বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনপুষ্ট কৃষিই হতে পারে রক্ষাকবচ

ড. আতিউর রহমান

করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনপুষ্ট কৃষিই হতে পারে রক্ষাকবচ

বিশ্বজুড়েই চলছে করোনা সুনামি। সর্বত্রই জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এর মোকাবিলা করছে। আমাদের জাতির পিতা ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, নানা দুর্ভোগেও তাঁর দেশবাসী কাবু হবে না। বরং ‘বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের ইচ্ছাশক্তির জোরেই জয়ী হবে শেষ পর্যন্ত।’ সেই একই রকম আস্থার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা চলমান বিশ্ব সংকট মোকাবিলায় জনগণের অজেয় প্রাণশক্তির ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যচ্ছেন। আর এ ভরসার কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষির অভূতপূর্ব শক্তিমত্তা। সারা বিশ্ব যখন করোনাকালে মহামন্দায় ভীতসন্ত্রস্ত তখন আমাদের চাঙ্গা কৃষি তার আশার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে চলেছে। মাত্র কদিন আগেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) জানিয়েছে, এ দুর্যোগের বছরেও খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হবে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, আমাদের জাতীয় খাদ্য চাহিদা ৩ কোটি ৩৩ লাখ মেট্রিক টনের মতো। আর অনুমান করা হচ্ছে, এ বছর মোট খাদ্য উৎপাদন হবে ৪ কোটি মেট্রিক টনের মতো। এ অঙ্ক ২০০৯ সালের খাদ্য উৎপাদন থেকে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। এ বছর আমাদের বোরোর বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। লকডাউনের মধ্যেও সরকারের সক্রিয় নীতি সমর্থন, স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সমাবেশের কারণে হাওর এলাকাসহ সারা দেশেই বোরো ধান সুষ্ঠুভাবে কাটা সম্ভব হয়েছে। এ দুঃসময়েও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ধান কাটা শ্রমিক ও হার্ভেস্টার সমাবেশ করতে সক্ষম হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসনের স্থানীয় কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ দিতেই হয়। এমনকি আঞ্চলিক শিক্ষা অধিদফতরও এগিয়ে এসেছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে আশা শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। পুলিশ বিভাগ এগিয়ে এসেছিল তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। সবাই মিলে কাজ করার জন্যই এবারে বোরো ধান কাটা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শুধু কাটা কেন, ধান ও চাল সংগ্রহেও সরকার যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ফলে এখনো কৃষক ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন। তাই আগামী ফসল ফলাতে তাদের যথেষ্ট আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশ্য, আঞ্চলিক বন্যায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বেশকিছু ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উপকূলীয় কৃষকের ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বাংলাদেশে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ অস্বাভাবিক নয়। সরকার প্রাকৃতিক এ সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট তৎপর। প্রধানমন্ত্রী করোনা সংকট সত্ত্বেও ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁর চোখ-কান খোলা রেখেছেন। প্রাকৃতিক ও করোনা সংকট মোকাবিলায় তিনি সামনে থেকে তাঁর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন সংকট মোকাবিলার জন্য কেমন করে জনবল ও সম্পদের সমাবেশ করতে হয়।

তবে খাদ্যশস্য উৎপাদন তথা সরবরাহই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষের হাতে ওই খাদ্য কেনার মতো সক্ষমতাও থাকতে হবে। আর সে কারণেই এবারের বাজেটে মানুষের কাছে খাবার ও অর্থ পৌঁছানোর জন্য সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দ যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রতিটি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকারপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে বিপন্ন মানুষের কাছে সরকারি সহযোগিতা ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর নিচ্ছেন। গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন নিশ্চিত করেছেন। অনানুষ্ঠানিক খাতের হঠাৎ আয় রোজগার হারানো মানুষের কাছে নগদ ও খাদ্য সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন। একই সঙ্গে কৃষক, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ হঠাৎ বেকার হয়ে যাওয়া মানুষের জন্য বিশেষ প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করেছেন। উদ্দেশ্য, গ্রামীণ অর্থনীতিতে যেন ভোগ বাড়ে। ভোগ বাড়লেই স্থানীয় চাহিদাও বাড়বে। আর চাহিদা বাড়লে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াবে। অর্থনীতি ফের স্থিতিশীল হবে। আর এভাবেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। তবে এ বিরাট কর্মযজ্ঞ শুধু একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যক্তি খাতে, অসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন তথা কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে। আর এ সংকটকালে ভালো উদ্যোক্তা, সমাজের সচ্ছল মানুষ এবং নানামাত্রিক সংগঠন এগিয়ে এসছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। এত কিছু সত্ত্বেও শহরের কম আয়ের মানুষের আয় রোজগার বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কর্মরত অনেকেরই কাজের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ছোটখাটো উদ্যোক্তা ও অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়ীরা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। অনেকে বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না। কম আয়ের বাড়ির মালিকদেরও তাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অনেকেই স্বাস্থ্য সংকটের কারণে উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে গ্রামে চলে যচ্ছেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের গ্রামে রেখে আসছেন। গ্রামীণ সমাজ এখনো অনেকটাই সংঘবদ্ধ। তারা শহর থেকে আসা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আত্মীয়স্বজনও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে গ্রামের মানুয়ের কৃষি এবং একই সঙ্গে বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পর্যাপ্ত আসার জন্য। খাদ্য উৎপাদন চাঙ্গা থাকার পাশাপাশি এ বছর রেমিট্যান্স প্রবাহও রেকর্ড ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। জুনেই রেমিট্যান্স এসেছে ১৮০০ ডলারের বেশি। সরকারের নগদ সহায়তা প্রদান ও হুন্ডি কমে আসায় রেমিট্যান্স এমন হারে বেড়েছে। আর গ্রামে প্রবাস আয় সহজে পৌঁছানোর জন্য মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ব্যাংকিং ও ব্যাংকের গ্রামীণ শাখাগুলোও বেশ তৎপর। এসব কারণেই গ্রামীণ অর্থনীতি এ ঘোর সংকটকালেও বেশ চাঙ্গা রয়েছে। কৃষি ও প্রবাস আয়কে সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রশংসা করতেই হয়। এর পাশাপাশি তিনি করোনা সংকটে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এ বছর রাজস্ব সংগ্রহের সম্ভাবনা কমে গেছে। তা সত্ত্বেও মানুষ বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি যে বাজেট দিয়েছেন তা এ সময়ে যথার্থই মনে হয়েছে। তবে এ বাজেটটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। এমন দুর্যোগকালে সবাই স্বচ্ছতার সঙ্গে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া অর্থ খরচ করে জনগণের সেবার মান বাড়াবেন সে প্রত্যাশা মানুষ করতেই পারেন।

গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর শক্তিশালী নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। এ বছর আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা সূচকে অভাবনীয় অগ্রগতির আশা করেছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাস আমাদের সেই চলার গতিকে হঠাৎ থমকে দিয়েছে। আমাদের সব পরিকল্পনা ও কৌশল উল্টে দিয়েছে। তবু আমরা আশা করছি আমাদের দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী আপৎকালীন, স্বল্পমেয়াদি, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে জীবন ও জীবিকা- উভয় খাতকেই সংরক্ষণ করবেন। নিঃসন্দেহে, তাঁর সরকারের পয়লা লক্ষ্য এখন অদৃশ্য এ ভাইরাসকে পরাজিত করা। সেজন্য দ্রুত স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে মানুষের করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত করা। সরকার সেদিকেই হাঁটছে। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে মানুষের সামাজিক সচেতনতা ও দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য আরও আগ্রাসী নীতি-উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। সরকার নিশ্চয়ই তা জানে এবং তার সক্ষমতা বাড়াতে তৎপর রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। ব্যক্তি খাতে ও এনজিও খাতের সক্ষমতাকেও অংশীদারিত্বের আওতায় এনে সরকার যুদ্ধকালীন সমাবেশের উদ্যোগ নিয়ে এ অদৃশ্য শত্রুকে (করোনাভাইরাস) নিশ্চয় কাবু করতে সক্ষম হবে- সে বিশ্বাস জনগণের রয়েছে। জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম সফল হলে জীবিকার সংগ্রাম এননিতেই সফল হবে। আর অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ জীবিকার সংগ্রামে বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে তার গ্রামীণ অর্থনীতি তথা কৃষির জোরালো অবস্থানের কারণে। বেশির ভাগ মানুষের আয় রোজগার কৃষিকেই ঘিরে। কৃষি বলতে শুধু ফসলের কথাই বলছি না। গ্রামে মাছ, মুরগি, গবাদি পশুসহ নানামাত্রিক উদ্যোগ গড়ে উঠছে। এ ছাড়া রয়েছে নানা নন-ফার্ম উদ্যোগ। শহরের বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের রিটেল আউটলেট এখন গ্রামে গঞ্জে প্রচুর চোখে পড়ে। লাইফস্টাইল পণ্যের চাহিদাও গ্রামে প্রচুর। তাই শিল্পায়নের সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির চাঙ্গাভাবের গভীর সংযোগ রয়েছে।

আমাদের অর্থনীতির এ শক্ত ভিত্তি এক দিনেই তৈরি হয়নি। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়েছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষির দিকে তিনি মনোযোগ দেন। শপথ গ্রহণের পরপরই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তাঁর তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সারের দাম ব্যাপক হারে কমিয়ে দেন। আর কৃষিতে ভর্তুকি (আসলে বিনিয়োগ) দিতে তাঁর সরকার কখনো কার্পণ্য করেনি। এ দুর্যোগের বছরেও বাজেটের ৫.৩ শতাংশ বরাদ্দ কৃষিতে দেওয়া হয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি বা বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এ বরাদ্দ। বীজ ও আধুনিকায়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। কৃষিযন্ত্রাংশে প্রণোদনা বাবদ একটি প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষকের জন্য স্বল্পসুদে প্রণোদনার পরিমাণ রাখা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক খুদে উদ্যোক্তাদের স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার জন্য এমএফআইদের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার পুনরর্থায়ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনার পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকটা পুনরর্থায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর একটি অংশই নারী উদ্যোক্তাসহ গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের কাছে যাবে বলে প্রত্যাশা করছি। তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক ও পিকেএসএফের মধ্যে গ্রামীণ নয়া উদ্যোক্তাদের দেওয়া হবে ২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংককে আরও ৫০০ কোটি টাকার পুনরর্থায়নের কথা ভাবছে। এর পাশাপাশি সরকার অনেক বছর থেকেই জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষির উন্নয়নে গবেষণা ও সম্প্রসারণ খাতে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। গত এক দশকে ১০৯টি জলবায়ুসহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা।

এ সবই সম্ভব হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে তৎপর প্রধানমন্ত্রীর নীতি সমর্থনের কারণে। সারা বিশ্বই তাঁকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব আর্থ’ বলে জানে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করেই তিনি বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে যে বিপ্লব এনেছেন তা বিশ্ববাসী জানেন। বাংলাদেশ সারা বিশ্বে দশম বৃহত্তম ফসল উৎপাদক, ধানে তৃতীয়, সবজিতে তৃতীয়, মাছে তৃতীয় এবং আমে সপ্তম উৎপাদক দেশ। বছরে ৭২ ধরনের ফল ফলে বাংলাদেশে। প্রত্যেকে গড়ে ৮৫ গ্রাম ফল খেতে পারে বাংলাদেশের মানুষ।

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্রুত সফলতা অর্জন করছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৬৭৮ মিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। বেশকিছু বাংলাদেশি করপোরেট এখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ছাড়াও সারা বিশ্বে কৃষি প্রসেসড পণ্য রপ্তানি করে বিপুল সুনাম অর্জন করেছে। এসবই সরকারের ইতিবাচক প্রণোদনামূলক নীতির কারণে সম্ভব হচ্ছে। কৃষকের জন্য ১ কোটির বেশি ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব, ২ কোটির বেশি কৃষি উপকরণ কার্ড, ৭ কোটির বেশি মোবাইল ব্যাংক হিসাব, প্রতিটি কৃষকের ঘরে বিদ্যুৎ, ১৫ হাজারের বেশি সৌর সেচ প্লান্টসহ নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে শেখ হাসিনার সরকার। ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার অর্থনৈতিক ডিজিটাল হাব তৈরির কাজ করছে সরকার। এসব ইউনিয়নে এখন হাইস্পিড ইন্টারনেট কানেকশন আছে। গ্রামীণ ডাকঘরগুলো এখন মোবাইল ব্যাংকের এজেন্ট, ই-কমার্স কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। দেশের তথ্য বাতায়নকে তথ্যসেবায় রূপান্তরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে এসডিজি পূরণের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কাউকে গৃহহীন রাখবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে এখন ব্যস্ত। সুন্দরবন সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার তৎপর বলেই সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ততটা ক্ষতি করতে পারেনি। জলবায়ুসহিষ্ণু বায়োডাইভারসিটি প্লাস কৃষি উৎপাদনে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন রয়েছে বলেই কৃষিবিজ্ঞানীরা খুবই তৎপর। আর সেজন্যই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। তবে হঠাৎ করে কভিড-১৯ এসে আমাদের অর্জন অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে নতুন করে গরিব ও বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা বাড়ায় আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। তবে এ সংকট কেটে গেলে আমরা দ্রুতই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে পারব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর তখন দারিদ্র্য ও বুভুক্ষুর সূচকে ফের আমাদের অগ্রগতি গতিময় হবে। করোনার এ দাপট আমাদের যে খানিকটা বেকায়দায় ফেলেছে সে কথা অস্বীকারের উপায় নেই। আমাদের কৃষি খাত এখনো চাঙ্গা থাকায় আমরা অনেক দেশের চেয়ে এ সংকট মোকাবিলায় ভালো করব বলে আশা করা যায়। আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা স্থিতিশীল রেখে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো নীতিনির্ধারকদের বেশ খানিকটা স্বস্তিতেই রেখেছে।

তবে কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণের চ্যালেঞ্জসমূহ এখনো বিদ্যমান। বড় পাইকারি বাজারের সঙ্গে সারা দেশের ছোট ও খুচরো বাজারের পুনঃ সংযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল ই-বাণিজ্যের প্রসার এখন সময়ের দাবি। পরিবহন চালু হলেও কৃষির সরবরাহ চেইন এখনো পুরো সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই দূরের কৃষক সবজি, মাছ, মুরগি, গরু ও দুধের উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না। ভাগ্যিস প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিযান শুরু করেছিলেন। তাই এ সংকটকালে ‘ফুড ফর ন্যাশনস’, ‘পাইকার ডট সেল’সহ অসংখ্য ই-কমার্স সাইট গড়ে উঠেছে। উদ্ভাবনীমূলক তরুণদের স্টার্টআপগুলো কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে দারুণ ভূমিকা রাখছে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের প্রশাসনের তরুণ কর্মকর্তাদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়েও এমন স্টার্টআপ গড়ে তুলতে উৎসাহ দিচ্ছেন। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় ফারমার্স মার্কেট সচল রেখেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগও বেশ তৎপর। বীজ ও চারা, ফসলের নানা সমস্যার বিষয়ে তারা সর্বক্ষণ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আর তথ্য বাতায়নকে রূপান্তর করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ‘ইকোনমিক হাবে’ পরিণত করতে পারলে তো কথাই নেই। তা ছাড়া লকডাউনের সময় অনেক কর্মকর্তা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করেছেন। সেনাবাহিনী উত্তরবঙ্গের চর থেকে মিষ্টিকুমড়ো কিনে তাদের সদস্যদের দিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও তা যাচ্ছে। এভাবে পুলিশ লাইনস, সরকারি হাসপাতাল ও জেলখানায় সবজি ও ফলমূল সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। ‘ম্যাংগো ট্রেন’ চালু করে শেখ হাসিনার সরকার তাঁর কৃষকপ্রীতির পরিচয় দিয়েছে। আম্ফানে পর্যুদস্ত কৃষকের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তা, কৃষকপ্রীতি ও সাহসী সেনাধ্যক্ষের মতো সামনে থেকে দুর্যোগ মোকাবিলা করছেন বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে। পুরো সমাজ তাঁর পাশে দাঁড়ালে নিশ্চয় এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া সহজতর হবে।

 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সর্বোতভাব জাগ্রত করা।’ সময় এসেছে তেমন সামাজিক জাগরণের। সরকার তার সাধ্যমতো করছে। সমাজকেও সচেষ্ট হতে হবে। নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। দুর্নীতিও আছে। এসব দিকে প্রধানমন্ত্রী নজর দিতে শুরু করেছেন। শক্ত হাতে তিনি ত্রাণ বিতরণের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন। স্বাস্থ্য খাতেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে আমার বিশ্বাস। আর এ খাতটি স্বচ্ছতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চললে এ দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা নিশ্চয় সফল হব। ’৯৮-এর বন্যা মোকাবিলা তিনি কী সাফল্যের সঙ্গে করেছেন তা আমাদের সবারই জানা। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তাঁর বিচক্ষণতাকে সারা বিশ্বই প্রশংসা করে চলেছে। মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। চলমান সংকট মোকাবিলায় তিনি একই রকম সাহসী ও মানবিক নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এবার তাঁর পাশে রয়েছেন আমাদের অন্যতম জাতীয় বীর কৃষক এবং তাদের সন্তানরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের সন্তান ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর কর্মীরা রাত-দিন কাজ করছেন। কৃষককন্যারা কারখানায় কর্মরত। কৃষকসন্তানরা রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর মতোই তাঁর কন্যাও কৃষকের কল্যাণে নিবেদিত। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে তাই তাঁর দুর্ভাবনা কম। তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করেন, কৃষির উন্নয়ন কৃষকের একার কাজ নয়। বিদ্বান ও বিজ্ঞানীকেও তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা কৃষিই পারে আমাদের বাঁচাতে। গত বিশ্বমন্দার সময় কৃষিই ছিল আমাদের ভরসার কেন্দ্রে। তারও বহু আগে ’৭১-এ মূলত এ কৃষকসন্তানরাই রক্ত ঢেলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। এবারও কৃষকবান্ধব বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সংকটের এ মহাসাগর নিশ্চয় পাড়ি দিতে পারব। আশা করছি এ ভাইরাস রোধে সহসাই টিকা মিলবে। আর তার পর থেকেই কৃষির হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

[email protected]

 

 

 

সর্বশেষ খবর