রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

মহামারী ও বিপদ-মুসিবতে মুমিনদের করণীয়

মুফতি মোহাম্মদ এহছানুল হক

মহামারী ও বিপদ-মুসিবতে মুমিনদের করণীয়

মহান আল্লাহর অতি প্রিয় সৃষ্টি ইনসান তথা মানুষ। সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার সমষ্টি হচ্ছে মানবজীবন। জীবনের প্রতিটি সময় প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের এক রকম থাকে না। কখনো সুখ আসে কখনো দুঃখ, যা চলার পথে সাথী হয়ে থাকে। দুঃখ আছে বলেই মানুষ সুখের মর্ম সুন্দরভাবে উপলব্ধি করতে পারে। আবার জীবন চলার পথে অনেক বিপদাপদ এসে যায়।  মহান আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।’ সুরা ইনশিরাহ, আয়াত ৫।

সুখের সময় মানুষ কেমন আনন্দিত হবে, তা যেমন ইসলামে বলা আছে তেমন দুঃখের সময় সে ভেঙে পড়বে নাকি সবর করবে, তাও বলা আছে। সুখ ও দুঃখের সময় মানুষ কী বলবে কিংবা কীভাবে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে, তাও রয়েছে ইসলামে। ইসলামের বিশ্বাস, বিপদাপদ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আবার বাহ্যিক দৃষ্টিতে কখনো একজন মানুষ আরেকজনের জন্য বিপদের কারণ হয়েও দাঁড়ায়। আবার মানুষের কৃতকর্মের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে সমগ্র মানবজাতি বিপদাক্রান্ত হয়। এ বিপদ-আপদের মাধ্যমেই মানুষ তার গুনাহ থেকে মুক্তি পায়। আর যদি বিপদে আক্রান্ত মানুষের গুনাহ না থাকে তবে ওই ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা আরও বেড়ে যায়। তাই মুমিনের হতাশ হয়ে মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে মহান আল্লাহর রহমত পেতে থাকে। হজরত আবু সাইদ খুদরি ও আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যেসব যাতনা রোগব্যাধি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দুশ্চিন্তা কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয় এমনকি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয় এসবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।’ বুখারি। বিপদাপদ-বালামুসিবত আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামিন সুরা বাকারার ১৫৫ ও ১৫৬ আয়াতে ঘোষণা করছেন, ‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ জীবনের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। হে নবী! ধৈর্যধারণকারীদের আপনি সুসংবাদ দিন যখন তারা বিপদে পড়ে তখন বলে নিশ্চয় আমরা সবাই মহান আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ যুগে যুগে নবী-রসুল ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ওপর বিপদাপদ এসেছে। তাঁরা নানা সময়ে নানা বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ধৈর্যশীল বান্দা ও মনোনীত পয়গাম্বর হলেন হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম। তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে সব সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি ও স্ত্রীদের হারিয়েছিলেন। রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় এলাকার লোকজন তাঁকে নিজ এলাকা থেকে বের করে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে এক স্ত্রী রহিমা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।

রোগাক্রান্ত হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের সারা শরীরে পচন ধরে পোকার সৃষ্টি হয়। তবু তিনি এক মুহূর্তের জন্যও মহান আল্লাহকে ভুলে যাননি। ধৈর্যহারা হননি এবং আল্লাহর কাছে তওবা-ইসতিগফার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। রোগমুক্তির জন্য দোয়া করেছেন। আল্লাহর দয়ায় তিনি রোগমুক্ত হয়ে পুনরায় তাঁর সব সম্পদ ফিরে পেয়েছিলেন। মহান আল্লাহর আরেক মনোনীত পয়গাম্বর হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম। যিনি নিজ অঞ্চল ত্যাগ করার সময় নৌকায় পথ পাড়ি দিতে গিয়ে নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। নদীতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর বড় একটা মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। এ বিপদের মুহূর্তে হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম এক মুহূর্তের জন্যও মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত ছিলেন না। সে কথা আল্লাহ রব্বুল আলামিন তুলে ধরছেন, ‘এরপর সে মাছের পেটে ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করল- হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমি বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি।’ সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৭-৮৮।

এ দোয়াটি হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের দোয়া বা ‘দোয়ায়ে ইউনুস’ নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বিপদগ্রস্ত কোনো মুসলমান যদি নেক মাকসুদ হাসিলের জন্য এ দোয়াটি পড়ে আল্লাহ তা কবুল করেন।’ মানুষ অনেক সময় নিজ নিজ ঘরে, কর্মস্থলে কিংবা চলার পথে বিপদাপদে পতিত হয়। বড় বড় বিপদের সম্মুখীন হয়। এমন বিপদের সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কিংবা অধৈর্য হয়ে নিজেকে বিপন্মুক্ত করার জন্য কারও প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে। এতে মানুষ যেমন নিজের জীবনে প্রচ- হতাশ হয়ে পড়ে আবার অন্যের জীবনকে করে তোলে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব মুহূর্ত ধৈর্যের মাধ্যমে সামাল দেওয়া ও বিপন্মুক্ত থাকতে তওবা-ইসতিগফার পড়া এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করাই হলো মুমিন বান্দার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, মানুষের দুনিয়ার এ জীবন খুব অল্প দিনের। মানুষের উচিত সুখের সময় আনন্দে আত্মহারা না হয়ে আল্লাহর প্রতি সর্বদা শুকরিয়া আদায় করা। আর তাঁর নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার করা। আর দুঃখ নিয়ে হতাশ না হয়ে বেশি বেশি নেক আমল, দান-সদকা করা। তওবা-ইসতিগফার করা। উত্তম ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করা।

লেখক : খতিব, মণিপুর বাইতুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ মিরপুর, ঢাকা।  

সর্বশেষ খবর