সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

এই খেলা আর কতকাল আর কতটা জীবন!

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

এই খেলা আর কতকাল আর কতটা জীবন!

আমি সব সময় অদৃশ্য শক্তিকে খোঁজার চেষ্টা করি। এটাকে কোনো অলৌকিক শক্তি না বলে বরং মানুষের দানবিক শক্তি বলাটাই যুক্তিযুক্ত হয়তো আবার নয়তো। এ শক্তি মানুষ নাকি মানুষের মুখোশের। এ শক্তি মানুষের আত্মার নাকি মানুষের ভিন্ন সত্তার। এ শক্তি মানুষের পচনশীল দেহের নাকি নর কঙ্কালের। শক্তিটা যেন বাতাসে ভাসমান শব্দ তবুও নিঃশব্দ। শক্তি থেকে শক্তি। শক্তির আড়ালে শক্তি। কত দূর এ শক্তির অদৃশ্যমান সুতো, তা কেউ কেউ জানে, সবাই জানে কিন্তু কেউ জানে না। এ শক্তি গুপ্তঘাতকের মতো। ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। দৃশ্যমান মনে হয়, আবার অদৃশ্যমান। চেনা চেনা মনে হয় তবুও অচেনা। বলাও যায় না, সয়ে থাকাও যায় না। সহজ মনে হয় তারপরও জটিল। এ যেন সহজ কথা যায় না বলা সহজের মতোই। অদৃশ্য শক্তি কি একটা খেলা। নাকি খেলার অন্তরালে খেলা। এ অদৃশ্যমান শক্তি কি শুভশক্তি নাকি অশুভ শক্তি। কখনো হয়তো শুভ, কখনো হয়তো অশুভ। তবে শুভ শক্তির কাছে অশুভশক্তি পরাভূত হবে এটাই সময়ের দাবি। তারপরও বাষ্পরুদ্ধ মুখ থেকে উচ্চারিত হয় এ খেলা আর কতকাল আর কতটা জীবন! আমাদের আশপাশে অনেক অদৃশ্য শুভ শক্তি আছে। আমাদের সেই অদৃশ্য শুভ শক্তিকে মনস্তত্ত্বে ধারণ করতে হবে। তবেই এর প্রভাবে অদৃশ্য অশুভ শক্তি বিতাড়িত হয়ে সব তত্ত্বেই শুভ শক্তিকে ধারণ করতে পারবে। মানুষ যত তাড়াতাড়ি শুভ শক্তিকে চিনতে পারবে, অশুভ অদৃশ্য শক্তি তত দ্রুত ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে। জয় হবে বাস্তবতার, জয় হবে মানুষের। কথাটা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। তবে আমাদের গতানুগতিক ভাবনাকে নাড়িয়ে দিতে পারে। আমেরিকার শীর্ষ রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফাউচি বলেছেন, আমেরিকানদের এক বিরাট অংশই ‘অ্যান্টি-সায়েন্স’ অর্থাৎ বিজ্ঞানবিরোধী। কিন্তু মহাসমুদ্রের ওপার থেকে এপারে দাঁড়িয়ে আমরা ভেবেছি প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধ দেশটির মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হবে। কিন্তু কল্পনার অদৃশ্য শক্তি এটি আমাদের ভাবতে দেয়নি। দেশ উন্নত হলেই যে মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হবে এটা ঠিক নয়। তার মানে সত্যের পেছনে সত্য থাকে। পাদপ্রদীপের নিচে অন্ধকার থাকে। দৃশ্যমান শক্তির মধ্যেও অদৃশ্যমান শক্তি থাকে। এ বিষয়টি আমাদের শেখাচ্ছে দৃশ্যমান অদৃশ্যমান যে শক্তিই থাকুক না কেন নিজের বিবেচনা দিয়ে সব বিষয়কে যাচাই করতে হবে। খাঁটি সোনা চিনতে হবে। চিন্তাশক্তি ও যৌক্তিকতাকে কাজে লাগাতে হবে।

ইতিহাসের আয়নায় মানুষ নিজের ছবি দেখতে পায়। সেটা পেছনের ইতিহাস হলেও মানুষকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের অদৃশ্য শক্তির প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা দেয়। যেটা মানুষকে শিক্ষা দেয়, অভিজ্ঞতাটায় পরিপুষ্ট করে তোলে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চাণক্যের মাধ্যমে বিষকন্যা হিসেবে অপূর্ব সুন্দরী আর প্রাণঘাতী ভারতীয় নারীদের কথা ইতিহাসে এসেছে। এদের কাজ ছিল কোনো একজন রাজার অনুগত থেকে তার প্রতিপক্ষ রাজাকে খাদ্যে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা। ৬-৮ বছর বয়সের মেয়েদের মধ্যে থেকে বিষকন্যাদের বাছাই করা হতো। এরপর এদের খাবারের সঙ্গে অল্প অল্প করে বিষ মেশানো শুরু হতো। এভাবে অল্প অল্প করে বিষ খাওয়ার ফলে তাদের শরীরে বিষের প্রতিষেধক তৈরি হয়ে যেত এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিষ খাওয়ার ফলে পরে আর কোনো বিষই তাদের ওপর কাজ করত না। সাধারণ মানুষকে হত্যা করার মতো বিষ প্রয়োগের ক্ষমতা তৈরি হলে বিষকন্যাদের পাঠানো হতো প্রতিপক্ষ অন্যান্য রাজার দরবারে। প্রতিপক্ষের রাজারা তাদের রূপে আকৃষ্ট হয়ে পড়ত।

এরা ধীরে ধীরে রাজাদের বিশ্বাসভাজন হিসেবে নিজেদের তৈরি করত। তারপর রাজার খাবারে বিষ মিশিয়ে সেই একই খাবার নিজেও খেত সন্দেহ এড়ানোর জন্য। এর ফলে যেটি ঘটার তাই ঘটত। রাজা বিষাক্ত খাবার খেয়ে মারা যেত অন্যদিকে বিষকন্যারা বেঁচে ফিরে আসত কোনো ধরনের সন্দেহ ছাড়াই। এ ছাড়াও বিষকন্যাদের প্রতিপক্ষের কাছে পাঠানোর আগে তাদের দেহের ভিতরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হতো যাতে বিষকন্যার দেহের সংস্পর্শে এলে বিষের আক্রমণে মারা যায়।

অতীতের বিষকন্যাদের সঙ্গে বর্তমানের সমীকরণটা মিলিয়ে নেওয়া যায়। বিষকন্যা, বিষকন্যাদের অদৃশ্য সুতোয় টানা শক্তি, অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধ শক্তি সময়ের সঙ্গে হয়তো নাম ও ভূমিকা পাল্টিয়েছে কিন্তু এখনো তা ভিন্ন রূপে থেকে গেছে। প্রাচীন কৌশল থেকে তা আধুনিক কৌশলে রূপান্তরিত হয়েছে। নতুন বোতলে পুরাতন মদের মতো। একটা দালাল চক্র বিষকন্যাদের মতো গড়ে উঠেছে। যাদের পেছনে রয়েছে অদৃশ্যমান শক্তি। অদৃশ্য শক্তি সামনে আসে না, এ দালাল চক্রকে তাদের হয়ে কাজ করায়। এ দালালচক্র পদ-পদবির দালালি করে, দুর্নীতির ও লেনদেনে দালালি করে, পুরস্কার প্রাপ্তিতে দালালি করে, টেন্ডার পাইয়ে দিতে দালালি করে, টাকা পাচারে দালালি করে। সব অশুভ কাজে দালালি করে। এরকম অনেক অদৃশ্য শক্তির দালাল ও তাদের সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যারা খুব কৌশলে কাজ করে যাচ্ছে। খুব কৌশলে। এরা টাকা দিয়ে পদ বিক্রি করে, এরা টাকা দিয়ে সব অনৈতিক কাজকে নৈতিকতার সিলমোহরে প্রতিষ্ঠিত করে। এর সঙ্গে আছে ভোগ বিলাসিতা ও অবৈধ সম্পর্ক ও ব্ল্যাকমেইলের তা-ব ও মহাকা-। এভাবে কত যোগ্য ও মেধাবী মানুষ টাকার কাছে প্রতিদিন হারছে কে তার খবর রাখে। অযোগ্য ও অমেধাবীরা টাকার জোরে নায়ক থেকে মহানায়ক, ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাধর হচ্ছে। সব কিছু তাদের দখলে চলে যাওয়ায় দেশ মেধা চর্চা ও তাদের অবদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদের কি চিহ্নিত করা যায় না। হয়তো যায়। অদৃশ্য নেতিবাচক শক্তি কি তা হতে দেবে। কেউ জানে না। হয়তো জানে, জেনেও জানে না।

এবার সম্পর্কের ইতিবাচক শুভশক্তি কথা বলব। যেটা অন্তরের সম্পর্ক, প্রাণের সম্পর্ক। এ অদৃশ্য শক্তিই আমাদের দরকার। যা আমাদের ভাবনাকে প্রভাবিত করবে। বিবেককে তাড়িত করবে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি তার দেশের প্রত্যেককে নিজের অফিসে তাদের সন্তানদের ছবি ঝোলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অফিসে নিজের সন্তানদের ছবি ঝুলান আর যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেদিকে তাকান।’ মহামূল্যবান কথা। আমি দেশের সব মানুষকে একইভাবে অনুরোধ করব, যে যেখানেই থাকুন না কেন নিজের সন্তানদের ছবি সেখানে ঝুলিয়ে রাখুন।

একবার তাদের মায়াবী মুখগুলোর দিকে তাকান। অন্য ছেলে মেয়েগুলোর কথা ভাবুন। এটি আপনাকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। কারণ আপনার হাতেই আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ, দেশের ভবিষ্যৎ।

সাম্প্রতিক সময়ের একটি সত্য ঘটনা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের বিষয়টিকে প্রভাবিত করেছে, যা প্রণোদনার ক্ষেত্রে বিহ্যাভিওর মোডিফিকেশন থিওরির সঙ্গে সম্পর্কিত। যে থিওরিতে বলা হয়েছে- মানুষের ইতিবাচক ধারণাকে যখন স্বীকৃতি প্রদান করা হয় তখন পরবর্তীকালে সে একই ধরনের ইতিবাচক কাজ করে থাকে। আবার যখন মানুষের নেতিবাচক ধারণা তার কাজের ধারাকে নিরুৎসাহিত করে, তখন সে এ ধরনের নেতিবাচক কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে ও ইতিবাচক হওয়ার চেষ্টা করে। ফলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধারণার ফলাফলের ওপর একজন মানুষের পরিবর্তনের বিষয়টি তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ওপর প্রভাব ফেলে। অতি সম্প্রতি একব্যক্তি দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে ‘বাবা তুমি ঘুষ খাও’ শিরোনামে চিঠি লিখে তার জীবনের বাস্তব একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এই পত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন তার ১২ বছরের মেয়ে তনিমার একটি প্রশ্নের কথা। পাশাপাশি মেয়ের সঙ্গে তার জীবনের অনেক স্মরণীয় ঘটনার অবতারণা করেছেন, যা মনকে আলোড়িত করে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছেন, একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলে তার আদরের মেয়েটি তাকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা তুমি কি ঘুষ খাও?’ মেয়ের এমন প্রশ্ন শুনে তিনি বিস্মিত হয়ে পড়েন। তার মনে হয় জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী বলবেন। প্রশ্নটা তার কাছে সহজ মনে হলেও উত্তরটা ছিল অনেক কঠিন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘ঘুষ কি কখনো খাওয়া যায়? এটা তো কোনো খাবার জিনিস নয়।’ কিন্তু মেয়েটি আরও পরিষ্কার করে বলল, ‘তুমি ঘুষ খাও নাকি সেটা জানতে চেয়েছি।’ এর সরাসরি উত্তর চাইল সে। এবার একটা কঠিন ও নির্মম প্রশ্ন করল, ‘বাবা তোমার বেতন কত?’ আর বলতে লাগল-‘এই যে, তুমি গাড়ি কিনেছ, ফ্ল্যাট কিনেছ- এত টাকা কোথায় পেলে, বাবা? মায়ের এত গহনা কোথায় পেলে? লোকজন বাসায় মিষ্টি আনে, ফলমূল আনে, কীসব প্যাকেট আনে, কেন এসব আনে? বল না বাবা, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো দুদক না। সত্য কথা বল বাবা। আমি কিছু চাই না, শুধু সত্যটা জানতে চাই। বল না বাবা, আমি ঘুষখোরের মেয়ে কিনা।’ বাবা ঘুষ খাওয়ার কথা অস্বীকার করলেন। কিন্তু মেয়েটি তা মন থেকে মেনে নিতে পারল না। পরদিন অফিস থেকে ঘরে ফিরে বাবা দেখলেন পোস্টারে লেখা আছে- ‘ঘুষ খাওয়া চলবে না, কোনোমতে ঘুষ না, ঘুষখোরের কন্যা আমি না।’ এরপর থেকে বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাবার দামি গাড়ি সে ব্যবহার করল না। রিকশায় করে সে স্কুলে গেল। কারণ তার মনে হয়েছে এ গাড়ি ঘুষের টাকায় কেনা। পরদিন আবারও দরজায় পোস্টার দেখা গেল। সেখানে কচি হাতের কালো অক্ষরে লেখা ছিল, ‘সাবধান সাবধান ঘরে ঘরে দুদক। ঘুষখোরের কালো হাত ভেঙে দাও। সত্যের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়।’ এমন আরও অনেক কথা। বাবার গায়ে সে তীব্র একটা ঘুষের গন্ধ পেল। বাবা ভাবছেন আর ভাবছেন। তার মনোজগতে নানা ধরনের চিন্তাধারা তার কপালে অশনি সংকেতের ভাঁজ টেনে দিল। নিজেকে তার চোর বলে মনে হলো। বদলে গেল বাবার জীবনধারা। সূত্রপাত হলো সততার পথে নতুন জীবনে যাত্রা। এরপর বাবা চিঠির শেষাংশে লিখেছেন- ‘মেয়েটার হাত ধরে বিকালে হাঁটি। মনে মনে ভাবী আমি এখন ভালো আছি। হেরে গেছি নাকি জিতে গেছি তা বুঝি না। তবে মেয়ে আমার জীবনের নতুন মাত্রার সন্ধান দিয়েছে তা বুঝি।’

জয় হোক শুভ অদৃশ্য শক্তির, পরাজয় হোক অশুভ অদৃশ্য শক্তির। জেগে উঠুক মানুষ শুভ মূল্যবোধের চেতনায়। জীবন হোক আলোকিত। বন্ধ হোক দানবের খেলা।

লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর