মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

এরশাদের মৃত্যু পাহাড়সম ভারী

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু

এরশাদের মৃত্যু পাহাড়সম ভারী

আজ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের তিরোধানের এক বছর। মাও সে তুং বলেছেন, ‘মৃত্যু দুই ধরনের হয়- একটি হাঁসের পালকের  মতো, অন্যটি পাহাড়সম ভারী।’ হাঁসের পালক বাতাসে উড়ে যায়। কিন্তু পাহাড় স্বীয় অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পল্লীবন্ধু এরশাদের মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, পদ্মা মেঘনা যমুনা প্রবাহিত হবে, গ্রাম বাংলার চিরসবুজ প্রান্তরে মেহনতি মানুষ কাজ করবে তত দিন ৬৮ হাজার গ্রামসংবলিত বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের হৃদয়ে এরশাদ বেঁচে থাকবেন- একজন উন্নয়নের কান্ডারি হিসেবে। বেঁচে থাকবেন সফল বৈপ্লবিক সংস্কারক হিসেবে। চিরঞ্জীব থাকবেন তাঁর কর্মকান্ডের মাধ্যমে। তাই এরশাদের মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী।

লাখ লাখ মানুষের রক্তিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিয়ে পল্লীবন্ধু এরশাদ এক বছর আগে পরিণত বয়সে এ ধরণি ছেড়ে চলে গেছেন প্রকৃতির নিয়মে। সেদিনই প্রমাণিত হয়েছিল এরশাদ আপামর মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসনে আছেন। পল্লীবন্ধু আজও অম্লান আছেন প্রবহমান ফলগুধারার মতো। কেন তাঁর বিদায়বেলায় ঢাকায় ও রংপুরে লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হয়েছিল? এটা কোনো সংগঠিত সভা ছিল না। ছিল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ।

কেন তাঁকে মানুষ ভালোবাসত? বাংলাদেশ এখনো কৃষি অর্থনীতিনির্ভর। এখনো দেশটিকে গ্রাম বাংলা বলা হয়। শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ এখনো সেই নিভৃত পল্লীতে বাস করে। তাই তিনি ক্ষমতায় এসেই উপলব্ধি করেছিলেন পল্লীর মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ছাড়া দেশের সব মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব নয়। পল্লীবন্ধুর স্লোগান ছিল- ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’। তিনি কেবল স্লোগাননির্ভর রাজনীতি করেননি। স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন কর্মকান্ডের মাধ্যমে; যা ইতিহাসে বিরল। এই অনন্যসাধারণ মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদের মতো তিনি যেন আলোকিত হয়ে আছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে। ধ্রুবতারার মতো নীল আকাশে তিনি জ্বলছেন। তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে।

এত কথা বলার বাস্তবতা কী, বা কোন যৌক্তিকতার ভিত্তিতে এসব কথার অবতারণা? লর্ড রিপন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে প্রশাসনিক সংস্কার করেছিলেন ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘায়িত করার জন্য। এ উপমহাদেশে একমাত্র এরশাদ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনামলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করে বৈপ্লবিক উপজেলা-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। তার আগে উপজেলাগুলো ‘থানা’ নামেই পরিচিত ছিল। এখানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন না। একজন সার্কেল অফিসার ও ওসি ছিলেন। ছিল না কোনো চিকিৎসাসেবা। পল্লীবন্ধু রাতারাতি ৪৬০টি থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করে ঘুমন্ত গ্রামগুলোকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। প্রতিটি উপজেলায় একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ১৮ জন কর্মকর্তা দিয়ে নতুন গণমুখী ও গণতান্ত্রিক গ্রামীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন; যাতে গ্রামের  মানুষ আধুনিক জীবনের ছোঁয়া পায়। প্রতিটি উপজেলায় ৩১ বেডের একটি হেলথ কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছিলেন; যেখানে দুজন নারী ডাক্তারসহ নয়জন ডাক্তার ছিলেন। ছিল অ্যাম্বুলেন্স, এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন। এভাবে চিকিৎসাব্যবস্থা মানুষের দোরগোরায় পৌঁছে দিয়েছিলেন এরশাদ। এখন এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা মহামারীকালে পল্লীর জনগণের চিকিৎসা চলছে। আমরা কি অনুধাবন করতে পারি পল্লীবন্ধু কতটা দূরদর্শী ও জনসম্পৃক্ত ছিলেন? পল্লীবন্ধু ২১ জেলাকে ৬৪ জেলায় রূপান্তরিত করে প্রতিটিতে আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সেই জেলা হাসপাতালগুলো এখন করোনাসহ অন্য চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়, তিনি ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছিলেন। তাঁর শাসনামলের আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার সময় কয়েকটি ফেরি ছিল। তিনি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া  পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে গোমতী সেতু, মেঘনা সেতু, বুড়িগঙ্গা সেতু নির্মাণ করেছিলেন। বহু কাক্সিক্ষত যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এর কাজও শুরু করেছিলেন। কেবল নগর ও শহরে উন্নয়ন করেননি, গ্রামীণ অবকাঠামোও নির্মাণ করেছিলেন। স্থানীয় সরকার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে শহরের সঙ্গে গ্রামগুলোর সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। তাই বর্তমানে রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের যে কোনো গ্রামে অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। এ দেশের ভুখানাঙা গ্রাম বাংলার মানুষ তাঁকে আদর করে ভালোবেসে ডাকত ‘পল্লীবন্ধু’।

পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওষুধনীতি করেছিলেন। ফলে কম দামে মানুষ ওষুধ কিনতে পারে। বিদেশেও ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। পল্লীবন্ধু প্রথমেই প্রাইমারি স্কুলে বিনামূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করেছিলেন। তিনি পল্লী বিদ্যুতের ব্যাপক সম্প্রসারণ করেছিলেন। এক কথায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ পল্লীবন্ধু শুরু করেছিলেন সমস্ত বাধাবিপত্তি ঝেড়ে ফেলে। তাই তিনি আপামর মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁর উন্নয়নের কথা বলে শেষ করা যাবে না। পুরোটা লিখতে গেলে একটি মহাকাব্য হয়ে যাবে।

রাজনীতিতেও তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সংক্ষেপে বলব, তিনি একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীর ইতিহাসে যিনি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে ও তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে জেলে পাঠিয়েছিল। জেলে বসেই পল্লীবন্ধু সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে জয়লাভ করে পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাহলে তিনি কি জননিন্দিত, না জননন্দিত? তিনি যে জননন্দিত তা জেলে থেকে দুবার পাঁচটি করে আসনে বিজয়ী হওয়াই প্রমাণ করে। পৃথিবীতে যাদের স্বৈরশাসক বলা হয় তারা ক্ষমতা ত্যাগের পর রাজনীতি বা নির্বাচন করতে পারেননি। হয় করুণ মৃত্যু হয়েছে, না হয় দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তার প্রমাণ কিউবার বাতিস্তা, দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং-হি, ফিলিপাইনের মার্কোস, আর পাকিস্তানের আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও সর্বশেষ সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের কথা সবারই জানা। এইচ এম এরশাদ যখন আমাদের ছেড়ে চলে যান তখন তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। এরশাদ কেবল উন্নয়নের কান্ডারি নন, একজন জনপ্রিয় ও জননন্দিত রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তাঁর এসব কর্মকান্ডই তাঁকে অমর করে রাখবে যুগ যুগ। তাই আজকের দিনে মৃত্যুঞ্জয়ী মানবিক পল্লীবন্ধুর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক :  কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি ও সাবেক মন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর