সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা মহামারী ও সামাজিক মুক্তি

মঈনউদ্দিন মুনশী, এমডি, পিএইচডি

কভিড-১৯ এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ সংক্রামক অসুখ। এটা প্রথম ধরা পড়ে ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে, তারপর তিন মাসের মধ্যেই এটা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সব মহাদেশে। ইতিমধ্যে এই অসুখে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে মূলত কার্যকরী প্রতিষেধক ও ওষুধের অভাবে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও এই অসুখ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এক সময় সমগ্র বিশ্ব অসহায়ের মতো প্রত্যক্ষ করেছে একের পর এক তাদের আপনজনের মৃত্যু। তাই মরিয়া হয়ে প্রায় সব দেশেই লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ স্কুল-কলেজ, অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়। এতে করে এই অসুখের বিস্তার কিছুটা স্থিত হয়, তবে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় চলে যায়। তখন লকডাউন ব্যবস্থা রহিত করে কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়, তাতে করে বিশ্বব্যাপী এই অসুখের বিস্তার আবার বেড়ে যায়। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে বর্তমানে প্রায় সব দেশেই এই অসুখ ছড়াচ্ছে প্রধানত উপসর্গবিহীন রোগীদের কাছ থেকে। প্রতিদিন প্রায় ২৫০ হাজার মানুষ এই অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে এবং ১০ হাজারেরও বেশি মৃত্যুবরণ করছে। আপাতত মনে হচ্ছে এই অসুখের বিস্তারে পৃথিবী তিন মাস আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। তাহলে, কি আবার লকডাউন করতে হবে? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য কিছু তথ্য জানতে হবে। এ যাবৎকালের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, এই অসুখে আক্রান্ত মানুষের প্রায় ৮১ শতাংশের খুব লঘু উপসর্গ হয় কিংবা কোনো উপসর্গ থাকেই না, এই অসুখে মৃত্যুর হার প্রায় ৩.৪ শতাংশ। অপরদিকে, শুধু লকডাউন করে যদি জনগণ মাস্ক ব্যবহার না করে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখে তাহলে এ অসুখ নিয়ন্ত্রিত হয় না। তাই এই অসুখ বিস্তার রোধে ব্যক্তিগত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, যেমন মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, সম্ভব হলে বাড়িতে থাকা ইত্যাদি মেনে চলতে হবে। এ ব্যবস্থা কতদিন চালিয়ে যেতে হবে এবং কখন সময় হবে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার? সেসব নির্ভর করছে সমগ্র জনসাধারণের অধিকাংশ অর্থাৎ ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার ওপর, সেটা প্রধানত দুভাবে আসতে পারে, ১. টিকা (ভ্যাকসিন)-এর মাধ্যমে অথবা ২. রোগাক্রান্ত হওয়ার ফলে। যেহেতু টিকা এখনো আসেনি, তাই যেটা এখনই জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে, জনগণের কত শতাংশ আক্রান্ত এবং কত শতাংশের শরীরে করোনা অ্যান্টিবডি রয়েছে। রোগমুক্ত ব্যক্তির শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার অ্যান্টিবডি নির্ণয়ের মাধ্যমে। করোনা রোগমুক্তি কী ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, আবার আক্রান্ত হলে সেটা আগের তুলনায় লঘু আকারে হবে কিনা এসব জানা প্রয়োজন। জনসংখ্যা ভিত্তিক পরিকল্পনা নির্ধারণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত মেডিকেল জার্নালসমূহে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে যে, কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ রোগীর শরীরে IgM এবং IgG অ্যান্টিবডি তৈরি হয় উপসর্গ দেখা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, অবশ্য কিছু রোগীর শরীরে এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না। গুরুতরভাবে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে অ্যান্টিবডি বেশি তৈরি হয়। অবশ্য বেশি অ্যান্টিবডি তৈরির সঙ্গে রোগমুক্তির দ্রুততার কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। লঘু উপসর্গ দূর হয়ে যেতে পারে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগেই। রোগীর শরীরে এই ভাইরাসের সংখ্যা হ্রাসের আগেই অ্যান্টিবডি নির্ণয় করা যায়। এটা দেখা গেছে যে, ভাইরাসের সংখ্যা শরীরে বেশি থাকে অসুখের প্রাথমিক পর্যায়ে, এটা কমে আসে যখন অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং অ্যান্টিবডির ক্রমবৃদ্ধি ঘটতে থাকে পরের ২-৩ সপ্তাহ ধরে। রোগীর শরীরে এই ভাইরাস কতদিন থাকবে এবং সে এটা কতদিন ছড়াবে তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। রোগ প্রতিরোধে এই ভাইরাস সৃষ্ট অ্যান্টিবডি  IgG  এবং neutralizing antibody-র ভূমিকা এক নয়। এই রোগের চিকিৎসায় রোগমুক্ত মানুষের শরীরের প্লাজমা (plasma) যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ  neutralizing antibody রয়েছে তা ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়।

এযাবৎ কভিড-১৯ দ্বারা পুনঃ আক্রান্ত রোগীর কথা জানা যায়নি। বর্তমানে স্বল্প গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে যে, এই ভাইরাস রোগমুক্ত মানুষের শরীরে পুনরায় রোগাক্রান্ত না হওয়ার জন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।

এই সময় কভিড-১৯ বিষয়ক কিছু তথ্য জানা খুবই জরুরি, যেমন রোগাক্রান্ত লোকের সংখ্যা, রোগের শ্রেণিভাগ, জনসংখ্যার কতভাগ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থাৎ শরীরে অ্যান্টিবডি আছে ইত্যাদি। কারণ, এগুলোর ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ক্রমে ব্যবসা, স্কুল, কলেজ খুলে দেওয়ার বিষয়ে অঞ্চল ভিত্তিক কভিড-১৯-এর জরিপ এমন হতে পারে যেমন এক এলাকার ৩০টা বাড়ির মধ্যে ৭টা নির্বাচন করা যেতে পারে, তাদের কাছ থেকে জানতে হবে বর্তমানে কারও কভিড-১৯ জনিত উপসর্গ আছে কিনা, আগে ছিল কিনা, কারও কভিড পরীক্ষা দ্বারা শনাক্ত হয়েছে কিনা, কেউ হাসপাতালে ভর্তি ছিল কিনা, কেউ মৃত্যুবরণ করেছে কিনা; এতে রোগের গতি-প্রকৃতি বোঝা যাবে, তখন, তাদের রক্তে অ্যান্টিবডি নির্ণয়ের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের মানুষের কভিড প্রতিরোধ বিষয়ে একটা ধারণা করা যাবে। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চল জরিপে যদি দেখা যায় যে শুধু অল্প সংখ্যক মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি আছে (৫৫ শতাংশের কম) তার অর্থ এই যে এখনো হার্ড-ইম্মুনিটি তৈরি হয়নি। যে জনপদে হার্ড-ইম্মুনিটি তৈরি হয়নি তাদের ভিতরে কভিড বিস্তার চলতে থাকবে অর্থাৎ ব্যক্তিগত সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগুলো মেনে চলতে হবে। গত ১০০ বছরে এই ধরনের মহামারী দেখা যায়নি। কভিড-১৯ একটা অনন্য ভাইরাস, বিভিন্ন মানুষের শরীরে এর উপসর্গ একরূপ নয় এবং রোগমুক্তি জনিত অ্যান্টিবডিও একই ধরনের নয়। প্রাথমিক টিকা (ভ্যাকসিন) যদি ততটা কার্যকরী নাও হয় তবু এটা সম্ভব যে ক্রমে অসুখ জনিত কারণে বেশিরভাগ মানুষের শরীরে কভিড-অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে হার্ড-ইম্মুনিটি গড়ে উঠবে এবং তাতে এই অসুখ ক্রমে নিয়ন্ত্রিত হবে এবং মৃত্যুর হার অনেক কমে যাবে। ওই পর্যায়ে যেতে কতদিন সময় লাগবে সেটা অনিশ্চিত হলেও, এটা নিশ্চিত যে মানুষের জয় হবেই।

লেখক : সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ, সুমা বারবারটন হসপিটাল, ওহিও। ক্লিনিকেল সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, নর্থ ইস্ট ওহিও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ফেলো, যুক্তরাষ্ট্র সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ সমিতি।

সর্বশেষ খবর