রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

পাপের বাপ-মার সন্ধানে

মহিউদ্দিন খান মোহন

পাপের বাপ-মার সন্ধানে

সাধারণত মিথ্যাকে বলা হয় পাপের মা। বলা হয়, জগতে যত অন্যায়-অপরাধ তার জন্মদাত্রী হলো মিথ্যা। মিথ্যা মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। অন্যায় কর্মে প্ররোচিত করে। একটি মিথ্যা থেকে শত মিথ্যার জন্ম হয়। প্রচলিত কথা হলো, একটি মিথ্যাকে ঢাকার জন্য দশটি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলসের তত্ত্ব ভিন্ন। তার মতে একটি মিথ্যাকে বারবার প্রচার করা হলে তা একসময় মানুষ সত্য বলে গ্রহণ করে। গোয়েবলসের এ থিওরিকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তবে মিথ্যাকে যতই সত্যে পরিণত করা হোক, মিথ্যা মিথ্যাই। মিথ্যা যেহেতু পাপের মা, তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- তাহলে পাপের বাপ কে? এ বিষয়ে একটি গল্পের অবতারণা করতে চাই। এক ব্রাহ্মণ তার ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভের জন্য গুরুগৃহে পাঠালেন। কয়েক বছর শিক্ষা গ্রহণ করে ছেলে ফিরে এসে বাবাকে বলল, বাবা! আমি ধর্মীয় সব শিক্ষা সম্পন্ন করে এসেছি। এখন তুমি আমার পরীক্ষা নিতে পারো। পিতা পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে বল, পাপের বাপ কে? পুত্র লা-জবাব। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। পিতা বললেন, যাও, আগে পাপের বাপের সন্ধান কর। পুত্র বেরিয়ে পড়ল। ব্রাহ্মণপুত্র এখানে সেখানে পাপের বাপ কে তা জানার জন্য ঘুরতে লাগল। কিন্তু কেউই তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত পুত্র এক দুপুরে শহরের এক বাড়িতে প্রবেশ করে এক গ্লাস জল খেতে চাইল। ঘর থেকে এক রূপসী মহিলা বেরিয়ে তাকে জল দিল। ঠান্ডা জলে প্রাণ জুড়িয়ে সে ওই ঘরের মালিকের পরিচয় জানতে চাইল। মহিলা তাকে জানাল, সে নিজেই বাড়িটির মালিক এবং সে একজন বারবনিতা। ব্রাহ্মণপুত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, সর্বনাশ! বেশ্যার হাতে জল খেয়ে আমি এ কি পাপ করলাম! পাপের বাপ খুঁজতে এসে নিজেই পাপ করে বসলাম! এখনই আমাকে গঙ্গায় গিয়ে একটি ডুব দিতে হবে। তখন মহিলা বলল, ঠাকুর! আমি আপনার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। একটার বদলে দুটো ডুব দিলেই তো আপনার পাপ ধুয়ে যাবে। ব্রাহ্মণপুত্র বলল, ঠিক আছে, তাহলে চাল ডাল আনাজপাতি দাও আমি নিজে রেঁধে খাব। মহিলা বলল, না, আমি নিজে রেঁধে আপনাকে খাওয়াতে চাই। এজন্য আমি আপনাকে ২০টি স্বর্ণমুদ্রা দেব। আর আপনি গঙ্গায় গিয়ে তিনটি ডুব দেবেন।  ব্রাহ্মণপুত্র ভেবে দেখল, মন্দ কী। গঙ্গায় ডুব দিলেই তো পাপ ধুয়ে যাবে। মাঝখান থেকে পাওয়া যাবে ২০টি স্বর্ণমুদ্রা! সে রাজি হয়ে গেল। এরপর খাবার তৈরি করে মহিলা বলল, ঠাকুর! আমি আপনাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে চাই। বিনিময়ে আপনাকে ৫০ স্বর্ণমুদ্রা দেব, আর আপনি গঙ্গায় গিয়ে পাঁচটি ডুব দেবেন। ব্রাহ্মণপুত্র ততক্ষণে স্বর্ণমুদ্রার মায়াজালে বন্দী। সে রাজি হয়ে গেল। মহিলা তাকে খাবার মুখে তুলে দিতে গেলে ব্রাহ্মণপুত্র যেই মুখ এগিয়ে দিল, অমনি সে ব্রাহ্মণের গালে কষে মারল এক চড়। হতভম্ব ব্রাহ্মণপুত্র ক্ষিপ্ত হয়ে মহিলাকে অভিশাপ দিয়ে বলল, রে কুলটা, তুই ব্রাহ্মণের গালে চড় মারলি! তোর সর্বনাশ হবে। মহিলা বলল, দেখুন ঠাকুরমশাই! আপনি তো আমার হাতে জল খেয়েই পাপমোচনের জন্য গঙ্গাস্নান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বর্ণমুদ্রার লোভে শেষ পর্যন্ত আমার রান্না করা খাবার আমার হাতে খেতে রাজি হলেন। আপনি তো পাপের বাপ কে, জানতে বেরিয়েছেন। জেনে রাখুন, লোভই হলো পাপের বাপ।

লোভ যে পাপের বাপ তার অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে। লোভে পড়ে মানুষ কখনো কখনো এমন সব অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত হয়, তার খেসারত তাকে দিতে হয় জীবন দিয়ে। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ প্রবাদটির প্রচলন তো আর এমনি এমনি হয়নি। ছেলেবেলায় একটি কবিতা পড়েছিলাম। কবি ও কবিতার নাম এখন আর মনে নেই। মৌচাক থেকে মধু খাওয়ার লোভে রাতের বেলায় আমড়া গাছের ঝোপে শিয়ালের হানা দেওয়া এবং মৌমাছি বাহিনীর দ্বারা তার আক্রান্ত হওয়ার কথা ছিল সে কবিতায়। মৌমাছির হুলে জর্জরিত শিয়াল শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘পথ ভুলে ভাই এসেছিলাম আমড়া গাছের কাছে,/ তাই না হলে হেথায় আসে এমন গাধাও আছে?’ শিয়াল যতই বলুক সে পথ ভুলে আমড়া গাছের কাছে গিয়েছিল তা তো সত্যি নয়। সত্যি হলো, সে গিয়েছিল মধু খাবার লোভে।

লোভ যদি একবার কাউকে গ্রাস করে তার আর নিস্তার নেই। মরণব্যাধির মতো তা বাসা বাঁধে মনের মধ্যে। এর সংক্রমণে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়, ন্যায়-অন্যায় বোধ হারিয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে এমন কাজে লিপ্ত হয় যা তাকে নামিয়ে আনে স্বর্গ থেকে ভূতলে। লোভের অনেক রকমফের আছে। কেউ অর্থলোভে দিশাহারা হয়, কেউ ক্ষমতার লোভে নীতি-নৈতিকতাকে ছেঁড়া ন্যাড়ার মতো ছুড়ে ফেলে দেয়। নারীলোভে কেউ কেউ নরত্যার মতো জঘন্য পাপে নিমজ্জিত হতেও দ্বিধা করে না। অন্যের জমি দখল করা, চোরাকারবারে ব্যাপৃত হওয়া, মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে কুপরিচিতি অর্জন- সবই হয় লোভের কারণে। মানুষকে অমানুষে পরিণত করে যে ষড়রিপু, লোভ তার মধ্যে অন্যতম। তবে বিবেক যাদের সদাজাগ্রত, স্বার্থচিন্তা যাদের আচ্ছন্ন করতে পারে না, লোভ তাদের কাছে পরাজিত হয়। যারা সেটা করতে পারেন, তারাই সমাজে প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী হন, সম্মানিত হন।

মানুষ তার কাজের দ্বারাই সম্মান অর্জন করে, শ্রদ্ধার আসনে ঠাঁই পায়। কিন্তু যখন দেখা যায় সেই ব্যক্তি লোভের কবলে পড়ে দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে, তখন বেদনায় ভারাক্রান্ত না হয়ে গত্যন্তর থাকে না। ২৮ জুনের বাংলাদেশ প্রতিদিনের ‘বেপরোয়া লোভেই দুর্জয়ের সর্বনাশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি পড়ে হোঁচট খাননি এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। কেননা, নাঈমুর রহমান দুর্জয় এ দেশে অপরিচিত কেউ নন। রাজনীতিতে আগমন বা সংসদ সদস্য হওয়ার অনেক আগেই তিনি তাঁর আপন কর্মের দ্বারা দেশবাসী কর্তৃক সমাদৃত। একসময়ের তুখোড় ক্রিকেটার ও জাতীয় দলের অধিনায়ক দুর্জয়ের ভক্ত নেই এমন কোনো নগর-বন্দর-গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। ক্রিকেট জীবনে তিনি পেয়েছেন অনেক সাফল্য। খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছেন ভালোই। অর্থবিত্ত কি কম ছিল তাঁর? একজন মানুষের সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য যেটুকু দরকার তা দুর্জয়ের ছিল না, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার পরও কেন তাঁর এ নৈতিক স্খলন? কেন তিনি অর্থসম্পদের পর্বত সৃষ্টি করতে গিয়ে আজ দুর্নামের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছেন? এমপি হওয়ার পর তাঁর ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব অর্জনের যে কাহিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, একসময়ের ক্রিকেটের রাজপুত্রের নাম আজ দুর্নীতিবাজের সারিতে। কক্সবাজারের আবদুর রহমান বদি বা কুয়েতে গ্রেফতার কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল আর দুর্জয় তো এক কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, আজ তিনি একই কাতারে শামিল! কোনো পার্থক্য নেই তাদের মধ্যে। একসময় যারা দুর্জয়ের ভক্ত ছিলেন তারা আজ বেদনায় মুষড়ে পড়েছেন। আমার ক্রিকেটপাগল ছেলেটি একসময় দুর্জয়ের খুব ভক্ত ছিল। ক্রিকেটারদের পোস্টারে ঘর ভরে ফেলেছিল। সেখানে দুর্জয়েরও ছবি ছিল। আজ সে বেদনায় বিমর্ষ। তার প্রিয় তারকা দুর্নীতিবাজ, মাদক কারবারি, সে ভাবতেই পারছে না। মুখ কালো করে বলল, আব্বা! আমাদের গর্ব করার মতো কি কিছুই থাকবে না? আমি জবাব দিতে পারিনি। কী জবাব দেব যখন একেকটি নক্ষত্রের পতন দেখছি? আমরা যেন দৈন্যের সাগরে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছি!

বাংলাদেশ প্রতিদিনে নাঈমুর রহমানে দুর্জয়ের অবৈধ সম্পদ অর্জনের যে ফিরিস্তি ছাপা হয়েছে, এখানে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। প্রাসঙ্গিক হিসেবে শুধু উল্লেখ করতে চাই, এমপি হওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছরে তাঁর আয় বেড়ে হয়েছে আট গুণ। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও বছর বছর তাঁর সম্পদ বেড়েছে রকেট গতিতে। এমপি হওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তাঁর হলফনামায় উল্লেখ করা আয় ও সম্পদের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান! তিনি এখন একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক! স্ত্রী ও আত্মীয়-পরিজনের নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, দুর্জয় সংসদ সদস্য পদের প্রভাব খাটিয়ে তাঁর এলাকায় মাদক কারবারের প্রধান পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কক্সবাজার থেকে আনা ইয়াবার চালান সহজে পাচারের জন্য অবৈধভাবে চালু করেছেন স্পিড বোট ঘাট। আর এ সবকিছুই করেছেন এমপি পদের প্রভাব খাটিয়ে।

প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে তারকারা সাধারণত অগ্রাধিকার পান। হতে পারেন তিনি ফুটবল, ক্রিকেট, অভিনয়শিল্পী বা সংগীত তারকা। তাদের অনেকেই নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন প্রচারণায় মডেল হন। অতীতে এ দুর্জয়, যখন তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার তুঙ্গে, তখন পণ্যের মডেল হননি তা নয়। শিশুরা তো তাঁকে আইডল মনে করত। সেই শিশুরা আজ তরুণ কিংবা যুবক।  আজ তাদের মনের প্রতিক্রিয়া কী, ওপরে তার উদাহরণ দিয়েছি।

একটি ব্যাপার অনেকের মতো আমার কাছে কুজ্ঝটিকার মতো। একজন মানুষের কত টাকা দরকার? মানুষের কি লোভের সীমা-পরিসীমা নেই? ক্ষমতা হাতে পেলেই তার অপব্যবহার করে অর্থসম্পদের পর্বত নির্মাণে ব্যস্ত হতে হবে কেন? আল্লাহতায়ালা মানুষকে সীমা লঙ্ঘন না করার নির্দেশ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও কেউ কেউ সীমা লঙ্ঘনে দ্বিধা করে না। চোখের সামনে সীমা লঙ্ঘনকারীদের নির্মম পরিণতি মজুদ থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত তা লঙ্ঘন করে। আর সীমাহীন লোভই তাদের সেই পথে ধাবিত করে। আমার ছেলের কথাটি এখনো কানে বাজছে, আমাদের গর্ব করার মতো কি কিছুই থাকবে না? কতটা বেদনায় সে এ উক্তি করেছে ভেবে দেখা দরকার। একটি জাতির তো গবর্, অহংকার করার মতো কিছু বিষয় থাকা দরকার। কিন্তু তার সবই যদি দুর্নীতি-দুষ্কর্মের কারণে ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে তাহলে আমরা যাব কোথায়?

নিবন্ধের গোড়ার দিকে যে গল্পটি বলেছি, তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। প্রকৃতই, লোভ হলো পাপের বাপ। লোভের বীজ থেকেই সৃষ্টি হয় পাপের ভ্রুণ। যারা একে বেড়ে উঠতে না দেয় তারা মুক্ত থাকতে পারে সব ধরনের অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতি-দুষ্কর্ম থেকে। আর যারা ব্যর্থ হয় তারা ডুবে যায় পাপের এঁদোডোবায়। যুগে যুগে এমনটিই ঘটতে দেখা গেছে।

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর