শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

রঙ্গমঞ্চে দেখি মুখোশ মানুষ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

রঙ্গমঞ্চে দেখি মুখোশ মানুষ

পৃথিবীটাকে আমি সবসময় একটা রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তুলনা করি। রঙ্গমঞ্চ মানে নাটকের মঞ্চ। আধুনিক মানুষের ভাষায় থিয়েটার। থিয়েটার আর নাটক কথাটা এলেই অভিনয়ের বিষয়টা চলে আসে। আবার অভিনয়ের সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীর এক ধরনের নিবিড় যোগসূত্র আছে। তাহলে সহজ সরল করে বলতে গেলে বলা যায়, পৃথিবীটা হচ্ছে একটা থিয়েটার বা নাটকের মঞ্চ। এখানে নাট্যকার ও নাট্য পরিচালকের মতো করে অভিনেতারা কৃত্রিম অভিনয় করে না, অভিনয় করে মানুষ নামের মানুষ। বাস্তব পৃথিবীর মানুষ। তবে কি সব মানুষই অভিনেতা নাকি সব অভিনেতাই মানুষ। হয়তো দুটোই। মনে পড়ে গেল সত্যজিৎ রায়ের নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র ‘নায়ক’-এর কথা। এ মৌলিক চিত্রনাট্যে নায়কের মনস্তত্ত্ব উন্মোচনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। নায়ক সিনেমায় মহানায়ক উত্তম কুমার। এ সিনেমায় অভিনেতা উত্তম কুমার যেমন মানুষ তেমন মানুষ উত্তম কুমার অভিনেতা। কঠিন দর্শনতত্ত্ব এটা কেমনে হতে পারে। একজন মানুষ দুটি সত্তা। একজন মানুষ দুটি রূপ। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। নায়ক অরিন্দমের স্বপ্নদৃশ্যের মধ্যে রয়েছে বিবেকের টানাপড়েন। টাকার পর টাকা আর সেই টাকার ওপর ভোগবাদিতার আনন্দ নিয়ে নায়ক হেঁটে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন টাকার পাহাড়, টাকার সমুদ্র। হঠাৎ করেই পুরনো আমলের টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে ওঠে। শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে এগিয়ে যেতেই নায়ক দেখেন, একটা রক্ত-মাংসহীন কঙ্কালের হাতে টেলিফোনের রিসিভারটা আছে। আতঙ্কিত হন নায়ক, এক পা দু পা করে পিছিয়ে আসেন। টাকার স্তূপগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে অসংখ্য কঙ্কালের হাত। এরপর হঠাৎ করেই ক্রমাগত নায়ক টাকার চোরাবালিতে ডুবে যেতে শুরু করেন। এ সময় আরেকজন মানুষকে দেখা যায়। মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত নায়ক ব্যাকুল হয়ে তাকে বলেন, ‘শঙ্করদা, আমাকে বাঁচান!’ কিন্তু বাঁচানোর সুযোগ থাকলেও শঙ্করদা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন না। এর পরিণতিতে নায়ক টাকার চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতে একসময় হারিয়ে যান। আতঙ্কিত নায়ক ভয়ে ঘেমে ওঠেন। ঘুম ভেঙে যায়, স্বপ্ন হারিয়ে যায়। জীবনবোধের বিভিন্ন ইতিবাচক উপাদান থেকে বিচ্যুত হয়ে লোভের চোরাবালিতে আটকে পড়ার যে নেতিবাচক প্রভাব, এরই প্রতিফলন ঘটেছে এই স্বপ্ন দৃশ্যে। মনে কৌতূহল জাগতে পারে, কে এই শঙ্করদা যিনি টাকার চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া নায়ককে বাঁচালেন না? পাড়ার থিয়েটারে শঙ্করদার হাত ধরে অরিন্দম অভিনেতা হয়ে ওঠেন। অথচ অরিন্দমের ফিল্মে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তার তীব্র আপত্তি ছিল। মঞ্চের স্বাধীনতার সঙ্গে ফিল্মের তুলনা করে তিনি বলতেন, ‘ফিল্মের একটা গ্ল্যামার আছে জানি। কিন্তু তার সঙ্গে আর্টের কোনো সম্পর্ক নেই। থাকতে পারে না।’ কিন্তু শঙ্করদার মৃত্যুর পরদিনই অরিন্দম ফিল্মের অডিশন দিয়ে শঙ্করদার দর্শন ও বিশ্বাস থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। যার হাতের জাদুকরী শক্তিতে অরিন্দমের অভিনেতা হয়ে ওঠা, তার নিষেধ অগ্রাহ্য করে ফিল্মে আসায় একটা নায়কের মধ্যে সবসময় অপরাধবোধ কাজ করেছে। এমন অনেক মানুষকে আমরা বাস্তব জীবনে অভিনয় করতে দেখছি যারা নিজের শেকড়কে অস্বীকার করে টাকা, ক্ষমতা ও সম্পদের দাসে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার আর অনৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরেছে। তাদের না আছে বিবেকবোধ, না আছে অপরাধবোধ। একজন শিক্ষিত ও গুণী মানুষ আমাদের সমাজে মর্যাদা ও অধিকার পাচ্ছেন না কিন্তু অবৈধভাবে টাকা লুণ্ঠনকারী দানব হয়ে ওঠা মানুষটি সাধারণ মানুষের কাছে মহানায়ক হয়ে উঠছেন। বোঝা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ প্রাণহীন টাকাকে সম্মান করছে নাকি দানবটিকে সম্মান করছে। সব যেন অভিনয়। সবার অভিনয়। রঙ্গমঞ্চে এখন আর মানুষ নেই, আছে মুখোশ মানুষ। অদৃশ্য ভোগবাদী ক্ষমতার অভিনয়। যে অভিনয়ে মানুষ আনন্দিত হয় না, মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত হয়। সেসব মুখোশ মানুষ নায়ক অরিন্দমের মতো টাকার চোরাবালিতে ডুবে যাক, পৃথিবী রঙ্গমঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে জানিয়ে দিক- এ পৃথিবী মানুষের, দানবের নয়। বাস্তবের, অভিনেতাদের নয়। সেটা হয়তো দৃশ্যমান ছিল না কিন্তু সেটার প্রভাব ভিতরের নিভৃত সত্তায় প্রবল ছিল। শিল্পীর মন খুব বিচিত্র হয়। সবখানেই সে নতুনত্বের সন্ধান করে। এটি করতে গিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছবি আঁকার জন্য বেছে নিলেন বাইবেলের ‘দ্য লাস্ট সাপার’ অংশটুকুর একটি বিস্ময়কর মুহূর্ত। যিশুখ্রিস্ট তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে মৃত্যুর আগে যে শেষ নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন তার প্রতিফলন ঘটেছে এ চিত্রকর্মটিতে। এ ভোজে যিশু তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে রুটি ভাগ করে খান আর পান করেন সোমরস। ছবিটিতে মাঝখানে উপবিষ্ট যিশুখ্রিস্টকে ঘিরে শিষ্যদের শেষ নৈশভোজরত অবস্থায় দেখা যায়। এ নৈশভোজের বর্ণনার সুসমাচারের ১৩:২১ ছত্রে বলা হয়েছে, যেখানে যিশু ঘোষণা করেন তাঁর বারোজন শিষ্যের মধ্য থেকে কেউ একজন পরদিনই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাঁকে ধরিয়ে দেবে। যিশু তাঁর শিষ্যদের সামনে এ কথাটি উচ্চারণের পর তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে কে সেই বিশ্বাসঘাতক। এ অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয় ঘোষণার সন্ধিক্ষণে যিশু আর তাঁর সঙ্গীদের মুখ ও মনের অভিব্যক্তির পরিবর্তন জল তুলির রংকে ছাড়িয়ে যেন বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করেছে। কারও মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ, কারও মুখে ভয়, কারও মুখে ছিল বেদনা আর কারও মুখে সন্দেহ। ছবিতে যিশুকে মাঝখানে আলাদাভাবে রেখে যিশুর বারোজন শিষ্যকে তিনজনের এক একটি দলে ভাগ করে দেখানো হয়েছে। প্রথমে ভিঞ্চি যিশুর ১২ শিষ্যের মুখ আঁকলেন। এরপর দীর্ঘ সময় অতিক্রম করলেও আঁকতে পারেননি যিশুর মুখ, কেবল এঁকেছেন যিশুর মুখহীন শরীর। মুখ আর আঁকা হয় না। তিনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত ভাবছেন আর ভাবছেন কেমন হতে পারে যিশুর মুখ, কী অভিব্যক্তি তাতে থাকতে পারে? সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনার কোনো শেষ নেই, তার পরও ভাবনাকে কোনো একটা জায়গায় দাঁড় করাতে হয়। এমন একটি জায়গায় এসে শিল্পী আঁকলেন যিশুর পবিত্র ও নিষ্পাপ মুখ। সে মুখে ভয় নেই, ঘৃণা নেই, হিংসা নেই, জিঘাংসা নেই, নেই কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা। তিনি তো জানেন সব ঈশ্বরের ছক। তাঁকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। আবেগ-অনুভূতিহীন, সত্য ও ভালোবাসার আবহে স্বর্গীয় এক মুখের ছবি আঁকলেন ভিঞ্চি। সব জায়গায় এমন বিশ্বাসঘাতকের চোখ দেখছি। এরা দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অভিনেতা হিসেবে এরা খুব পটু। আনুগত্যে এরা বিশ্বাসী নয়, অতি-অনুগত্য এদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। এরা গভীর জলের মাছ। এদের হাত এখন অনেক লম্বা হয়েছে। কতটা লম্বা তা হয়তো কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সেখানে অদৃশ্য সমীকরণ, সুবিধাবাদিতা, ভাগ-বাটোয়ারা, লোভ, লুটপাট, ভোগবাদিতা। এদের অতি-নাটকীয়তা, অতি-উৎসাহ ও তোষামোদি আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও একটি কথা এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তা হলো, অতি ভালো ভালো নয়। রঙ্গমঞ্চের এ অভিনেতাদের সঙ্গে অনেক ক্ষমতাধর মুখোশ মানুষের যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। কারণ ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’- এ কথাটি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এদের চেনাচেনা মনে হয় তবু অচেনা। এদের থেকে সাবধান। সাধু সাবধান! যিশু তাঁর বিশ্বাসঘাতক চিনেছিলেন, কিছু বলেননি। কিন্তু আমাদের শিখিয়ে গেছেন বিশ্বাসঘাতকদের চিনতে হয়, বুঝতে হয়। প্রকৃত মানুষের করুণ পরিণতি হওয়ার আগে তাদের মুখের মুখোশটা টেনে খুলে ফেলতে হয়। ইতালির ভেনিস শহরে উইলিয়াম শেকসপিয়রের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি নাটক ওথেলোর শুরুটা হয়েছিল। ভালোবাসা-ঘৃণা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সন্দেহ, হত্যা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ, অনুশোচনা সব ধরনের জীবনসম্পৃক্ত উপাদানের সমন্বয় ঘটেছিল এ নাটকে। অন্যের প্ররোচনায় নাটকের মূল চরিত্র ওথেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী ডেসডিমোনাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে। সে অবিশ্বাস ছিল চোখে-মুখে। কল্পিত পরকীয়ার অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত নিজ হাতে খুন করে ডেসডিমোনাকে। কিন্তু পরে ওথেলো বুঝতে পারে এটা তার ভ্রান্ত ধারণা ছিল। অনুতাপে দগ্ধ হয় সে। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে ওথেলো নিজেও আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ওথেলো আর ডেসডিমোনার মধ্যে ভালোবাসার কোনো ঘাটতি ছিল না। বরং সেটা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশিই ছিল হয়তো। প্রচ- ভালোবাসা কখনো কখনো ধ্বংস বয়ে আনে। এর নাটকে তা প্রমাণিত হয়েছে। যাকে মানুষ খুব ভালোবাসে তাকে হারানোর ভয় মানুষকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। যেখানে ভয়, সন্দেহ, আশা, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, হাসি, কান্নার এক দোদুল্যমান সম্পর্কের বন্ধন গড়ে ওঠে। জীবনের এই প্রতিটি উপাদানের কোনো একটি জায়গায় নির্ভরতা থাকতে হয় যদিও আবেগতাড়িত হয়ে সীমা ও নির্ভরতাকে এক করে ফেলি। ভয় আর সন্দেহ যখন সীমা অতিক্রম করে, তখন বিশ্বাসে ক্ষত তৈরি হয়, সম্পর্কের বন্ধনে বিরাম চিহ্ন নেমে আসে। যা ক্রমাগত নেতিবাচক হয়ে মানসিক কিংবা শারীরিক নিপীড়নে পরিণত হয়। মনের এ আস্থাহীনতা ও সন্দেহ মানুষের মনস্তত্ত্বকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। এ মানসিক অস্থিরতাই হচ্ছে ওথেলো সিনড্রোম। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জনটোড নামক একজন ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ এ সমস্যাকে ওথেলো সিনড্রোম হিসেবে অভিহিত করেন। ভাবা যায়, একটা নাটকের গল্প থেকে মনোবিজ্ঞানের নতুন থিওরির জন্ম হয়েছে। সত্যি মানুষ অভিনয় থেকে জ্ঞানকে বের করে এনে মানুষকে নিজেকে চেনাতে পারে। তার ইতিবাচক চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে। এটা অভিনয় নয়, বাস্তবতা। থিওরির সৃষ্টিতে খুব ইতিবাচক কিন্তু ফলটা নেতিবাচক। এ সময়ে এসে দেখছি মানুষে মানুষে সম্প্রীতিতে চিড় ধরেছে, আগাছা জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্বাসের জায়গায় অবিশ্বাস জায়গা করে নিয়েছে। সময় যত গড়িয়েছে মানুষ মানুষের ওপর তত বিশ্বাস হারিয়েছে। প্রতিদিন ঘর ভাঙছে। সুখের সংসার পুড়ে ছাই হচ্ছে। কেউ এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়। বিয়ে, ঘরবাঁধা, প্রেম, ভালোবাসা সব অভিনয়ের যান্ত্রিকতায় আটকে গেছে। মা বাবা আলাদা হচ্ছেন। নিষ্পাপ সন্তান পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছে অনিশ্চিত জীবনে। ছেলেমেয়েরা মিলে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছেন। নেই কোনো কৃতজ্ঞতা, কোনো আনুগত্য, ভালোবাসা। নিজেদের ক্যারিয়ারের কথা বলে মা-বাবাকে দেশে ফেলে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন প্রতিদিন। না আছে মানবিক সম্পর্ক, না নাড়ির টান। সব অভিনয়। সবাই অভিনেতা। কেউ ভিলেন নয়, সবাই নায়ক-মহানায়ক। মহামানব। তার পরও সব কুশীলবের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছি রঙ্গমঞ্চে মুখোশ মানুষ। তা আর দেখতে চাই না, এখন দেখতে চাই রক্তমাংসের নিখাদ মানুষ। তবেই মানুষ টিকে থাকবে, নইলে সবাই একদিন অভিনয় করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর। ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর