বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
সাম্প্রতিক

‘বিষাদ ছুঁয়েছে আজ মন ভালো নেই’

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

‘বিষাদ ছুঁয়েছে আজ মন ভালো নেই’

কবি মহাদেব সাহা তাঁর অমর সৃষ্টি ‘মন ভালো নেই’ কবিতার শুরুতে লিখেছেন : (সংক্ষিপ্ত)

‘বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,

মন ভালো নেই;

ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা

সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,

একবার ফিরেও চায় না কেউ...

এই শূন্যঘরে, এই নির্বাসনে

কতোকাল, আর কতোকাল!...

কেউ নেই কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই...

টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত

ডাকতে ডাকতে একশেষ;

কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না

আমি হিমঘরে ভাঙ্গা চেয়ারে একা বসে আছি॥

এ কি শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,

এভাবে দগ্ধ হবার নাম কি বেঁচে থাকা!

তবুও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়,

আমি বেঁচে থাকতে চাই...

আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক

মন ভালো নেই, মন ভালো নেই॥’

প্রিয় পাঠক! দীর্ঘ প্রায় দুই মাস কাগজ-কলম নিয়ে বসেও কিছু লিখতে পারিনি। ওপরের কবিতাটা বারবার পড়েছি, কবি মহাদেব সাহা ঠিক কত দিন আগে এ কবিতা লিখেছেন বলতে না পারলেও কবিতার বয়স যে ২৫ পার হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কেননা ছাত্রকালেই সম্ভবত কবিতাটি পড়া। সেই আমলে কবি কী ভেবে এভাবে লিখলেন জানি না, তবে গত দুই মাসে নিকটাত্মীয় আপনজন, সহকর্মী, প্রাক্তন সহকর্মী, বন্ধুবরসহ যাদের হারিয়েছি কিংবা যাদের নিদারুণ কষ্টের কথা শুনেছি তাতে বারবার এ কবিতার কথাগুলোই মনে ভেসে উঠেছে। আসলেই তো তাই, মন ভালো আছে আমাদের? রাস্তায় বাস চলছে অথচ যাত্রী সংকট। শূন্য পড়ে আছে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা। অথচ এমন বারান্দা দেখেই তপন চৌধুরীর গানে উঠে এসেছিল ‘কলেজের করিডোরে দেখেছি, চোখ দুটো ছিল যার সুন্দর, মোনালিসা হাসি দিয়ে কেঁদেছে এই বিরহের অন্তর।’ এ বারান্দা আবার কবে সরব হবে কেউ জানে না। হাসপাতালে হাসপাতালে সারা দিন ডেকেও কারও সাড়া পাওয়া যায় না। আর বেসরকারি হাসপাতাল তো ডা. সাবরিনা, কিংবা রিজেন্ট সাহেদের টর্চার সেল, সেখানে টাকা ছাড়া একবার ফিরেও তাকায় না কেউ। ঘরে নিজেকে ‘আইসোলেশন’ কিংবা  ‘কোয়ারেন্টাইনে’ বন্দী রাখা মানুষের প্রাণের আকুতি ‘এই শূন্য ঘরে এই নির্বাসনে আর কতকাল’! মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা অধিকাংশ দোকানি অনেক আশায় বুক বাঁধলেও  এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি বলছে, ‘কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই’। অসহায় প্রবাসীরা দূতাবাসের হটলাইনে টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে ক্লান্ত, কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের এক একজন কর্মকর্তা ঠিক যেন হিমঘরে একা একা বসে আছেন। কবির ভাষায় তাদের চেয়ার হয়তো বা ভাঙা নয়, তবে প্রত্যেকের আসন যে টালমাটাল তাতে সন্দেহ থাকার কারণ নেই। কারোর ক্ষমতার পাদপীঠে যারা অধিষ্ঠিত, দিন শেষে কিংবা মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ‘এ কি শাস্তি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর বলে’ অনুচ্চারিত আক্ষেপ করাও বিচিত্র নয়। কর্মহীন জীবন, মুনাফাহীন বাণিজ্য, বিজ্ঞাপনহীন গণমাধ্যম অনিশ্চিত চাকরির স্থায়িত্ব, অস্তিত্ব সংকটে লাখো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রবাসীদের খাঁচাবন্দী বনের পাখির মতো ডানা ঝাপটানো; গৃহবন্দী শিশু, পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী, উপাসনালয়বিমুখ আতঙ্কিত উপাসনাকারী, শূন্যে নেমে আসা সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, খেলার মাঠে দীর্ঘ ঘাস আর ধুলা জমে থাকা এক একটি মিলনায়তন ও মন এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা? এ প্রশ্ন যেন কবির নয়, সবার আত্মার। তবে এ কথা সত্য, ‘তবুও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমিও বেঁচে থাকতে চাই’। তাই তো আবারও আশায় বুক বাঁধি বিষাদ যতই ছুঁয়ে যাক এ মন, এ বুক, এ দেহ, মন যতই খারাপ থাকুক তবু লড়াই করে যেতে চাই।

আজ লড়াই করে বেঁচে থাকার সময়। নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় কবিতায় কবি হেলাল হাফিজের হীরক উক্তি ছিল- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কেবল যৌবন যার নয় বিগত যৌবনা কিংবা অনাগত যুব দল-মতনির্বিশেষে সব বয়সীর যুদ্ধে যাওয়ার সময় এখন। আর এ যুদ্ধের নাম বেঁচে থাকা। যেভাবে পারুক, বেঁচে  থাকা শুধুই বেঁচে থাকা।

                লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর