শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যা মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আমরা

শাইখ সিরাজ

বন্যা মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আমরা

প্রাচীন কৃষিসভ্যতা গড়ে উঠেছিল নদ-নদীর তীরে। আমরা ইতিহাসে নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা মিসরীয় সভ্যতার কথা পড়েছি। কৃষি অর্থনীতির ওপর ভর করেই একেকটি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল সে সময়। শিল্পবিপ্লবের আগে পৃথিবীতে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিই ছিল মুখ্য। নদীতীরে পলি জমা উর্বর মাটিতে ফলানো সোনার ফসলই ঘোরাত রাষ্ট্র বা রাজ্যের চাকা। জোগাত মানুষের বেঁচে থাকার রসদ খাদ্য, পুষ্টি ও ভবিষ্যতের সঞ্চয়। তাই নদী ছিল আশীর্বাদ। আবার নদীই কখনো কখনো হয়ে উঠত অভিশাপ। যখন নদীর দুই কূল উথলে বন্যায় তলিয়ে যেত সোনালি ফসলের মাঠ, বসতি। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সমুদ্র উত্থিত ব-দ্বীপ। ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদীর জাল বিছানো বাংলাদেশের বুকে। বাংলাদেশে নদ-নদীর মোট সংখ্যা ১ হাজার ১৮২ (সূত্র : বাংলাদেশের নদ-নদী, ম ইনামুল হক, অনুশীলন, জুলাই, ২০১৭)। এর মাঝে অধিকাংশই ছোট নদী। আছে মাঝারি নদীও। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা এ কটি বড় নদ-নদী অববাহিকায় ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে ভারত থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করা বড় দুটি নদ-নদী পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র। এ ছাড়া প্রায় ১৫০টির অধিক নদ-নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ নদ-নদীগুলোর প্রবাহ উৎস ও প্রবাহ পথ ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারজুড়ে বিস্তৃত। আমাদের দেশে প্রধান তিন নদী যমুনা, গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকার ৯৩ শতাংশ বাংলাদেশের বাইরে। নেপাল, ভুটান, ভারত ও চীনের কিছু অংশে। এ দেশগুলোর এই নদীতীরবর্তী অঞ্চলের বৃষ্টি নদীগুলো বয়ে এনে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নিয়ে যায় বঙ্গোপসাগরে। প্রতি বর্ষায় এ নদীগুলো ভরে ওঠে। প্লাবিত হয়। প্রায় প্রতি বছরই। ফলে বন্যা এ অঞ্চলের স্বাভাবিক এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবার বাংলাদেশ মৌসুমি বায়ুর দেশ হওয়ায় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বাংলাদেশে বন্যা ভয়াবহ দুই কারণে। এক. প্রবাহিত পানির পরিমাণ বেশি হলে। দুই. পানির প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা থাকলে বন্যার পানি দ্রুত নেমে যেতে না পারলে। ভারতের নদীশাসনের কারণে এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোয় শুকনো মৌসুমে প্রবাহ প্রায় থাকেই না। সারা বছরে নদীপথ সরু হয়ে আসে। নদীগুলো দখল হয়ে যায়। নদী থেকে অপরিকল্পিত উপায়ে বালু উত্তোলন, বাঁধ তৈরি প্রভৃতি কারণে নদীর গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়। যে কারণে দেশে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের মতো প্রলয়ঙ্করী বন্যার মুখোমুখি আমাদের হতে হচ্ছে না। এর একটা বড় কারণ হতে পারে নদ-নদীগুলোর ড্রেজিং বা পুনঃখননের ব্যবস্থা করা। তার পরও এ বছরের বন্যাটি দুই দিক থেকে আশঙ্কার। প্রথম দিক হচ্ছে, সারা বিশ্বই করোনার মতো মহাদুর্যোগের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশে এর পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে। এর মাঝে কয়েক দিন আগেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে কৃষির অনেক ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি এ বন্যার ক্ষেত্রে বলা যায়, তা হচ্ছে এটি আগাম বন্যা। বন্যাটি জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টের শুরুর দিকে হওয়ার কথা অথচ বন্যা প্লাবিত করেছে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহেই। উত্তরাঞ্চলে আগাম বন্যা কৃষক তথা গ্রামীণ তৃণমূল জনগোষ্ঠিকে বহুমুখী সংকটে ফেলেছে। এখন বন্যাকবলিত দেশের উত্তর আর মধ্যাঞ্চলের ১৩ জেলা। নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর ও দিনাজপুরের নিচু এলাকা আর গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী আগামী সাত দিন কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল  ও মানিকগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানিসমতল ২০ জুলাইয়ের পর আবার বাড়তে পারে এবং ২৫ জুলাই নাগাদ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। ২০ জুলাইয়ের পর বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে এবং জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশে বড় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় মূলত উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়ে গেলে। বিশেষত যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়লে দেশের এক-তৃতীয়াংশ জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। এ ছাড়া পদ্মার পানিতেও দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এখন কৃষকের খেতে তৈরি হচ্ছে আমন বীজতলা। আমন মৌসুমের জন্য ২ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আউশের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এরই মধ্যে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এ পাটের বেশির ভাগই প্রায় পরিণত অবস্থায় আছে। আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১২ দিনের মধ্যে তা কাটা যাবে। এ বছর ৮২ লাখ ৪২ হাজার বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বন্যায় এরই মধ্যে জামালপুর, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও রাজবাড়ীর নি¤œাঞ্চলের পাট সাত-আট দিন ধরে পানির নিচে আছে। এক সপ্তাহের বেশি পানির নিচে থাকলে পাট নষ্ট হয়ে যায়। অনেক জায়গায় বন্যার পানি নামছে, আবার অনেক জায়গায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কোনো বছর বন্যার ক্ষতি কম হয়, কোনো বছর বেশি। এবার বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিতে এমনিতেই বহুমুখী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। এর মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। আবার পরিস্থিতি যদি এর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়, তাহলে তা আমাদের কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে নদীতীরবর্তী এলাকার জনজীবনের ওপর বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রশ্ন হলো, বন্যা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে আমাদের সাধ্য ও সচেতনতা কত দূর?

আগেই বলেছি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের দেশে প্রতি বছর যে বন্যা হয় তার ৯৩ শতাংশই আসে আন্তদেশীয় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে। মৌসুমি বন্যার ক্ষেত্রেও ৮০ ভাগ দায় বাইরের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সমন্বয় থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বন্যার বহু আগেই আমরা ফসলি পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বন্যা-উপযোগী সবরকম কৃষি ব্যবস্থাপনা করতে পারি। আমাদের নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, পানি ধরে রাখা ও অপসারণের জায়গাগুলো ভরাট ও বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই আমাদের দেশে বন্যা দীর্ঘমেয়াদি একটি দুর্ভোগে পরিণত হয়। আমরা বন্যা পরিস্থিতি শুরু হলে তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে যতটা ভাবী, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আগাম দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ততটা অগ্রসর নই। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী প্রভাবে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতির দিকগুলো আমাদের দেশে অনিবার্য হয়ে উঠছে। বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছিলাম এ বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মিজানুর রহমানেরে সঙ্গে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন এবারের বন্যা আগাম হলেও ভয়ানক নয়। যেসব অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে গেছে, সেসব অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা বেশি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুগুলো যেমন পরিবর্তিত হচ্ছে, তেমন পরিবর্তিত  হচ্ছে বৃষ্টিপাত, বন্যার সময়ও; আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বন্যাসহনশীল শস্যের যে বীজগুলো তৈরি করেছি, সেগুলো এ পরিবর্তিত সময়ে কতটা কাজে আসবে? এবং পরিবর্তিত জলবায়ুকে মাথায় রেখে পরবর্তী ২০ বছরের শস্য ক্যালেন্ডার আমরা তৈরি রেখেছি কিনা? আমাদের শত বছরের ডেল্টা প্ল্যানের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পাওয়ার কথা বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এ ক্ষেত্রে তার কতটা অনুসরণ করা হয়েছে সে বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য প্রফেসর ড. শামসুল আলমের সঙ্গে। তিনি জানালেন বন্যা নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রকল্প রয়েছে সরকারের। যমুনা নদী চ্যানেলাইজেশনের কথা বললেন তিনি। নদীর মূল ধারাটাকে সচল রেখে দুই ধারে বাঁধ নির্মাণ করে নদীপথকে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার বিশাল এক প্রকল্প সরকারের ডেল্টা প্ল্যানে রয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২.০৩ বিলিয়ন ডলারের যমুনা ইকোনমিক করিডোর নামের একটি প্রকল্পের কথাও তিনি জানালেন। এ উদ্যোগগুলো আশাজাগানিয়া। যদি সত্যি সত্যি সরকার এ প্রকল্পগুলো দুর্নীতিমুক্ত ও সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে হয়তো বদলে যাবে বাংলাদেশ। আমি আশাবাদী মানুষ, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। একটি সুন্দর সফল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি দেখি। আশা করি, জলবায়ু পরিবর্তনের সবগুলো ঝুঁকির বিষয় মাথায় রেখে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিশাপ থেকে জনসম্পদ ও কৃষিকে রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যে পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক, তা হতে হবে বাস্তবমুখী ও বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে। এ বন্যার অভিঘাত ও সংকট থেকে দুর্গত কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে সরকার তথা দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংগঠনসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ- এই প্রত্যাশা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর