শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নূরে আলম সিদ্দিকী

স্বাধীনতার সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শতবর্ষে পদার্পণ করল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু করে। উল্লেখ্য, শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অনুষদেই কোনো ছাত্রী ভর্তি হননি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজ চাদরে ঢাকা রমনা এলাকার ৬০০ একর জমি নিয়ে গঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম শিক্ষাবর্ষে ৮৭৭ ছাত্র এবং ৬০ জন শিক্ষক নিয়ে এর সুদীর্ঘ পদচারণের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুভ সূচনালগ্ন থেকেই মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো তার দ্যুতি ছড়াতে থাকে। তখনকার অবিভক্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- সর্বত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এমন একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয় যে, সত্যি বলতে, এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শুধু অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, বিভিন্ন দেশ, এমনকি খোদ গ্রেট ব্রিটেন থেকেও এখানে জ্ঞান আহরণের অন্বেষণে ছুটে আসেন অনেকে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গাঢ় সবুজের মোড়কে আবৃত একটা প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি গৌরবান্বিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, বরং দিনে দিনে রাজনৈতিক সচেতনতার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাদপীঠ হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এর সবচেয়ে বড় গৌরবের দিক হলো- বিশ্ববিদ্যালয়টি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তিতে গঠিত হলেও পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয় চেতনার পীঠস্থান হিসেবে প্রতিস্থাপিত হতে পেরেছিল। বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার ব্যাপ্তি, বিকাশ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার চেতনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা বাংলার ইতিহাসের লালিত সম্পদ। পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর দুঃস্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে যে অনির্বাণ চেতনা ও আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল- তারও প্রসূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক, এ এফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. জ্ঞানচন্দ্র, ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখের মতো একঝাঁক প্রতিভাদীপ্ত শিক্ষক নিয়ে যাত্রা করা, অন্যদিকে গণতন্ত্রের শানিত চেতনায় উজ্জীবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিশ্বের এক বিস্ময়কর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে সফল নেতৃত্ব দিয়ে এভাবে সাফল্যের সোনালি সৈকতে পৌঁছে দিতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই।

স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতাকে সাফল্যের সৈকতে পৌঁছে দেওয়ার মূল কারিগর ছিল ছাত্রলীগ। এ আন্দোলনের মূল স্থপতি পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদকারী এবং রাজনীতির দিগন্তবিস্তৃত আকাশে বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির যাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন প্রদানের মধ্য দিয়ে। ৬ দফা কর্মসূচিটির গুরুত্ব প্রথমে আওয়ামী লীগ সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে না পারায় তখনকার ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের কাছে মুজিব ভাই ৬ দফা কর্মসূচিটি প্রচন্ড আবেগাপ্লুত হৃদয়ে তুলে দেন এবং তারা উভয়েই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ৬ দফার পক্ষে একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাই তো আমি বারবার বলি, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্য হিসেবে আখ্যায়িত করলে তাকে বক্ষে ধারণ করা দিগন্তবিস্তৃত আকাশ হলো ছাত্রলীগ। তাঁকে সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার উচ্ছ্বসিত ঊর্মিমালা হলো ছাত্রলীগ। তাঁকে বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার মাটিতে প্রোথিত শিকড় হলো ছাত্রলীগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দাঁড়িয়ে বাংলার চারণকবির মতো আমার কণ্ঠে যখন এই পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারিত হতো, তখন সভায় উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চিত্ত তো উদ্বেলিত হতোই, তখন আমার কাছে মনে হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গাছের পত্র-পল্লব, প্রতিটি ইট-পাথরের কণায় কণায় অনবদ্যভাবে এই সুর ঝঙ্কারিত হতো। যেটা সমগ্র শ্রোতাকে এবং আমার বিমুগ্ধ চিত্তকে উদ্বেলিত করত, উচ্ছ্বসিত করত, একটি সম্মোহনী সুরের স্রোতধারায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত। আজও আমার স্মৃতিতে বারবার ভেসে ওঠে বিশ্বকে অবাক করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব গৌরবদীপ্ত সোনাঝরা অজস্র স্মৃতিমালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিকে জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর স্রোতস্বিনী অনন্ত নদী, অন্যদিকে আন্দোলনের দাবানল বক্ষে লালন করা একটি জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস। যদিও তখনকার আন্দোলনের শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল জগন্নাথ কলেজ। জগন্নাথ কলেজ ও তখনকার কায়েদে আজম কলেজ (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে মিছিল না এলে আমতলা অথবা বটতলা- কোনো সভাই জমে উঠত না। তবু স্বীকার করতেই হয়, শুধু ছাত্রলীগই নয়, সব ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচারাভিযান শুরু করে। এসব দাবির প্রতি কোনো পরোয়া না করে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার স্থান না হওয়ায় ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পুলিশ বিক্ষোভে লাঠিচার্জ করে ও কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার নেতাদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এর চার দিন পর পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্পষ্ট ঘোষণা দেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ সাহেব ভাষণ দেন। সেখানেও তিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দেন যে, ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু এলোন শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের পক্ষে থেকে তীব্র কণ্ঠে একটি ‘না’ উচ্চারণের মাধ্যমে এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানানো হয়। মার্চের ২৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি প্রতিনিধি দল জনাব জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, মোহাম্মদ তোহা, আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, নাঈমউদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম ও নজরুল ইসলাম।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও সরকারবিরোধী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। এটি মুসলিম লীগ সরকারের স্পষ্ট বিরোধী একটি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৮ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হলে লিয়াকত আলী খান নিশ্চুপ থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাঙালি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা, মানসিকতা- সবকিছুর উন্মেষ বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ৩ মার্চ যে ধর্মঘট শুরু হয়, সে ধর্মঘটেও ছাত্রলীগকে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমাদের মুজিব ভাইকে শাস্তিস্বরূপ ১৫ টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি তা দিতে অস্বীকার করলে গ্রেফতার হন এবং ’৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন চলার সময় কারাগারে থেকে অনশন ধর্মঘটের মাধ্যমে এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি ও প্রতীতি ঘোষণা করেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা ও মানসিকতাকে পদদলিত করার কুটিল ষড়যন্ত্রে মানসিকতায় এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের চারণক্ষেত্র বানানোর লক্ষ্যে এবং লিপ্সায় এই বাংলার মানুষের বুকের রক্ত জোঁকের মতো শুষে নিয়ে রক্তশূন্য করার লিপ্সায় তাদের নির্মম রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিগ্রহ চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খন্ড খন্ড মিছিল বের হলে পুলিশ প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং এক পর্যায়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে সালাউদ্দিন, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বার শহীদ হন। সমস্ত বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা ও দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে।

’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের বাহ্যিক দাবি ছিল হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মূল সত্তাটি ছিল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থা বাতিল করে সর্বজনীন ভোটাধিকার অর্জনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ আন্দোলনটি ব্যাপক সফলতা লাভ করে। যার ফলে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায় এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্নে মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিটি বহাল থেকে যায়। এ প্রশ্নে আইয়ুব খান অনড় ছিলেন। ওই সময়ের আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মৌলিক গণতন্ত্রের পন্থার বিপরীতে ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেম মেনে নিতেও আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্মত ছিলেন। কিন্তু আইয়ুব খান এ প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি হননি। মাদার-এ-মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে ১৯৬৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিও মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একমাত্র চালকের আসনে না থাকলেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটা বলে রাখা অত্যাবশ্যক, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞানচর্চার প্রশ্নে নিঃসন্দেহে প্রাচ্যের শীর্ষস্থানে অবস্থানের ক্ষেত্রে কখনোই কোনো হেরফের হয়নি। তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের তথা ভারতবর্ষের সর্বশীর্ষে অবস্থান করত। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের আগ্রহের প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল বলেও তখনকার ইতিহাস থেকে জানা যায়।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষকম-লীর মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ফজলুল হালিম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, ড. ললিত মোহন নাথ, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁঞা, ড. হিরণ¥য় সেনগুপ্ত প্রমুখ। প্রসিদ্ধ শিক্ষকের সমাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিকে সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। এর প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ, পরবর্তীতে মাহমুদ হাসান এদের সযত্ন লালিত্য ও প্রতিভাদীপ্ত চেতনায় উদ্ভাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ উপমহাদেশে গৌরবমন্ডিত এবং জ্ঞানে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো বিকীর্ণ অগ্নিকণায় সত্যিকার অর্থে একটা জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের জ্ঞানপিপাসুদের নজর কাড়ে। আপন মহিমায় বিকশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের একটি অনন্যসাধারণ খ্যাতির সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গমালায় অবস্থিত বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন সময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন এ পর্যন্ত ৪৯ জন। পৃথিবীখ্যাত  কীর্তিমানরা এ ডক্টরেট ডিগ্রির সম্মান অর্জন করেছেন। তাঁর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, এ কে ফজলুল হক, স্যার যদুনাথ সরকার, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, আবদুস সালাম, চু এন লাই, ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ, বান কি মুন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অমর্ত্য সেন, প্রণব মুখার্জি প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। মর্যাদার দিক থেকে এ সম্মানসূচক ডিগ্রি নোবেল প্রাইজের পরই অবস্থান করে।

আমাদের সময়ে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতার চেতনাটি তিলে তিলে বাস্তব রূপ নিতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর শাজাহান সিরাজ যখন সাধারণ সম্পাদক ও আমি সভাপতি নির্বাচিত হই, তখন ক্রমান্বয়ে বিস্তীর্ণ বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাত্রলীগের পরিপূর্ণ করায়ত্তে চলে আসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনে ছাত্রলীগের প্রায় সব সভা কানায় কানায় ছাত্র-ছাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সরাসরি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ যে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে, তখনকার সর্বজনপঠিত বাঙালির চিন্তার দর্পণ ইত্তেফাক আট কলাম কাঠের শিরোনাম করেছিল- ‘এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া? বালির বাঁধ?’ ওই নির্বাচনের পর ছাত্র-ছাত্রীরা তো বটেই, সমগ্র শিক্ষকসমাজ ছাত্রলীগের প্রতি প্রচ-ভাবে আকৃষ্ট ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের আবেগাপ্লুত হৃদয়ের প্রত্যক্ষ সমর্থন দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করে।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের দোতলার বারান্দায় অসংখ্য চেয়ার পেতে সব বিভাগ ও অনুষদের শিক্ষক আমাদের বক্তৃতা শুনতে আসতেন। অর্থাৎ, তাঁদের হৃদয়ের সমর্থন প্রকাশ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা নয়, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিগন্তবিস্তৃত আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত করে উপাচার্য হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী এসেও যখন শিক্ষকদের সঙ্গে বারান্দায় বসতেন, তখন সবার মধ্যে যে আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি হতো, তা অবর্ণনীয়। আমি অজানা এক বিস্ময়কর উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে পাগলপ্রায় উত্তেজনায় বক্তৃতা করতাম। ছাত্রসভার কলেবর তো বটেই, শিক্ষকবৃন্দ- বিশেষ করে আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করত। তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল তরঙ্গমালা সারা বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতার হৃদয়কে এমনভাবে আপ্লুত করে যে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকা এ চেতনার পথে একান্তভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। জীবনের সব নদী সমুদ্রের মোহনায় এসে অভূতপূর্বভাবে একই স্রোতধারায় মিলিত হয়ে যায়।

সেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পেছনের অভিসন্ধিটা শুধু ভাষাকেন্দ্রিক ছিল না। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের চারণক্ষেত্র বানিয়ে বাঙালি জাতিকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার দুরভিসন্ধি ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো- ’৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের (টু নেশন থিওরি) ভিত্তিতে যে দেশটির জন্ম হলো এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বুক উজাড় করে পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট প্রদান করল, তারাই ’৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর উক্তির শুধু প্রতিবাদই করল না, ’৫৪-এর নির্বাচনে শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয়ের মাধ্যমে গঠিত প্রাদেশিক পরিষদে সর্বসম্মতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস সৃষ্টি করে। যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। এ সফল আন্দোলনের উদ্ভব, বিস্তৃতি ও সফলতা সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং এর সাফল্যের পেছনে পরিচালিত আন্দোলন সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। তারই রেশ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ও সফলতার পাদপীঠ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা যায়। আমতলা ও বটতলা এ দুটিই ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে ৬ দফাভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এর উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার পাদপীঠ হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও মধুর ক্যান্টিনের কর্মিসভা, বটতলা ও আমতলার ছাত্রসভায় জগন্নাথ কলেজের জাগ্রত মিছিলই প্রাণ সঞ্চার করত; তবু ’৬৯-এর গণঅভুত্থানেরও লীলাক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় দাঁড়িয়ে আমি প্রায়শই আমার বক্তৃতায় উদ্ধৃত করতাম- গোকলে বলতেন, what Bengal thinks today, the whole India thinks it tomorrow. এর সূত্র ধরে আমি বলতাম, what we think today, the rest of politicians think it tomorrow. এরই ধারাবাহিতায় ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রলীগের একক বিজয়ের গৌরব অর্জন এবং ’৭০-এর নির্বাচন ও ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভে মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়।

এ দেশের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়ে এবং ’৭১-এর মার্চে ঐতিহাসিক গণজাগরণ তৈরি ও তাকে লালন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার সফলতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব প্রভাবকে অবারিত চিত্তে স্বীকৃতি দিতেই হয়। পৃথিবীর কোনো জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনকি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনেও ছাত্রদের এমন ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা কোনো দিনই ছিল না। ভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে অবশ্যই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু সমগ্র আন্দোলনের মূর্তপ্রতীক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি। তবু বলি, এ আন্দোলনের মূল কারিগর হলো ছাত্রলীগ। এই নিরিখে নিশ্চিতভাবে উপসংহার টানা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ যে একটি সমুদ্রের মোহনায় একীভূত চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে সব মানুষ উদ্বেলিত চিত্তে এক ও অভিন্ন সত্তায় বিলীন হয়ে যায়, সেখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব ছিল অভাবনীয়।

দেশমাতৃকার স্বাধীনতার অনিবার্য প্রয়োজনে সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজকে উজ্জীবিত, উদ্বেলিত ও ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার ফলে সংগ্রাম পরিষদে এবং সারা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের অনন্যসাধারণ প্রভাব বিস্তৃত হয়। এই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জন্ম, এর প্রজ্বলিত ইতিহাস ও আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত সংগ্রামের অগ্নিকণার মূল পটভূমি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ছাত্রদেরই নয়, তৎকালীন উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরীসহ শিক্ষকদেরও উদার, উন্মুক্ত, অবারিত এবং হদয় নিংড়ানো সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা ওই আন্দোলনকে প্রচন্ড বেগবান হতে সাহায্য করেছিল। শিক্ষকদের এ সমর্থন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবকে সমৃদ্ধ করেছিল। আমি মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল নানা কর্মকান্ডের মধ্যে এ সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা ঐতিহ্যের হিমাচলের মতো যুগ যুগ ধরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে ইতিহাসে সমুন্নত করে রাখবে।

                লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর