শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃষির যান্ত্রিকীকরণে আমরা কতটুকু এগিয়েছি

শাইখ সিরাজ

কৃষির যান্ত্রিকীকরণে আমরা কতটুকু এগিয়েছি

সারা পৃথিবীই বলছে করোনা পরিস্থিতি সব অর্থনৈতিক খাতকে বহুদিনের জন্য স্থবির করে ফেলবে। এমন সময়ে মানুষের সামনে ঘুরেফিরে সেই প্রাচীন পেশা কৃষিই যেন একমাত্র ভরসার আলো জ্বালছে। ঠিক সবুজ বিপ্লবের সময়ের মতো এখনো সবার মনেই প্রশ্ন জাগছে, কৃষি উৎপাদন সর্বোচ্চ বৃদ্ধির জন্য কোন কোন দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। স্বভাবতই সবচেয়ে আগে আসছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। আমাদের দেশের খুব সহজ একটি হিসাবের কথা বলি। আজকের দিনে কেবল যান্ত্রিকীকরণেই পাল্টে যেতে পারে কৃষি উৎপাদনের হিসাব। ১ বিঘা জমিতে লাঙ্গল দিয়ে চাষ করলে ব্যয় হবে ২ হাজার টাকা। পাওয়ার টিলার দিয়ে ব্যয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। ট্রাক্টর দিয়ে করলে ৮০০ টাকা। ধান কাটার ক্ষেত্রে ১ বিঘা জমিতে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে ব্যয় হয় ২ হাজার টাকা। কম্বাইন হার্ভেস্টার দিয়ে কাটলে মাত্র ৪০০-৫০০ টাকা। ধান রোপণের ক্ষেত্রে ১ বিঘা জমিতে ২ হাজার ২০০ টাকা লাগে। ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে লাগালে ৫০০ টাকার মতো লাগে। সময় তো সাশ্রয় হচ্ছেই। সব ক্ষেত্রেই সনাতন পদ্ধতিতে অর্থ ও সময় অনেক বেশি ব্যয় হয়। কিন্তু আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোথাও অর্ধেক কোথাও এক চতুর্থাংশে নেমে আসে খরচ। যান্ত্রিকীকরণ ইস্যুতে আরেকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। আমি বেশ কয়েকবার জাপান গিয়েছি। সেখানকার কৃষি ব্যবস্থাপনার গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেছি। একেবারে তৃণমূল কৃষক থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছি। জাপানের কৃষিসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ২০১৫ সালের জরিপে দেখা গেছে, জাপানে যারা কৃষির সঙ্গে যুক্ত তাদের গড় বয়স ৬৭ বছর। দিন দিন এ গড় বয়সের পরিমাণ বাড়ছে। জাপানের ৭০% কৃষকের বয়স ৬৫-ঊর্ধ্ব। এমনিতেই জাপানে জন্মহার কম। শিল্পোন্নত হওয়ায় তরুণদের কৃষির প্রতি আগ্রহ কম। তাই সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রবীণ কৃষকদের কাজ করাটা সহজ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকার ধারণা করছে যান্ত্রিক কৃষির প্রতি তরুণরা আগ্রহী হবে। বিষয়টি নিয়ে কয়েক মাস আগে চীনের চিংদাওতে আন্তর্জাতিক কৃষিযন্ত্র মেলায় কথা হচ্ছিল জাপানের কৃষিযন্ত্রবিষয়ক গবেষক সাংবাদিক ইয়োশিসুকে কিসিদার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, গত অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৯ সালে জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেটের পরিমাণ ছিল ১০১.৪৬ ইয়েন। সেবারই প্রথম জাপানের বাজেট ১০০ ট্রিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। কৃষিতে বাজেটের পরিমাণ অন্যান্য বছরের চেয়ে ৫.৬ শতাংশ বাড়ানো হয়। জাপান একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছিল। প্রথমত তারা চাচ্ছিল তরুণ প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আকৃষ্ট করতে। দ্বিতীয়ত জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক ২০২০-কে লক্ষ্য রেখে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে একটা নতুন অবস্থান তৈরি করতে। এ কারণে তারা তাদের বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি অর্গানিক কৃষি ও গ্যাপ সার্টিফাইড কৃষির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি বাংলাদেশের চিত্রটির দিকে একবার তাকাই, তাহলে দেখব ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের কৃষকের গড় বয়স ৪৮ বছর। অথচ ১৯৮৮ সালে দেশের কৃষিতে নিয়োজিত চাষিদের গড় বয়স ছিল ৩৫ বছর। তার মানে বাংলাদেশের কৃষিতেও তরুণদের অংশগ্রহণ কমছে। কিন্তু বয়স্ক মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কমে গেলে তারা কৃষিতে সফলভাবে ভূমিকা রাখতে পারে না। তার মানে একদিকে তরুণদের কৃষিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি ব্যাপকভাবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। করোনা পরিস্থিতি জেঁকে বসার সময় বোরো ধান ঘরে তোলার তোড়জোড়ের মধ্যেই বোঝা গেল আজকের দিনে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ কত বেশি প্রয়োজন। সারা দেশে ধান কাটা সহজতর করতে ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকির মাধ্যমে সরকার প্রায় ১ হাজার ৩০০ কম্বাইন হার্ভেস্টার ও ৯৩৪টি রিপার, ২২টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টারসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ কঠিন সময়ে হাওরের ফসল রক্ষা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময়ে হাওরে এবার ধান কাটতে ২৯৪টি কম্বাইন হার্ভেস্টার ও ৪০৬টি রিপার ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৭০% ভর্তুকিতে নতুন ১২৮টি কম্বাইন হার্ভেস্টার ও ২৩টি রিপার কিনতে পারেন কৃষক। জরুরি এ যান্ত্রিকীকরণ সেবা ছাড়া কোনোভাবেই পরিস্থিতির উত্তরণ যে সম্ভব ছিল না তা সহজেই বোঝা যায়। যখন ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর নতুন তাগিদ এসেছে, তখন আমাদের সামনে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে ধরা দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই উদাসীন থেকে গেছি। আমাদের অপরিহার্যতার জায়গায় সঠিক দৃষ্টি রাখা হয়নি। পৃথিবীর সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। গত এক দশকে এ পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। কৃষিতে অভূতপূর্ব সাফল্য রয়েছে। এ সাফল্যের পেছনে ব্যক্তি-উদ্যোগের অনেক বেশি অবদান। বলা যায়, আমাদের দেশের কৃষকই প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তাকে উসকে দিয়েছেন। এখন তাদের হাতে উপযুক্ত যন্ত্র ও প্রযুক্তি তুলে না দিতে পারলে কৃষি নিয়ে কাক্সিক্ষত সাফল্যের জায়গায় পৌঁছাতে পারব না।

পৃথিবীতে যখন কৃষিতে কাস্তে-কোদালের ব্যবহার শুরু হয়েছে তখনই মানুষ যান্ত্রিকতার সন্ধান পেয়েছে। বহু বছর ধরে শুধু এ যান্ত্রিকতার বিকাশ ও উৎকর্ষ ঘটেছে। ১০০ বছরের বেশি সময় আগে এ ভূমিতে প্রথম কলের লাঙ্গলের কথা ভেবেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর পৈতৃক জমিদারি নওগাঁর পতিসরে তিনি এনেছিলেন কলের লাঙ্গল। ঠিক সেখান থেকে আজকের হিসাব যদি করি, শতাধিক বছরে আমরা কৃষির যান্ত্রিকীকরণে কোথায় আছি! বিশ্বায়নের বাতাস সব ক্ষেত্রেই লেগেছে। কিন্তু কৃষিযন্ত্রের ক্ষেত্রেই এখনো নেত্রকোনার কৃষক আবদুল হাই কিংবা ময়মনসিংহের প্রয়াত কানু মিস্ত্রিরাই টেকসই কৃষিযন্ত্র বানানোর পেছনে উৎসর্গ করেছেন সারাটি জীবন। মাঠে মাঠে কাজ করতে গিয়ে সবরকম চিত্রই দেখেছি। একসময় কৃষিযন্ত্রের কথা শুনলে আমাদের দেশের কৃষিশ্রমিকরা আঁতকে উঠতেন। তারা ভাবতেন যন্ত্র এসে তাদের কাজটুকু কেড়ে নেবে। এখন আর সে দিন নেই। এখন একটি কৃষিযন্ত্র গ্রামের একজন তরুণের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আধুনিক চাষ পদ্ধতির সঙ্গে টিকে থাকতে মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারণা দিয়ে সম্ভব নয়। এটি সবাই বুঝে গেছে। সময়ের বিবর্তনে কাজেরও বহু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন কৃষিশ্রমিকেরও তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। কৃষিশ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণেও কৃষি হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল।

বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের চিত্র হলো জমি চাষে ৯৫ ভাগ, সেচব্যবস্থায় ৯৫ ভাগ, ফসল তোলা বা হার্ভেস্টে ১.৫ ভাগ, ধান মাড়াইয়ে ৯৫ ভাগ, রোপণে দশমিক ৫ ভাগেরও কম। মূল সংকটের জায়গাটি এখানেই। ফসল উৎপাদন-পূর্ববর্তী যান্ত্রিকীকরণে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, উৎপাদন ও তার পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণে পিছিয়ে থাকায় আমাদের বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের কৃষিসংক্রান্ত সব গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। কৃষির যান্ত্রিকীকরণে আমরা কোথায় আছি সে বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মুহম্মদ এরশাদুল হকের সঙ্গে। তিনি জানালেন জমি চাষ, মাড়াই ও সেচের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ হলেও সিডার, হার্ভেস্ট ও সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ ততটা হয়নি। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, চাষ, মাড়াই ও সেচের জন্য যে ধরনের যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, সেগুলো টেকনোলজি বেজড। আর সিডার, হার্ভেস্ট ও কীটনাশক বা সার প্রয়োগের জন্য যে যন্ত্রগুলো রয়েছে তা টেকনোলজির পাশাপাশি নলেজ বেজড। ফলে যন্ত্র ব্যবহারে যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটিরও কিছুটা দক্ষতা অর্জনের বিষয় আছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে পারলে ওই যন্ত্রগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, ব্যবহার বাড়বে।

পৃথিবীর দেশে দেশে সব গবেষণা ও উন্নয়নের প্রশ্নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আমাদের দেশে পরিস্থিতিটা ভিন্ন। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ গবেষণা শিক্ষাগত ডিগ্রি লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি, তৎপরতাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি প্রফেসর ড. মনজুরুল আলমের সঙ্গে। তিনিও স্বীকার করে নিয়েছেন, সরকারের প্রকল্পগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তেমন সম্পৃক্ততা থাকে না। তবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত ধান শুকানোর একটি আধুনিক মেশিন উদ্ভাবনের কথা জানালেন তিনি। একেবারেই স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি যন্ত্রটি মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় একবারে ৫০০ কেজি ধান ১২-১৪% ময়েশ্চারাইজারে শুকাতে পারে। বোরো বা আউশের মৌসুমে এ যন্ত্র কৃষকের উপকারে আসবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ার গতি বেশ মন্থর। শুধু একটি উদাহরণ দিই। ২০০৫ সালে আমরা জাপানে গিয়ে প্রথম ধারণ করে এনে দর্শকদের প্রথম দেখিয়েছিলাম রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র। আজ ১৫ বছরেও দেশে এ কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার সে অর্থে শুরু করতে পারিনি। তার কয়েক বছর পর বাংলাদেশে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার আসে ঠিকই কিন্তু তা কৃষকের কাছে অপরিহার্য করে তোলার জন্য যে তৎপরতা প্রয়োজন ছিল তা চালানো হয়নি। একই বছর আমরা বিএডিসির ঝিনাইদহ বীজ বর্ধন খামারে দেখতে পাই অত্যাধুনিক কম্বাইন হার্ভেস্টার। আজ ১৫ বছরেও ধান কাটা ও মাড়াইয়ের এ সমন্বিত যন্ত্রটির ব্যবহার ২-৩ শতাংশে তুলতে পারিনি। এখন এ যন্ত্র সম্পর্কে মানুষ জেনেছে। যা হোক, সময়ের প্রয়োজনেই বড় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৭ হাজার কৃষিযন্ত্র কৃষকের হাতে তুলে দেওয়ার একটি উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে। ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার ওই প্রকল্পের আওতায় ধান ও গমের জন্য ১৫ হাজার ও ভুট্টার জন্য ৫০০- মোট ১৫ হাজার ৫০০ কম্বাইন হার্ভেস্টার দেওয়া হবে। এ ছাড়া ৬ হাজার রিপার ও ৩ হাজার রিপার বাইন্ডার, ৫ হাজার রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ৫ হাজার সিডার বা বেডপ্লান্টার, ৫ হাজার পাওয়ার থ্রেসার দেওয়া হবে। এ ছাড়া ৫ হাজার মেইজ শেলার, ৫ হাজার ড্রায়ার, ১ হাজার ৫০০ পাওয়ার স্প্রেয়ার, ৩ হাজার পটেটো ডিগার, ৫০০ ক্যারেট ওয়াশার ও ২ হাজার আলুর চিপস তৈরির যন্ত্র কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে হাওর এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে, হাওর ছাড়া অন্য এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র কিনতে পারবেন কৃষক। মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার কিংবা পোলট্রিশিল্পেও বিশ্বব্যাপী বহুবিধ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে বলেই এসব খাতে অনেক বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করা গেছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষতিও কমানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমরা উপখাতের যান্ত্রিকীকরণ বিষয়টি কেন এড়িয়ে যাচ্ছি তা নিয়ে কথা হয়েছে পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, কৃষির জন্য যে কোনো উদ্যোগকেই প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। শুধু ফসল কৃষির জন্যই না, কৃষির অন্যান্য উপখাতেও যান্ত্রিকীকরণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

আমাদের দেশে ব্যবহৃত কৃষিযন্ত্রের কমবেশি ৮০ ভাগই আসছে চীন থেকে। টানা কয়েক বছর চীনে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কৃষিযন্ত্রের প্রদর্শনীতে যাচ্ছি। শেষবার এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে চীনের চিংদাও শহরে গত ৩০ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত। সেখানে যন্ত্রের উৎকর্ষ দেখে বোঝা যায়, গোটা পৃথিবী প্রতিনিয়ত সেজেগুজে প্রস্তুত হচ্ছে কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়। মানুষের যান্ত্রিক সুবিধাই শুধু নয়, গতর খাটানো পরিশ্রম থেকে মানুষ কীভাবে নিষ্কৃতি পেতে পারে সে ভাবনা রয়েছে অধিকাংশ যন্ত্রের নির্মাণশৈলীতে। চীন এখন পৃথিবীতে কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতকারক ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। কৃষিযন্ত্র রপ্তানিতেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তারা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় জার্মানি। তারপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে জাপান, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, হংকং, ইংল্যান্ড ও ইতালি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী আমাদের দেশে গত বছরের কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের। তবে কৃষিশ্রমিকের হার দ্রুত কমে আসা, ফসল উৎপাদনে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানা কারণেই কৃষিযন্ত্রের এ বাজারের আকার বাড়ছে। যারা কৃষিযন্ত্র আমদানি করছেন ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করছেন, তারা কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও সরকারি নীতি-পরিকল্পনা নিয়ে কী ভাবছেন। এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছি, অ্যাগ্রো মেশিনারিজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলীমুল এহসান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, একটি পূর্ণাঙ্গ কৃষিযন্ত্র আমদানি করতে কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। কিন্তু তারা তৈরি করছেন বা অ্যাসেম্বলিং করছেন প্রায় ২৭ ধরনের কৃষিযন্ত্র। এ যন্ত্রগুলো তৈরি করতে প্রায় ৪০ ধরনের যন্ত্রাংশ প্রয়োজন, এর মাঝে সম্প্রতি ২০-২৫টি ও আগে ১০টি যন্ত্রাংশের ট্যাক্স রহিত করা হয়। এতে অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে, যন্ত্রের দাম কিছুটা কমবে। বাংলাদেশে আমদানির বাইরেও ২০ ভাগ কৃষিযন্ত্রের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। সামগ্রিকভাবেই আমাদের ফসল তোলা, ফসল রোপণ, ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, জমিতে সার প্রয়োগসহ নানা ক্ষেত্রেই কার্যকর কৃষিযন্ত্রের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশের ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান বড় আকারের কৃষিযন্ত্র আমদানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ছোট আকারের কৃষিযন্ত্র ও ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ আমদানিকারকের সংখ্যা তাদের চেয়ে বড়। বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখছে এসিআই অ্যাগ্রোবিজনেস। কথা বলেছি এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এফ এইচ আনসারীর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর মতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মূল সমস্যা কৃষকের সঙ্গে কমিউনিকেশনের অভাব। কৃষককে কৃষিযন্ত্র সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি সরকারের কাছে গণমাধ্যমসহ সব ডিজিটাল প্ল্যাটফরমকে যুক্ত করার দাবি জানান। দেশে রয়েছে ৭০টি ফাউন্ড্রি, ২ হাজার কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক কারখানা ও ২০ হাজারের মতো যন্ত্রপাতি মেরামত কারখানা। কৃষিযন্ত্রের যে কোনো পার্টসের ৬০ ভাগ চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ে কী ভাবছে সরকার- তা জানতে কথা হয়েছে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে হার্ভেস্টে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করতে পারবে সরকার। তবে ট্রান্সপ্লান্টেশনে আরও বেশি সময় লাগবে। তবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণে দেশীয় কৃষিযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি উৎপাদনমুখী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে। আজকের পৃথিবী যতটা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে, করোনা পরিস্থিতিতে এ নির্ভরতা আরও বেড়ে গেছে। প্রযুক্তিকেই এখন করতে হবে উন্নয়নের বন্ধু। নইলে আমাদের কোনো ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব হবে না।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর