শনিবার, ২৭ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

হিন্দি-চীনি ভাই ভাই

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

হিন্দি-চীনি ভাই ভাই

বিগত শতকের পাঁচের দশকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে পঞ্চশীল গঠিত হয়েছিল পাঁচটি দেশের পাঁচ প্রধানকে নিয়ে। নেহরু ছাড়া বাকি চারজন হলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী জু-এন লাই (চৌ এন লাই), ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল নাসের, আফ্রিকার নকুরমা, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো। উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা। নেহরুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী। বিপ্লবের পর চীনে এক মহামারী রোগ দেখা দেয়। নেহরু ভারত থেকে ৬০০ ডাক্তার পাঠিয়েছিলেন।

চৌ এন লাই-নেহরুর বন্ধুত্ব ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এ পঞ্চশীলের সূত্র ধরেই নেহরু গঠন করেছিলেন নির্জোট আন্দোলন। বাংলাদেশসহ এখন বিশ্বে নির্জোট আন্দোলনের সদস্য ১৮২টি দেশ। চৌ এন লাই নির্জোট আন্দোলনে যোগ দেননি। আমার মনে আছে, ১৯৬০ সালে ছাত্রাবস্থায় আমি চৌ এন লাইকে দেখতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়েছিলাম। সেখানে নেহরু তাঁকে বিরাট সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। তার দেড় বছরের মাথায় ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ভারত আক্রমণ করে।

১৯ দিনের যুদ্ধে ভারতের কিছু এলাকা চীন দখল করে নিয়েছিল। পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ঢুকে পড়েছিল আসামের তেজপুর পর্যন্ত। সে শোক নেহরু সামলাতে পারেননি। ’৬৩ সালে হৃদরোগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশ্বের নানা ইতিহাসবিদ নেহরুর এ অসুস্থতার জন্য চৌ এন লাইকে দায়ী করেন। ’৬৪ সালের মে মাসে তিনি মারা যান। নেহরুর মৃত্যুর পর চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হতে শুরু করে। ’৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ’৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। তারপর গত বছর ধরে দোকালাম থেকে শুরু করে অরুণাচলসহ একাধিক সীমান্তে চীন বারবার হানাদারি চালায়।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা করেছিলেন নেহরুর কোনো বিদেশনীতি আর করবেন না। তাঁর নতুন বিদেশনীতির ভরকেন্দ্র হবে আমেরিকা ও চীন। সম্প্রতি লাদাখে অতর্কিতে হানা দিয়ে ভারতের ২০ জওয়ানকে হত্যা করে। তুলে নিয়ে যায় ১০ জনকে। যার ফলে গোটা ভারতবর্ষে মোদির চীনপ্রীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মোদি বাধ্য হন সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে। সে বৈঠকে চীনা হানাদারদের ব্যাপারে যেসব কথা বলেছেন, তার একটি শব্দও বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিরোধী নেতারা। ওই বৈঠকে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী থেকে শুরু করে LPI (M) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সবাই মোদি যে সঠিক তথ্য দেননি, সে ব্যাপারে সরব হয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ওই বৈঠকে সোনিয়া নরেন্দ্র মোদিকে স্পষ্ট বলে দেন, চীন-ভারত সীমান্তে যে স্ট্যাটাস ক্যু বা স্থিতাবস্থা রয়েছে, তা কোনোভাবেই ভঙ্গ করা যাবে না। একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তোলেন, চীনা সেনারা ঠিক কবে সীমান্তে হানাদারি শুরু করেছে। কেন এত দিন পর্যন্ত সরকার একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি? তীক্ষè ভাষায় মোদি সরকারকে বিঁধে সোনিয়া বলেন, তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে যথাসময় সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। যখন চীনা আগ্রাসন শিয়রে চলে এসেছে, তখনই কি ঘুম ভাঙছে প্রশাসনের? মোদি সরকার গোড়া থেকেই অস্বীকার করে আসছিল চীনাদের হাতে ভারতের কোনো সেনা বন্দী নেই। সংঘর্ষের ৭২ ঘণ্টা পর জানা গেল ভারতের ১০ জওয়ানকে বন্দী করে চীনারা দরকষাকষি করছিল। এ ৭২ ঘণ্টায় ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কমপক্ষে এক ডজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতিরক্ষা দফতরের এ অহেতুক গোপনীয়তা নিয়ে হইচই ফেলে দেন। কেন এ গোপনীয়তা- এ প্রশ্নে জেরবার হয় গোটা দেশ। প্রতিরক্ষা বিভাগের তরফে ঘরোয়াভাবে এ ১০ জওয়ানের ফেরার কথা বলা হলেও সরকারিভাবে তা ঘোষণা করা হয়নি। স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করা হয়নি। পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়ে দেয়, এখন তাদের  হাতে কোনো ভারতীয় আটক নেই।

এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেন, পূর্বপরিকল্পিত-ভাবেই চীন আক্রমণ শানিয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকার তা না দেখে ঘুমিয়ে পড়ার অবস্থান নেয়। সরকারের অবশ্য যুক্তি, ওই সেনাদের ছাড়ানোর জন্য দফায় দফায় আলোচনা চলছিল। গত সোমবার সংঘর্ষের পর ১০ ভারতীয় সেনাকে আটক করে চীন। তাদের মধ্যে ছিলেন মেজর ও ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার চার কর্মকর্তাও। প্রটোকল মেনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে।

যখন লাদাখে চীনারা ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে আসে সেদিনই রাতে বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামা ND TV চ্যানেলের সম্পাদক প্রণয় রায়কে এক সাক্ষাৎকারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বেইজিংয়ের শাসকদের ব্যাপারে কিছুই জানেন না, বোঝেন না। চীনের আসল রূপ এখনো সঠিকভাবে চিনতে পারেননি। এদিকে, পরিস্থিতি যে ক্রমেই ঘোরালো হতে পারে সে ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট জিন পিং ও নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলার প্রস্তাব দিয়েছেন। যে কোনো দিন এ তিন নেতার মধ্যে চীন-ভারত উত্তেজনা নিয়ে কথা হতে পারে। তবে এ লেখা পর্যন্ত সাউথ ব্লক এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

২০০২ সালে গুজরাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকায় ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। মোদি ক্ষমতায় এসেই বেছে নিয়েছিলেন বেইজিংকে। বেইজিংয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত এস জয়শঙ্করকে নিয়ে গিয়ে ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত করেন। জয়শঙ্করের উদ্যোগেই মোদি-ট্রাম্প বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হয়। অবসর নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে তাকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। এদিকে ভারতে দাবি উঠেছে চীনা দ্রব্য বর্জনের। বিজেপির একটা অংশ সারা দেশে রাস্তায় রাস্তায় চীনা দ্রব্য জ্বালাতে শুরু করেছে। মোদি ক্ষমতায় এসেই গুজরাটের কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি স্থাপনের জন্য ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করে চীন থেকে মূর্তি বানিয়ে আনেন। এ মূর্তি উদ্বোধনে ভারতে এসেছিলেন জিন পিং। সে সময় তাঁকে ও মোদিকে একই দোলনায় দুলতে দেখা গিয়েছিল।

২০১৩ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৮-১৯ সালে ভারত-চীন বাণিজ্য হয়েছে ৮.৬৫ বিলিয়ন ডলারের। এ বিপুল ব্যবসার নেপথ্য নায়কও নরেন্দ্র মোদি। তাই গোটা ভারতে প্রশ্ন উঠেছে, ’৬০ সালে কলকাতার ময়দানে দাঁড়িয়ে চৌ এন লাই যে স্লোগান দিয়েছিলেন- ‘হিন্দি চীনি ভাই ভাই’ সে স্লোগান কি ঘুরে যাবে? অর্থাৎ হিন্দি-চীনি বাই বাই।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর