শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

হাটে পশু না ই-মার্কেটে

শাইখ সিরাজ

হাটে পশু না ই-মার্কেটে

কোরবানির হাট থেকে নিরাপদ রাজস্বের বন্দোবস্ত করতে পারত সরকার। অন্যদিকে মানুষও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঠিকই কোরবানির আয়োজন করতে পারত। বলছিলাম একটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির কথা, যা এখনো হয়নি, হবে কিনা জানি না। আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ মানুষ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে জীবনযুদ্ধরত। মারা গেছেন ৫ লাখ ১৬ হাজার ২১০ জন। বাংলাদেশেও সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দেড় লাখ। মারা গেছেন ১ হাজার ৯২৬ জন। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর মাঝেই দিনকয়েক আগে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ঘোষণা করেছেন সব স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনেই পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে। বাংলাদেশে মাঠে কোরবানির পশুর হাট বসিয়ে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মানানো অসম্ভব। গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও করোনাভাইরাসের সংক্রমণে কোরবানির পশুর হাট স্বাস্থ্যঝুঁঁকিকে ভয়ানক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত রোজার ঈদেও দোকানপাট খোলার সময় বলা হয়েছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে লোকজন কেনাকাটা করতে যেতে পারবে। বলা হয়েছিল, নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থায় মানুষ গ্রামে যেতে পারবে। কিন্তু আমরা দেখেছি মানুষ কতটা স্বাস্থ্যবিধি মেনেছে, কতটা মানেনি। তখনকার সেই ভুল সিদ্ধান্তগুলোর কারণেই আজকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। সেদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোটি কোটি মানুষের করোনা পরীক্ষা সম্ভব নয়। কিন্তু আগে থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আজ কোটি কোটি মানুষের করোনা হয়তো পরীক্ষার প্রয়োজন হতো না। সত্যি বলতে, শুরু থেকেই স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে সরকারের অন্য দফতরগুলোর সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যা হোক, এবার খোলা মাঠে গরুর হাট বসানো হলে আরও বড় ধরনের সর্বনাশ যে হবে না তার নিশ্চয়তা দেবে কে? প্রতি বছর কোরবানির হাট ঘিরে বড় ধরনের বাণিজ্য চলে। কোরবানি ঘিরে তৈরি হয়েছে একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। খামারিরা সারা বছর ধরে গরু মোটাতাজা করে। ঈদের মৌসুমে সে গরু হাটে নিয়ে যায়। এর সঙ্গে জড়িত বিপুল পরিমাণ মধ্যস্বত্বভোগী। হাটের ইজারা, হাসিল, গরুর ট্রাক বা ট্রলার থেকে চাঁদা আদায়ে প্রভাবশালীরাও জড়িত থাকে। আগেই বলে নিচ্ছি, আমি কিন্তু বলছি না বা বলবও না কোরবানির গরু বেচাকেনা না হোক। কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। আমি চাই যথাসময়ে কোরবানির পশুগুলো বিক্রি হোক। কারণ কোরবানির পশুগুলো বিক্রি না হলে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হবে খামারিরা। একটা গরুর পেছনে প্রতিদিনই তার খরচ আছে, যত দিন গরুটাকে গোয়ালে বা খামারে রাখতে হবে তত দিনই খরচ বাড়তে থাকবে। কোরবানির পশুর হাট না বসলে দ্বিতীয়ত ক্ষতির শিকার হবে সরকার বা প্রশাসন। কারণ হাটের ইজারা থেকে একটা বড় রাজস্ব তাদের তহবিলে আসে। আর মধ্যস্বত্বভোগী যারা ইজারা নেন, হাসিল আদায় করেন, পশু পরিবহন করেন তাদের হিসাব শুধু আয় হবে না। এ আয় না হওয়ার ভয়েই হাট বসানোতে আগ্রহ অনেকের। অর্থাৎ করোনার প্রকোপকে তোয়াক্কা না করে কোরবানির পশুর হাট বসিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের আয়টাকেই কি নিশ্চিত করতে চাচ্ছি! অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশে এবার অনলাইনেই হতে পারত কোরবানির পশুর সম্পূর্ণ কেনাবেচা। কীভাবে। বলছি। তার আগে ১০-১১ বছর আগের একটি ঘটনা বলি। সময়টা ঈদুল আজহার ১৫-২০ দিন আগে হবে। আমার অতিপরিচিত এক কৃষক ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন আমি কোরবানির পশু কিনব কিনা। তিনি সম্পূর্ণ দেশি পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক উপায়ে ঘাস-খড় খাইয়ে গরু লালনপালন করেছেন। আমি চাইলে তার কাছ থেকে গরু কিনতে পারি। আমি বললাম, কোরবানির পশু না দেখে আমি কিনি না। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, কেন স্যার! আপনার ই-মেইল অ্যাড্রেস নাই? আমি বললাম, ই-মেইল অ্যাড্রেস থাকবে না কেন? ই-মেইল অ্যাড্রেস আছে। কোরবানির সঙ্গে ই-মেইল অ্যাড্রেসের কী সম্পর্ক? তিনি বললেন, তার সব গরুর ছবি তুলে, ভিডিও করে, ওজন, মাপ বিস্তারিত সেই ই-মেইলে পাঠিয়ে দেবেন। আমি শুধু বাছাই করে দিলেই তিনি আমার জন্য কোরবানির গরু পাঠিয়ে দেবেন। ১০-১১ বছর আগে এক কৃষক যদি অনলাইনে গরু বেচাকেনার কথা চিন্তা করতে পারেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সময়ে এসে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কেন এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারলেন না! যেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের সব অবকাঠামোই সরকার তৈরি করে রেখেছে। করোনার সংক্রমণ প্রথম শনাক্তের দিন থেকে প্রায় চার মাস হতে চলল। করোনার সংক্রমণের এই সময়ে কোরবানির পশুর হাট বসানো নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, বিষয়টা তো আগেই অনুমান করা যাচ্ছিল।

গত বছর কোরবানির বাজারের জন্য প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ গবাদি পশু। এবার হয়তো সংখ্যাটা বেড়ে ১ কোটি ২০ লাখ হতে পারে, কিংবা এর আশেপাশেই থাকবে। গত বছর ডেঙ্গু ও বন্যার কারণে কোরবানির পশু কম বেচাকেনা হলেও সংখ্যাটি একেবারে কম নয়। প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার নামে একটি তথ্যসেবা কেন্দ্র আছে। সারা দেশে এ সেন্টারের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৭৫টি। সরকার বিশাল অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে সেখানে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করে নিয়েছে। দুই মাস আগে থেকেই এ ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে আমরা কি কাজে লাগাতে পারতাম না? কোরবানির পশু কেনাবেচার একটা ডিজিটাল প্ল্যাটফরম তৈরি করা কি খুব কঠিন কাজ ছিল! মোটেই না। আমাদের যেটার অভাব ছিল, সেটা হচ্ছে সুপরিকল্পনা আর ইচ্ছা। একটা নির্দিষ্ট ফি দিয়ে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কিংবা খামারিরা নিজেরাই একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফরমে গরু বা খাসির ছবি ও তথ্য আপলোড করার সুবিধা তৈরি করে দেওয়া যেত। পশু কেনাবেচার ওপর সরকার একটা ফি ধরে দিতে পারত। গবাদি পশু পরিবহনের জন্য এবং কোরবানির কাজ পরিচালনার জন্যও এলাকাভিত্তিক টিমের ব্যবস্থা করা যেত। একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিতর দিয়ে অনলাইন পশুর বাজারটি চালু করা যেত। এ পরিস্থিতিতে এটা খুব সহজেই জনপ্রিয় করা সম্ভব ছিল। মনে করিয়ে দিতে চাই, এই তো গেল মধুমাসে আম, লিচু যতটুকু খোলাবাজারে বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে সম্ভবত বেশি বেচাকেনা হয়েছে অনলাইনে। এর জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। রাজশাহী অঞ্চলের হোটেল, পরিবহনব্যবস্থা, ব্যাংকগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করতে আগেই স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে একটা পরিকল্পনা স্থির করে নিয়েছিলেন। বলা প্রয়োজন, সুপরিকল্পনার কারণেই এবার যথাসময়ে হাওরাঞ্চলের ধান ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরেই অনলাইনে কোরবানির পশুর হাট সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে। এবার সেগুলোকে আরও সম্প্রসারিত বা জোরদার করার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের কোনো আগ্রহ দেখিনি।

যদি ঢাকার কথাই ধরি করোনার কারণে বাজারের সংখ্যা যদ্দুর জানি কমানো হয়নি, এমনকি জায়গা পরিবর্তনের বিষয়টিও আমলে নেওয়া হয়নি। অধিকাংশ হাটই বসবে রাস্তা ও লোকালয়ে। ঢাকা উত্তরে গত বছর নয়টি থাকলেও এবার আরেকটি অস্থায়ী হাট বাড়ছে, গাবতলীর স্থায়ী হাটটিসহ এবার ১০ জায়গায় ইজারার প্রস্তুতি চলছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত বছরের মতো এবারও ১৪টি পশুর হাট ইজারা দিয়েছে। অর্থাৎ এবারও ঢাকার দুই সিটি মিলিয়ে পশুর হাট বসবে মোট ২৪টি। সারা দেশের জেলা-উপজেলায়ও পশুর অস্থায়ী হাট বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে অনুমোদনের বাইরেও কোরবানিতে আরও অনেক হাট বসে। সব মিলিয়ে এ হাটের সংখ্যা সারা দেশে ৫ হাজারের কম হবে না। এখন পর্যন্ত গ্রামগুলোয় করোনার সংক্রমণ সেভাবে পৌঁছায়নি। কিন্তু কোরবানির পশুর হাটে গ্রাম থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা এসে, শহরে দু-তিন দিন অবস্থান করতে হবে। তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফেরার সময় নিজের অজান্তেই শরীরে করে নিয়ে যেতে পারে এ মহামারী। এতে গ্রামগুলোতেও মহামারী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যদিও বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি বলতে কী বোঝানো হচ্ছে আর বিধিমালাটাই বা কী? আমরা জানি, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ৬২ পৃষ্ঠার একটি নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে। এ ছাড়া কোরবানির পশুর হাটের বিষয়ে আর কোনো গাইডলাইন আছে কিনা জানি না।

শুধু পশুর হাট নয়, প্রচলিত পদ্ধতিতে পশু কোরবানিও স্বাস্থ্যঝুঁঁকি বাড়াবে। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কীভাবে পশু কোরবানি সম্পন্ন ও বিলিবণ্টন করা যেতে পারে তার জন্য সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতি বছর কোরবানির জন্য গ্রামগঞ্জ থেকে হাজার হাজার অপেশাদার মৌসুমি কসাই শহরাঞ্চলে অবস্থান করেন। এ বছরও হয়তো অনেকেই গ্রাম থেকে এসে কোরবানির জন্য শহরে অবস্থান করবেন। তারাও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকবেন।

করোনার কারণে অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়ছে, কথাটি শতভাগ ঠিক নয়। করোনায় সুপরিকল্পনার অভাবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সুপরিকল্পনা থাকলে যে করোনায়ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যেতে পারে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান। কিন্তু আমরা যেভাবে হাটবাজার খুলে দিচ্ছি তাতে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতি বাঁচবে কিনা জানি না, মানুষ বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে। এখনো সময় আছে, পরিকল্পনা করে কোরবানির পশুর অনলাইন বাজার চালু করা হোক। আমরা জানি, গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে কোরবানির পশুর হাটের একটা বড় সংযোগ রয়েছে। সে সংযোগ বজায় রাখতে ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে কাজে লাগানো হোক। এ কোরবানির ওপরে আমাদের চামড়াশিল্পও অনেকটা নির্ভরশীল। তাই সব দিক রক্ষা করতে এবার কোরবানির পশুর হাটের জন্য অনলাইন হাট এবং ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া উচিত। মানুষকে বাঁচিয়েই অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর