সোমবার, ২৯ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

সুইস ব্যাংক, কোটিপতি, জিডিপি ও চিড়েচ্যাপটা মধ্যবিত্ত

মনজুরুল আহসান বুলবুল


সুইস ব্যাংক, কোটিপতি, জিডিপি ও চিড়েচ্যাপটা মধ্যবিত্ত

এই করোনার সময়ে কিছুটা নিভৃত নিবাসে প্রায় সবই মন খারাপ করা খবর। এর মধ্যেই দুটি খবরে মন খুব ভালো হয়ে উঠল।

ভালো লাগার প্রথম খবর : সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) ২০১৯ সালে বাংলাদেশিদের মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাংক, বাংলাদেশের হিসাবে ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্রাংক ৯০ টাকা হিসাবে)। সংবাদমাধ্যমগুলো হিসাব-নিকাশ করে বলছে, এই টাকা দেশের প্রায় ১২টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। ২০১৮ সালে এ সঞ্চয় ছিল ৫ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান, বাংলদেশ এগিয়ে আছে পাকিস্তানের চেয়ে। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, তবে কোনো বাংলাদেশি যদি তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে টাকা জমা করে থাকেন, তার তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র সুইস ব্যাংকে জমা রাখা হলে সেগুলো আর্থিক মূল্য হিসাব করে আমানতে যোগ করা হয় না।

ভালো লাগা দ্বিতীয় খবরটি হচ্ছে : দেশে বাড়ছে কোটিপতি। ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার ৮৩৯টি। এই হিসাব ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই ছয় মাসে সেই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ তিন মাস আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে কোটিপতির হিসাব ছিল ৭৯ হাজার ৮৭৭টি। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে তিন হাজার ৯৬২টি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতির হিসাব ছিল ৭৫ হাজার ৫৬৩টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে আট হাজার ২৭৬ জন। পাকিস্তানের ২২ কোটিপতি পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বড় হয়েছে আমাদের প্রজন্ম। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে শুধু ব্যাংক হিসাবধারী কোটিপতির সংখ্যাই প্রায় ৮৪ হাজার! ভালোই তো, ভালো না? কিন্তু আমার এই ভালো লাগাতে জল ঢেলে দিল এ বিষয়ে যারা ভালো জানেন-বোঝেন তাদের বিজ্ঞ মন্তব্য ও ব্যাখ্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) ২০০৬-২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের বাজেটের প্রায় সমান। তারা বলছে, একক বছর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। জিএফআইয়ের হিসাবে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। তারা বলছেন, টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির রিপোর্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে অনেকের নাম পরিচয় উঠে এসেছে। মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে জানান হয়, মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। এ ছাড়া ব্রিটেন, হংকং, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের টাকা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। কাজেই সুইস ব্যাংকই দেশের টাকা পাচারের একমাত্র জায়গা নয়। এসব সমালোচনা আমলে নিয়েই বলি, কেউ যদি অনেক টাকার মালিক হন, বৈধ উৎস থাকে, সমস্যা কী? সেই বৈধ টাকা বৈধ পন্থায় যে কেউ তো দেশে-বিদেশে রাখতে বা বিনিয়োগ করতেই পারেন। কিন্তু হতাশার কথাটি হলো- বাংলাদেশি আইনে কোনো নাগরিকের বিদেশি ব্যাংকে আমানত রাখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে টাকা জমা রাখার বিশেষ অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে, তিনি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে এটা নিশ্চিত যে, সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাটাই দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তারপরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কীভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ হলো? কানাডায় কীভাবে ‘বেগম পাড়া’ হলো? সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট মোটা হলো? এসব প্রশ্নে কোনো জবাব নেই। অন্যদিকে দেশে কোটিপতি বাড়ার বিষয়টি নিয়েও বলা হচ্ছে সমাজে বৈষম্য ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে দেশে কোটিপতি বাড়ছে। উপরের দিকে যখন এই চিত্র, তখন দেশের মাঠের চেহারাটি কী?

বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, চলতি বছরের শুরুতে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বন্ধ হয়ে যায় আয়-রোজগারের পথ, বাড়তে থাকে দারিদ্র্য। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। বছর শেষে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, চলতি বছর শেষে গ্রামে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ২৩ এবং শহরে ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ হতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রামের চেয়ে শহরে দারিদ্র্যের হার বাড়বে। বলা হয়েছে, বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে যদি আয় ৫০ শতাংশ এবং শেষ প্রান্তিকে যদি ৫০ শতাংশ আয় উদ্ধার করা সম্ভব হয় তাহলে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে। শ্রমিকের আয় এ হারে উদ্ধার না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কেননা এরই মধ্যে শহরের শ্রমিকের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ এবং গ্রামীণ শ্রমিকের আয় কমেছে ১০ শতাংশ। বাড়ছে বেকার। করোনার আগে মোট বেকার ছিল ১৭ শতাংশ, করোনার কারণে নতুন করে ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। ফলে বেকার মানুষের সংখ্যা এখন ৩০ শতাংশ। এমএসএমই শিল্পের ক্ষতি ৯২ হাজার কোটি টাকা।

এ অবস্থাটা সামনে রেখে আমরা যদি দেখি তাহলে দেখব মহাবিপদে বেসরকারি খাত। এরা একেবারে চিড়েচ্যাপটা অবস্থায় পড়েছে । সংবাদমাধ্যম খবর দিচ্ছে, কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের একজন নন-এমপিও প্রভাষক এপ্রিল থেকে স্থানীয় বাজারে গরু-ছাগলের ওষুধ (ভেটেরিনারি মেডিসিন) বিক্রি শুরু করেছেন। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের এক শিক্ষক হাতে চক-ডাস্টারের বদলে তুলে নিয়েছেন কোদাল ও ঝুড়ি। বেতন বন্ধ মেহেরপুরের এক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক পেটের দায়ে চালাতে শুরু করেছেন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও যথাসময়ে টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় প্রায় ১৪ লাখ বেসরকারি শিক্ষক পরিবারে এখন দিশাহারা অবস্থা। বন্ধ তাদের টিউশনিও। সবচেয়ে বেশি বিপদে নন-এমপিও শিক্ষকরা। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ টানা চার মাস। বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও পড়েছেন সংকটে। দেশে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় এক লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেনে সাত লাখ শিক্ষক রয়েছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠান শতভাগই নির্ভরশীল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপরে। সারা দেশের ৩৫২টি অনার্স-মাস্টার্স কলেজের নন-এমপিও ১০ হাজার শিক্ষকও পড়েছেন দুর্দশায়। বিপন্ন জীবনযাপন করছেন ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও। দেশে এমন চার হাজার ৩১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১ হাজার শিক্ষক আছেন। সব মিলিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী, ১৪ লাখ শিক্ষক এবং আট লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শেষ খবর, করোনাকালে লক্ষাধিক নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে বিতরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। শিক্ষকদের এককালীন পাঁচ হাজার ও কর্মচারীদের দুই হাজার পাঁচশ করে টাকা দেওয়া হবে। অন্যদিকে এর মধ্যেই ঘোষণা এসেছে, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাটকলগুলো বন্ধের পরিকল্পনা করছে সরকার। বর্তমানে ২৫টি পাটকলে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। দেশের পাট খাতে ব্যক্তি খাতের অংশ এখন ৯৫ শতাংশ, মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি মিলগুলোর। সংসদে মন্ত্রী হিসাব দিয়েছেন : সরকারি খাতে চাকরিজীবী দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ ভাগ। তারা সবাই পেনশনসহ সব সুবিধা পান। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ৯৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র আট ভাগ ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। ২২ লাখ ব্যক্তিগত করদাতার মধ্যে ১৯ লাখ করদাতা বেসরকারি চাকরিজীবী। কিন্তু বেসরকারি খাতের এই পেশাজীবীরা এখন মহাবিপদগ্রস্ত অবস্থায় ।

সরকারি খাতের সঙ্গে বেসরকারি খাতের এই তুলনা হয়তো সরল সমীকরণ হবে। তবু শুধু বোঝার জন্য বলি, কয়েক মাস আগে পর্যটন শহর কক্সবাজারকে ‘ব্যয়বহুল’ শহর হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এর ফলে ওই এলাকার সরকারি চাকরিজীবীদের সরকারি বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। ঢাকাসহ দেশের ব্যয়বহুল এলাকাগুলোয় সরকারি চাকরিজীবীর সাধারণত মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পেয়ে থাকেন। এখন কক্সবাজারের চাকরিজীবীরাও তা পাবেন। বর্তমানে এই হার ৪৫ শতাংশ। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কক্সবাজার শহর বা পৌর এলাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিসহ বাড়িভাড়া, যানবাহনের ভাড়া, খাদ্য, পোশাক সামগ্রীসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বিবেচনায় কক্সবাজার পৌর এলাকাকে ‘ব্যয়বহুল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করি, কক্সবাজার শহর বা পৌর এলাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিসহ বাড়িভাড়া, যানবাহনের ভাড়া, খাদ্য, পোশাক সামগ্রীসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম যে বেড়েছে সেটা কি শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যই; নাকি সব মানুষের জন্যই? সবার জন্যই যদি ব্যয় বেড়ে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ বিশেষত নির্ধারিত আয়ের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের সুরক্ষা কই? এই সুরক্ষা কে দেবে? সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিক; কিন্তু কক্সবাজারের মধ্যবিত্তরা এই প্রশ্ন করতেই পারেন যে, সরকার কি তাহলে মধ্যবিত্তদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?

এদিকে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জনপ্রশাসনের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত হিসাবে এ খাতে সরকারের ব্যয় ৬০ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে তেলসমৃদ্ধ ধনাঢ্য দেশ ওমান নতুন নিয়োগ পাওয়া সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ কমিয়েছে। কৃচ্ছ্র সাধনে এরই মধ্যে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় কমিয়ে এনেছে ভিয়েতনামও। ভারত ও কম্বোডিয়াও এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। বেসরকারি খাতের চিত্র তুলে ধরে সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের ৬টি শিল্পাঞ্চলে ২৩ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। সরকার যে প্রণোদনা দিল এই অর্থ সহায়তা কি কেবল শিল্প মালিকদের জন্য? দেশের কী উপকার হলো? শ্রমিকদের কী লাভ হলো? অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। এক বেসরকারি উদ্যোক্তার কথা শুনুন : সীকম গ্রুপ ও প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমীরুল হক করোনার ক্ষতি পোষাতে ভবিষ্যতে কর্মী ছাঁটাই বা আর্থিক সুবিধা কমানোর পথে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ৩৬ বছর ধরে ব্যবসা করছি। কম বেশি মুনাফা করেছি। এখন দুই বা তিন মাস ব্যবসা খারাপ বলে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে, এটা ভাবলেই নিজের কাছে খারাপ লাগে। মনে হয় এত বছর ব্যবসা করে এক বছরের লোকসান বহন করার সক্ষমতাই যদি না থাকে, তাহলে এত বছর এ ব্যবসার মানে কী? এই দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। মধ্যবিত্তদের চিড়েচ্যাপটা করার সর্বশেষ উদাহরণ বিদ্যুৎ বিল। এমনিতেই দফায় দফায় পানি, বিদ্যুৎ দাম বাড়িয়ে মানুষকে যতটা সম্ভব চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। এই মহামারীর মধ্যে কোনো হিসাব-নিকাশ ছাড়া বিদ্যুতের বিল বানিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো জুনের মধ্যে এই বিল দিতেই হবে। ধারণা করি, শীর্ষ মহলের ধমকে একটু নড়েচড়ে বসেছেন মন্ত্রী; বলছেন, এসব ভুতুড়ে বিল যারা করেছেন তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। এর মধ্যে আবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ‘বছরে যত খুশি ততবার’ গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) বিল-২০২০’ উত্থাপন করা হয়েছে। বিজ্ঞজনরা বলছেন, যতবার গণশুনানিতে যুক্তি তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয় বরং কমানো উচিত এবং তা সম্ভব, ততবার বিইআরসি মত দিয়েছে দাম বাড়ানোর পক্ষে। কাজেই বিদ্যুৎ গ্রাহকরা প্রস্তুত থাকুন, এ বিল পাস হলে বছরে যতবার খুশি দাম বাড়বে। বিইআরসি প্রস্তুত আছে মধ্যবিত্তের কাঁধে নতুন বোঝা চাপাতে।

একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ‘দেশের প্রবৃদ্ধি শতকরা পাঁচ ভাগ লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যার কারণে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে মানে বড়লোক বাড়ছে। সাধারণ জনগণ প্রবৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না। তার প্রমাণ করোনার মধ্যে আমরা পেয়েছি। যাদের আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলি তারা মাসখানিক আয় না থাকায় টিকে থাকতে পারছে না। তার মানে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাছে টাকা-পয়সা নেই। দেশের অর্থ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাছে পুঞ্জি হয়ে আছে।’ সুইস ব্যাংকে টাকা আর কোটিপতি বাড়ার তথ্য তো সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

আমাদের উন্নয়নের কথা এলেই জিডিপির বিষয়টি সামনে তুলে ধরা হয়। এ বিষয়ে তরুণ ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং কনসালট্যান্ট মো. মহিউদ্দিন যে গল্পটা শুনিয়েছেন তা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। গল্পটি এ রকম, ইকোনমিক্সের বয়োবৃদ্ধ প্রফেসর তার মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন। রাস্তায় কিছুদূর গিয়ে তারা একটা মরা ইঁদুর দেখতে পেলেন।

প্রফেসর বললেন শোনো, তুমি যদি এই মরা ইঁদুরটা খেয়ে ফেলতে পার তাহলে তোমাকে ৫০ হাজার টাকা দেব। ছাত্রটি দ্রুতই কস্ট বেনিফিট এনালিসিস করে ইঁদুরটা গপ করে খেয়ে ফেলল। মরা ইঁদুরের বিকট স্বাদ পেটে যেতেই ছাত্রের মনে প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে হলো। কিছুদূর গিয়ে আরেকটা মরা ইঁদুর দেখতে পেয়ে ছাত্র প্রফেসরকে বলল, স্যার আপনি যদি এই ইঁদুরটা খেয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে আমিও আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দেব। প্রফেসরও ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি পূরণের আশায় ইঁদুরটা তুলে পেটে চালান করে দিলেন তক্ষুনি।

এরপর খানিকক্ষণ দুজনেই নিঃশব্দে পথ হাঁটছিলেন। নীরবতা ভেঙে ছাত্র প্রশ্ন করল, আচ্ছা স্যার, আপনার কি মনে হয় না, আমরা দুজন শুধু শুধু ফ্রিতে দুটো মরা ইঁদুর খেয়ে ফেললাম?

স্মিত হাস্যে প্রফেসর উত্তর দিলেন- কিন্তু জিডিপিতে এক লাখ টাকা বাড়ল, সেটা কি তুমি দেখবে না?

তারপর তিনি ব্যাখ্যা দিলেন : ধর আমার এক কোটি টাকা আছে, আমি ব্যাংক থেকে আরও এক কোটি টাকা লোন নিলাম, দুই কোটি টাকা দিয়ে একটা বিস্কুট কোম্পানি বানালাম, এর নাম দিলাম এবিসি বিস্কুট কোম্পানি। এবার একটা মার্চেন্ট ব্যাংকে গেলাম। মার্চেন্ট ব্যাংকের হেড অব অপারেশনকে বললাম আমার বিস্কুট কোম্পানিকে স্টক এক্সচেঞ্জ এনলিস্টেড করতে চাই। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়ম হচ্ছে মিনিমাম ৪০ কোটি টাকার নিচের কোনো পেইড-আপ ক্যাপিটালের কোম্পানিকে লিস্টেড করা যায় না, কিন্তু আমার কোম্পানি তো মাত্র দুই কোটি টাকার কোম্পানি। মার্চেন্ট ব্যাংকের হেড অব অপারেশন বললেন, সমস্যা নেই ভাই, আপনার কোম্পানি আমরা লিস্টেড করে দিব, কিন্তু শর্ত হচ্ছে আপনি আমাকে আট কোটি টাকা দিবেন। আমি কস্ট করব, আমার পারিশ্রমিক হিসাবে আপনি আমাকে আলাদা দুই কোটি টাকা দিবেন। এইটা আবার আমার ব্যাংক যেন না জানে, মোট ১০ কোটি টাকার ডিল।

আমি জবাব দিলাম, আমি কীভাবে ১০ কোটি টাকা দিব!

মার্চেন্ট ব্যাংকের হেড অব অপারেশন বললেন, আপনার নিজের পকেট থেকে এক টাকাও দিতে হবে না। আমরা মার্কেট থেকে আপনাকে টাকা তুলে দিব। আপনি ওখান থেকে আমাকে ১০ কোটি টাকা দিবেন। আপনি আপনার ৫০ পার্সেন্ট শেয়ার বিক্রি করবেন আর বাকি ৫০ পার্সেন্ট শেয়ার নিজের কাছে রেখে দিবেন।  এবার ওই মার্চেন্ট ব্যাংকের হেড অব অপারেশন অডিট ফার্ম গিয়ে বলল, এবিসি স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্টেড করব। অডিট ফার্ম বলল, কী করতে হবে শুধু হুকুম করেন। হেড অব অপারেশন বললেন, বেশি কিছু না, কেবল এই দুই কোটি টাকার কোম্পানিকে ৪০ কোটি টাকা ভ্যালুয়েশন করে দেখাতে হবে। অডিট ফার্ম বলল, ডিল। ডিল ফাইনাল হলো। এবার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে ‘ডিল’। সেটাও ফাইনাল। এবার দুই কোটি টাকার বিস্কুট কোম্পানিকে ৪০ কোটি টাকা দেখিয়ে আইপিওর জন্য অ্যাপ্লাই করা হলো, ৫০ পার্সেন্ট শেয়ার মানে ২০ কোটি টাকার শেয়ার মার্কেটে ছাড়া হলো, প্রিমিয়াম প্রাইস পাঁচ টাকা যোগ করে, সোয়া ৩০ কোটি টাকা। মানে এক কোটি টাকার অরিজিনাল শেয়ার বিক্রি করে মার্কেট থেকে তোলা হলো ৩০ কোটি টাকা। বাটোয়ারা হলো কথামতো। প্রথম স্টেজ শেষ। দ্বিতীয় স্টেজে কোম্পানি মার্কেটে লিস্টেড হলো আর আইপিও প্রাইস হলো ১৫ টাকা। এক একটা ১৫ টাকার শেয়ার ‘গর্দভ’ পাবলিক কিনল ৫০ টাকা। বাকি অরিজিনাল এক কোটি টাকার শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু ১০০ কোটি টাকা!!! নানা কাগুজে কসরৎ শেষে মাত্র এক পিস শেয়ার, মানে ১০ টাকার একটা নিজের কাছে রেখে আর বাকি সব শেয়ার বিক্রি করে দিলাম, পকেটে এ ঢুকলো আরও ১০০ কোটি। তারপর তো কোম্পানি তর তর করে বাড়ল। মালিকের চৌদ্দ প্রজন্মের তরক্কি হলো। প্রবৃদ্ধি বাড়ল। দেশের হলো ঘণ্টা!!

বৃদ্ধ প্রফেসর মরা ইঁদুর খেয়ে ও খাইয়ে জিডিপির যে চিত্র তার ছাত্রকে শেখালেন তা কষ্টকর। কিন্তু পরে যে চিত্রটা বলেছেন, সেটাই আজকের বাংলাদেশ। এখানে ব্যাংক খাওয়া, কোম্পানি খাওয়া, খোদ মন্ত্রণালয় খাওয়ার এত নজির আছে যে, আমরা কেন মরা ইঁদুরের কাছে যাব?

বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, করোনায় বিধ্বস্তদের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ, আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে আছেন। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেরই নিয়মিত বেতন হয়নি, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের বেশির ভাগই এখন কর্মহীন। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরও বেশি কষ্টে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, কাজের সংকট কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়ায় মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের বেশির ভাগই এখন সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাচ্ছে। ব্যাংকে থাকা যৎসামান্য ডিপোজিট বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা শেষ সম্বল হিসেবে থাকা সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে অনেকেই। এ জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের থাকা সঞ্চয়ের পরিমাণও কমে আসছে। এ ছাড়া অনেকেই ধারকর্জ করছেন। আবার ধার দেওয়ার মানুষের সংখ্যাও কমছে। এ অবস্থায় কোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত। যারা ধনী তারা দিন দিন ধনীই হচ্ছেন। আর যারা গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারা একটা বলয় থেকে বেরোতে পারছেন না। একদিকে চিকিৎসা অন্যদিকে জীবিকা নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী। আয় কমেছে, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়েছে। জীবন ও জীবিকার হিসাব মেলাতে হিমশিম অবস্থা। অনেকেই আবার সঞ্চয় ভেঙে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। হতাশায় অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে।

বুড়ো অধ্যাপকের অঙ্কে দেশের ঘণ্টা হলেও প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সুইস ব্যাংকে আমানত, বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা কিন্তু চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাচ্ছে দেশ, দেশের মধ্যবিত্ত। কী দ্রব্যমূল্য, কী বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল, কী সার্ভিস চার্জ, কী ব্যাংক আমানত, কী সঞ্চয়পত্রে সুদের হার, কী পরিবহন ভাড়া, বাসাভাড়া, কী স্বাস্থ্য-শিক্ষা খরচ সব কিছুতেই লাঠিটা পড়ছে নির্ধারিত বা সীমিত বা অনানুষ্ঠানিক আয়ের মধ্যবিত্তের মাথায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে, তারাই মধ্যবিত্ত। আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সামাজিক মর্যাদা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাকেও মানদন্ডে নিলে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা চার কোটির মতো। দেশের চার কোটি মানুষকে মানসিক অস্থিরতায় রেখে একটা সুস্থির সমাজ পরিচালিত হতে পারে না।

রাষ্ট্রক্ষমতায় এখন যে দল, সেই আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক মধ্যবিত্ত মানুষের ভরসার জায়গা। সেই দলটিকেই বলি, দেশের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীই যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

 [email protected]

সর্বশেষ খবর