শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সুরক্ষায় করণীয়

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সুরক্ষায় করণীয়

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে চার মাসে দেশে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল  ৫১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ নিয়ে করোনায় ২ হাজার ৫৪৭ জনের মৃত্যু হলো। এর বাইরে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন করোনার উপসর্গ নিয়ে। তবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। কভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখের কাছাকাছি। চীনের উহানে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার তিন মাস পর বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানায় সরকার। আর করোনা সংক্রমণে প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় ১৮ মার্চ। আক্রান্তের বিবেচনায় দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১.২৭ শতাংশ, আর সুস্থতার হার ৫৪.৪৮ শতাংশ। উপমহাদেশের সংস্কৃতি হলো, যে কোনো দুর্যোগে প্রতিবেশী বা সমাজ রক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। পরে রাষ্ট্র ও স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করা। সর্বশেষ নিজের সুরক্ষা। করোনা মহামরী থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

মলিকুর পিসিআর পরীক্ষার সংখ্যা এবং গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যমান ল্যাবরেটরিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন করতে হবে। বাড়াতে হবে নমুনা সংগ্রহের বুথ। কয়েক ঘণ্টা পরপর সংগৃহীত নমুনা মোটরবাইকের মাধ্যমে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে যার ফলে নমুনা সংগ্রহ থেকে রিপোর্ট প্রদানের সময়ের ব্যাপ্তি কমে আসবে। যৌক্তিক লকডাউন নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগের প্রাদুর্ভাবের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য অ্যান্টিবডি স্ক্রিনিং করতে হবে। অ্যান্টিবডি পজিটিভ ব্যক্তিবর্গ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর্মক্ষেত্রে শ্রম দিতে পারবেন। রোগের প্রাদুর্ভাবের ওপর ভিত্তি করে লকডাউনকৃত এলাকা লাল, হলুদ অথবা সবুজ অঞ্চলে ভাগ না করে এগুলোকে ম্যাক্রো অঞ্চল (যেমন বাড্ডা), মাইক্রো অঞ্চল (উত্তর বাড্ডা), ন্যানো অঞ্চল (আবাসিক এলাকা), পিকো অঞ্চল (বাড়ি/ফ্ল্যাট/পরিবার) হিসেবে ভাগ করা যেতে পারে। লকডাউনের সময় ওই এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে মিলিতভাবে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় পণ্য নিশ্চিত করতে হবে। তাদের নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। মাইক্রো ও ন্যানো অঞ্চলগুলো আইসোলেশন নিশ্চিতকরণের জন্য কমিউনিটি পুলিশ নিয়োজিত করতে হবে।

ফেস মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একটি রোদচশমা ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচির সঙ্গে ভেসে আসা ভাইরাসকে চোখে এসে লাগা থেকে বিরত রাখতে পারে। জনসমাগম হয় এরূপ স্থানে KN95 অথবা সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার না করে ধোয়া যায় এরূপ কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। কারণ KN95 অথবা সার্জিক্যাল মাস্ক অধিক সময় ব্যবহার করলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তাদের ছাদ অথবা বারান্দা থেকে মুক্ত বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণে। তাদের ফুসফুস সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে।

সংক্রমণ নিরোধক জামা পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড ও জনসাধারণের পরিধান করা উচিত নয় কারণ এটি শরীরে পানিশূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। এটি কভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা প্রদান করে না কারণ এ ভাইরাস ইবোলাভাইরাসের মতো ঘামের মাধ্যমে ছড়ায় না। সব বহির্বিভাগে অর্থাৎ রাস্তায়, দোকানে, বাজারে কর্মরত এবং সরকারি কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করতে হবে তারা যেন বাসায় ঢোকার আগেই তাদের পরিধেয় পোশাক খুলে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে ফেলে। তা পরিবারের অন্য সদস্যদের সংক্রমিত করতে পারে। সর্বসাধারণের গ্লাভস পরিধান করা উচিত নয়, ক্লিনিক্যাল ব্যবহারের জন্য যেসব গ্লাভস সেগুলোও নয়। গ্লাভস শুধু হাসপাতালে বিক্রির জন্য সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। রিকশাচালক ও অন্য পরিবহন শ্রমিকদের কমপক্ষে ৩-৪ জোড়া কাপড়ের মাস্ক প্রদান করতে হবে। এটা পরিবেশের জন্য উপযোগী, নৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ও কার্যকর। শহরের যেসব অঞ্চলে বস্তি অবস্থিত সেখানে স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে নিরাপদ পানি ও সাবানের ব্যবস্থা করতে হবে।

অফিস, দোকানে দরজা থেকে সব ধরনের হাতল খুলে ফেলতে হবে। ওইসব স্থানে মানুষ যেন তাদের কাঁধ ব্যবহার করে দরজা খোলে সে রকম চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে। যদিও এটি ব্যক্তিগত কিংবা ধর্মীয়ভাবে অনেক সংবেদনশীল তা-ও আমি এটি রাখব। সব পুরুষ মানুষ ফুলহাতা শার্ট পরবে এবং মহিলারা সালোয়ার-কামিজ অথবা বোরকা পরবে সঙ্গে মুখ ঢেকে রাখবে। এর ফলে বাহু ব্যবহার করে হাঁচি-কাশি দিতে পারবে। কাঁধ ব্যবহার করে দরজা খুলতে পারে। লোকাল  বাসগুলোয় বসার ব্যবস্থাটা একটি আসন খালি রেখে করতে হবে, মাঝে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় থাকতে হবে। পানির ভিত্তিতে তৈরি করা অবিষাক্ত জীবাণুনাশক ব্যবহার করে অফিস এবং ফল ও শাকসবজি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। জনসাধারণকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ রঙের ফলমূল ও শাকসবজি খেতে উৎসাহিত করতে হবে যেন তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটুট থাকে। ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিয়ে লকডাউন প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে হবে। শুধু পুলিশ নয়, এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতা, শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পুলিশ প্রশাসন, প্রশাসনিক ক্যাডার ও চিকিৎসকদের সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সমন্বয় সৃষ্টি করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজের প্রেরণা দিতে হবে। এখনই সময় সমন্বিতভাবে কাজ করা ও সব ধরনের সেবার বিকেন্দ্রীকরণের। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি নিয়মিত হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাচলা করতে হবে। আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে। সুরক্ষিত থাকুন, সচেতন হোন, সতর্ক হোন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

তথ্য সহায়তা : অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন ও ড. সনজয় দাশ।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর