংকার বেশি থাকে, তারা উঠতে বললে ওঠে না, বসতে বললে বসে না, এরকম একটি বিশ্বাস সুমাইয়ার স্বামী-শ্বশুরদের ছিল। কিন্তু তাদের জানা ছিল না, আজকালকার পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী মেয়েরা রোজগার করে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেয়, এবং পরনির্ভর মেয়ের মতোই মুখ বুজে স্বামী শ্বশুরদের সেবা করে। সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব বড় ভুল করেছে, তারা অনায়াসে লাভবান হতে পারতো সুমাইয়ার দ্বারা। সুমাইয়ার অর্থ এবং শ্রম থেকে এখন তারা বরং বঞ্চিত।

সুমাইয়া স্বামী-সংসার ত্যাগ করতে চায়নি। সে ধর্ম মেনে চলে, তাই হিজাব পরে। ধর্ম বলেছে স্বামীকে সদা সুখী রাখতে, স্বামী যখন যা চায় তাই দিতে, নিজের জীবনকে অপূর্ণ করেও স্বামীর জীবনকে পূর্ণ করতে। সুমাইয়াও নিশ্চয়ই তাই করতো। সুমাইয়া ঘরে টাকা আনলে বেকার স্বামী স্বস্তি পাবে, সুখ পাবে, এই ভেবেই হয়তো ভালো চাকরি পাওয়ার উদ্দেশে সে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

মেয়েদের জীবন সম্পূর্ণ নির্ভর করে স্বামী কী চায় বা না চায় তার ওপর। স্বামী যদি না চায় স্ত্রী বেঁচে থাকুক, তাহলে স্ত্রীর বেঁচে থাকার খুব বেশি উপায় থাকে না। স্বামী যদি স্ত্রীকে নির্যাতন করতে চায়, তবে নির্যাতন থেকেও স্ত্রীর বাঁচার খুব উপায় থাকে না। অসুখী দম্পতির মধ্যে যত ডিভোর্স হওয়া উচিত, তত হচ্ছে না। সমাজের ভয়েই হচ্ছে না। সমাজের ভয় মেয়েদেরই। যত মন্দ কিছু ঘটে, দোষ মেয়েদের। পুরুষকে কজন লোক ঘেন্না দিয়ে বলে, ‘আপনি তো সংসার করতেই পারছেন না, নিশ্চয়ই আপনার চরিত্র খারাপ।’

পুরুষের চরিত্র খারাপ এবং মেয়েদের চরিত্র খারাপ- এই দুই খারাপের মধ্যে সমাজ কিন্তু পার্থক্য করে। পুরুষের চরিত্র খারাপ হওয়া সমাজের চোখে ততটা কুৎসিত নয়, যতটা কুৎসিত মেয়েদের চরিত্র খারাপ হওয়া।

মেয়েরা স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হলে সমাজ বরং মেয়েদেরই দোষ দিয়ে বলে নিশ্চয়ই ওর কোনও দোষ ছিল, তা না হলে স্বামী পেটাবে কেন। স্বামী মন্দ লোক বলে স্বামী পেটায়, এই সত্যটা বেশি লোক ভাবতে জানে না।

সুমাইয়ার বাপের বাড়ি প্রভাবশালী হলে সুমাইয়ার হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে, তা না হলে পাবে না। কত হত্যাকারী নিশ্চিন্তে নিরাপদে হাটে ঘাটে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিশ্চয়ই সবাই জানে।

সারা পৃথিবীর জরিপে দেখা যায়, মেয়েদের নির্যাতন করে, অত্যাচার করে, হত্যা করে তার পরিবারের লোকেরাই বেশি, বিশেষ করে স্বামীরা। তার পরও এই নারীবিরোধী সমাজে বিবাহের হিড়িক পড়ে। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, মেয়েরা তাদের সম্ভাব্য হত্যাকারীকেই বিয়ে করে। এরপর যদি সংসার সুখের হয়, সে পুরুষের গুণে।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর