শিরোনাম
শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাবিরোধী যুদ্ধে জিততে হবে

মাহমুদুর রহমান সুমন

করোনাবিরোধী যুদ্ধে জিততে হবে

করোনাভাইরাস দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। মধ্য আয়ের দেশে উন্নত হওয়া বাংলাদেশের মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল তখন করোনাভাইরাস তাদের সামনে কালো অন্ধকারের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সন্দেহ নেই ধনী গরিব সব দেশ অভিন্ন অবস্থার শিকার।

বাংলাদেশকে করোনায় সৃষ্ট বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ১৭ কোটি মানুষের জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সরকার ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

সারা পৃথিবীর মানুষকে ভাবতে হবে কীভাবে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিতে হবে করোনাভাইরাসের ঝুঁঁকি মোকাবিলা করে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কভিড-১৯ বিশেষজ্ঞ লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গ্লোবাল হেলথের অধ্যাপক ডেভিড নাবারো এ সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে, যারা আক্রান্ত হবে এবং আক্রান্তের আশেপাশের মানুষজনকে আইসোলেশনে নিতে হবে, বয়স্কদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে এবং হাসপাতালে চিকিৎসার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে এবং এগুলো আমাদের জীবনের অংশ হিসেবে বেছে নিতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরমতম উৎকর্ষের সময়েও করোনা ঠেকানোর ক্ষেত্রে কোনো আশার আলো আপাতত নেই। অতি প্রবল এ মহামারীর কবলে প্রতিনিয়ত ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে মানবসভ্যতা, নিভে যাচ্ছে অমূল্য সব প্রাণ। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে ও জনপদে এ ধ্বংসদানবের নির্মম ছোবল জনজীবনের সমস্ত স্বাভাবিকতাকে, গতি প্রবাহকে স্তব্ধ-স্থবির করে দিয়েছে। বিধ্বস্ত পরাস্ত পর্যুদস্ত হওয়াই কি তার নিয়তি? নিশ্চয়ই না। প্রত্যয়ে, সাহসে, আশাবাদে অদম্য দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়ে প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

বিশ্বের বেশকিছু দেশ লকডাউন পর্যায়ক্রমে শিথিল করে স্বাভাবিক গতি ও ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। করোনা প্যানডেমিক মোকাবিলায় বাংলাদেশের সম্মুখ সারির যোদ্ধা যারা, সেসব পেশাজীবী-চিকিৎসক, পুলিশ-আনসার, সাংবাদিকদের প্রাণহানি ও সংক্রমণ বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মহাবিপর্যয় মোকাবিলায় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অথচ সেটা এ সময়ে প্রত্যাশিত ও অতি আবশ্যক ছিল। সন্ত্রস্ত মানুষ দিশাহারা হতে বাধ্য কারণ পুরো বাংলাদেশই বিপর্যস্ত। দেরিতে হলেও সরকার করোনা মোকাবিলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

সবারই জানা, সরকারিভাবে উদ্যোগ থাকলেও বাংলাদেশে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আমাদের নাগরিকদের অসচেতনতা, বিশৃঙ্খল আচার-আচরণ ও গাফিলতি মহা সর্বনাশ ডেকে এনেছে। জীবন-জীবিকার প্রচন্ড অনিশ্চয়তার কারণেও এসব ঘটেছে। ইতিমধ্যে করোনাকালীন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

আমরা জানি, করোনাভাইরাসের বিষাক্ত ছোবলে বিশ্ব অর্থনীতিু এখন পঙ্গুপ্রায়। মহামন্দা ও অর্থনৈতিক সংকট সবেগে ধেয়ে আসছে। ১৯২০ সালের মহামন্দার চাইতেও এ বিধ্বংসী মহামন্দা বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সেরকমই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মহল। বর্তমান বিশ্বের ধনী ও শক্তিধর অর্থনীতির দেশগুলোর যারা পরিচালক ও কা-ারী তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ক্রমেই বাড়ছে। সব মিলিয়ে এক দিশাহারা অবস্থা। বিশ্বজুড়েই কভিড-১৯ এর লাগামহীন সংক্রমণ, ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাপুঞ্জ অর্থনীতির সচল চাকাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এই যদি হয় শক্তিমান দেশের চিত্র, তাহলে তুলনামূলকভাবে গরিব উন্নয়নকামী দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর অবস্থা কী হতে পারে? এক কথায় বলা চলে, শোচনীয়। বহুমাত্রিক সর্বনাশা এ মহাদুর্যোগ থেকে ন্যূনতম পরিত্রাণের উপায় যে কী, একমাত্র আল্লাহ মাবুদই তা বলতে পারেন।

বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ। করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে কৃষি উৎপাদন ছাড়া অন্যান্য সেক্টর এখন প্রায় অচল। থেমে আছে অর্থনীতির চাকা। প্রবৃদ্ধি অর্জন তো দূর অস্ত, সব নাগরিকের দুই বেলা দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তাও নেই। সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বেকারত্ব আরও তীব্রতর হবে বলে অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকরা আশঙ্কা করছেন।

বাংলাদেশের যে অর্থনীতি, তার তিনটি বড় খাত হলো কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত। কয়েকটি করে উপখাত রয়েছে এসব খাতের। শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ হলো কৃষিখাতের প্রধান প্রধান উপখাত। স্বল্প মেয়াদে এসব উপখাতে উৎপাদন কমেনি বটে, তবে দেশে-বিদেশে অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে এসব খাতের পণ্যমূল্যে নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফল দাঁড়াচ্ছে প্রতিদিনকার ক্ষতি প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

করোনা যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, অর্থনীতিবিদরা মনে করেন তাহলে আগামী দু-তিন বছরে অর্থনীতিতে স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

সরকারের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হয়েছে ধকল মোকাবিলায় অন্তত তিন বছর সময় লাগবে। শুধু স্বীকার করা নয় এ তিন বছরে কীভাবে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালাতে পারে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে উদার ভূমিকা নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি দেশের শিল্পখাতকে টিকিয়ে রাখতে ফলপ্রসূ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ব্যাংকিং খাতে সুস্থ অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও থাকা দরকার। করোনা বিরোধী যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ে অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখা সময়েরই দাবি।

                লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর