রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

অক্ষম ও সক্ষম স্থানীয় সরকার

মোশাররফ হোসেন মুসা

অক্ষম ও সক্ষম স্থানীয় সরকার

এককথায় বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার অক্ষম স্থানীয় সরকার। এটি এখনো কেন্দ্রীয় সরকারের দয়া ও নির্দেশে চলে। ফলে স্থানীয়দের সরকার গড়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া আছে ততটুকুও অনুশীলন করতে দেখা যায় না। এবার করোনা মহামারীতে তা শতভাগ প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সরকার বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ শক্তিশালী ও স্বাধীন। মজার বিষয় হলো, তাদের সক্ষমতা থাকার পরও এবার করোনাকালে তারাও দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান এমনকি স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীও সরবরাহ করতে পারেনি। তবে তাদের সঙ্গে তুলনা করে তৃপ্তি পাওয়ার কিছু নেই। কারণ তারা করোনা সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে অচিরেই ভুলগুলো শুধরে নেবে। সম্প্রতি রাজনীতিক আ স ম আবদুর রব এ বিষয়ে সুন্দর মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশে একটি কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা থাকলে করোনা মোকাবিলায় আজ এ ভয়াবহ অবস্থা হতো না। একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকারের পক্ষে করোনা পরীক্ষা, রোগী শনাক্তকরণ, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ও অন্য সেবা প্রদান সম্ভব হতো। তা ছাড়া করোনা মোকাবিলায় আঞ্চলিক লকডাউনের ধারণা স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথাই প্রমাণ করছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১ জুন, ২০২০)। এবার ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি করায় বেশ কয়েকজন স্থানীয় প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মিডিয়া বিষয়টি এমনভাবে প্রচার করেছে, যেন স্থানীয় সরকার মানেই দুর্নীতির আখড়া। তাহলে কি কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতিমুক্ত? জনৈক সংসদ সদস্য কুয়েতে যে পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন স্থানীয় প্রতিনিধিদের দুর্নীতি কি তার চেয়েও বেশি? তবে এটা ঠিক আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারে যোগ্য লোক নির্বাচিত হয়ে আসার পথ দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সেটা কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রুটিযুক্ত বিধিব্যবস্থার কারণে হচ্ছে। আসলে এ দেশে সরকারব্যবস্থা নিয়ে খুব কম লোকই চিন্তাভাবনা করেন। অনেকেই জানেন না, নিউইয়র্কের সিটি গভর্নমেন্টের বাজেট আমাদের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি (সিটি গভর্নমেন্টের বাজেট ৮৫ বিলিয়ন ডলার)। সেখানে ওই বিশাল বাজেট ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত মেয়র, কাউন্সিলর, কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিচারক, পুলিশ বাহিনীসহ সব বিভাগের লোক আছে। অর্থাৎ সরকার বলতে যা বোঝায় তার পুরোটাই রয়েছে সেখানে। ধরা যাক, একটি ইউনিয়নে ৫০ কোটি টাকা খরচ করার স্বাধীনতা দেওয়া হলো (বাস্তবে তার চেয়েও বেশি হচ্ছে, তবে সেটা স্থানীয় সরকার করছে না, কেন্দ্রীয় সরকার করছে)। তাহলে দেখা যাবে সেখানে উপযুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন। জনগণও উপযুক্ত ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার জন্য উৎসাহী হবেন। একই কারণে সেখানে উপযুক্ত কর্মকর্তা/ কর্মচারী নিযুক্ত হবেন। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদকে ১০টি বাধ্যতামূলক ও ৩৮টি ঐচ্ছিক কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। ইউনিয়ন পরিষদ যদি ইচ্ছা করে তাহলে তার সীমানায় জনগণকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারে। যেমন- মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করা, সাবান দিয়ে হাত ধৌত করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এ তিনটি কাজ তারা সহজে করতে পারে। প্রয়োজনে লকডাউন ঘোষণাও করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার কারণে এসব কাজ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে করতে দেখা গেছে। একই কারণে স্থানীয় সরকার স্বেচ্ছায় কিছু করতে আগ্রহী হয় না। এবার করোনাকালে স্থানীয় সরকার কয়েক হাজার টন চাল, নগদ ৮০-৯০ কোটি টাকা, ঘর তৈরির ঢেউটিন, দুস্থ মায়েদের মাঝে প্যাকেট দুধ বিতরণ করেছে (এখনো করছে)। সেগুলো করা যদি সম্ভব হয়, তাহলে নগদ ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে তারা কেন পারবে না? উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী গত ঈদুল ফিতরের আগে দুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে মোবাইল ফোনে বিকাশের মাধ্যমে ২ হাজার ৫০০ টাকা প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এ উদ্যোগ সফল করতে তথা একটি নির্ভুল তালিকা তৈরি করতে সচিবালয়, বিভাগীয় কমিশনার অফিস, ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোকে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে টাকা বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, অনেকের আইডি কার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে সিম কার্ডের নিবন্ধন না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ ছাড় করছে না। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান, বহু গরিব মানুষ আছে যারা সিম নিবন্ধনের নিয়মটি বোঝে না। কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের নামে তোলা সিম ব্যবহার করছে। সেজন্য স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ছাড়া শাসনগত সমস্যা দূর হবে না। তার আগে সরকারের প্রকারভেদকরণ, স্তরবিন্যাসকরণসহ নির্বাচন পদ্ধতি পাল্টাতে হবে। সিডিএলজি দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছে এ দেশের আয়তন, জনসংখ্যা, ভূপ্রকৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থাই বাস্তবায়ন যোগ্য। তথা কেন্দ্রীয় সরকার আর স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর হবে জেলা সরকার। জেলা সরকার এক হাতে নগর সরকার (পৌর/সিটি/ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) ও অন্য হাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার) তত্ত্বাবধান করবে। প্রতিটি ইউনিটে সরকারের তিনটি বিভাগ (শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও বিধানিক বিভাগ) কার্যকর করে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। স্থানীয় লোকদের সমন্বয়ে স্থানীয় নির্বাচনিক বোর্ড গঠন করে তাদের দ্বারা স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে (যেমনভাবে শিক্ষক সমিতি, ব্যবসায়ী সমিতি, ছাত্র সংসদ, প্রেস ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন করে)। এ ব্যবস্থা কার্যকর হলে সরকারব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়ে পড়বে। তখন স্থানীয় যাবতীয় কাজ নিচ থেকে ওপরমুখী (বটম-আপ) হয়ে যাবে। পদ্ধতিগত কারণেই জনগণ উন্নয়নকাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে, নিজেকে সরকারের অংশ এবং দায়িত্ববান নাগরিক মনে করবে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক।

                ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর