বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

দ্রুত পরীক্ষা কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের প্রধান কৌশল

ডা. মো. সোহরাব হোসেন

দ্রুত ও ব্যাপক পরীক্ষা কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান কৌশল। কোনো এলাকা বা দেশে পর্যাপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সেখানকার সব করোনা আক্রান্ত রোগীকে যদি শনাক্ত করে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করা সম্ভব হয় তাহলে সেখানে রোগ বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী পৃথক করা হলে আক্রান্ত রোগী অন্য কাউকে এ রোগ ছড়াতে পারে না। দ্রুত রোগ নিরূপণের আরেকটি সুবিধা, আক্রান্ত রোগীর যথাশিগগির এবং যথার্থ চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর যেসব দেশ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে তারা সবাই এ কৌশলসমূহ অবলম্বন করেছে। কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ডও এটি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পরীক্ষা এবং আক্রান্ত রোগীকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে রাখাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া মাত্র তিন সপ্তাহে ২ লাখ ৭০ হাজার নাগরিককে পরীক্ষা করে ১০ হাজার ৭২৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা প্রদানপূর্বক তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে কভিড-১৯ রোগীর শনাক্তের সংখ্যা প্রথম থেকেই সংক্রমণের তুলনায় অপ্রতুল। যদিও বাংলাদেশ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে পরীক্ষার সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার পরিমাণ আক্রান্তের তুলনায় যথেষ্ট নয়। আর বিলম্বিত পরীক্ষার ফলে রিপোর্টপ্রাপ্তির আগেই রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে নেওয়ার পথে বা সেখানে গিয়েই মৃত্যুবরণ করে (হাসপাতালে মৃত্যুর ৩৫% ভর্তির প্রথম দিনে- প্রথম আলো, ৩ জুলাই, ২০২০)।

করোনা পরীক্ষার জন্য সরকারি বা স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক নীতিমালা রয়েছে কিন্তু তা কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। সে প্রেক্ষাপটে আমি ব্যক্তিগত কিছু পরামর্শ সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি : ক. করোনা পরীক্ষার সার্বিক ক্ষেত্রে ফি আরোপ, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য রোগ নিরূপণের ওপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে পরীক্ষার সংখ্যা হ্রাস রোগ ও সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সুতরাং বিষয়টি পুনর্বিবেচনাকরত পরীক্ষার সুযোগ ধনী-দরিদ্র সবার সক্ষমতার মধ্যে আনয়ন করা। খ. করোনা শনাক্তকরণ বিষয়টি মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল না করে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক করা। আর এজন্য ব্যাপক পরীক্ষা পদ্ধতি অবিলম্বে চালু করা। গ. কভিড-১৯ শনাক্তকৃত ব্যক্তির পরিবার ও বিগত কয়েকদিনে সে যাদের সংস্পর্শে এসেছে তাদের মধ্যে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা ও সঙ্গনিরোধ করতে বাধ্য করতে হবে। ঘ. বিগত এক বা দুই সপ্তাহে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের তালিকা বিশ্লেষণপূর্বক যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেগুলোকে চিহ্নিত করা। এ বিষয়ে যদিও আংশিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পুরো দেশের জেলাসমূহকে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। তবে গৃহীত ব্যবস্থা থেকে পূর্ণ সুবিধা পেতে তথাকার করোনা আক্রান্তদের কার্যকরভাবে পৃথক করতে হবে এবং সন্দেহভাজন বা রোগীর সংস্পর্শে আশা ব্যক্তিবর্গকে পরীক্ষা ও সঙ্গনিরোধে থাকতে বাধ্য করতে হবে। ঙ. কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের শ্রেণিবিন্যাস করে মৃদু আক্রান্তদের বাসায় রেখে চিকিৎসকের দেওয়া পরামর্শ মোতাবেক ব্যবস্থা এবং তীব্র ও অতিতীব্র সংক্রমিতদের হাসপাতালে এনে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান। চ. র‌্যাপিড টেস্ট কিট দ্বারা অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি দুটিই নির্ণয় করা যায় এবং এর দ্বারা খুবই দ্রুত ও সহজে রোগ নিরূপণ করা যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ এখন এটি ব্যবহার করে সফলতা লাভ করছে। দক্ষিণ কোরিয়া ১২০টি দেশে র‌্যাপিড টেস্ট কিট রপ্তানি করছে। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা সুযোগের যে অপ্রতুলতা বিদ্যমান তাতে যথাশিগগির র‌্যাপিড টেস্ট কিট সংগ্রহ করে দ্রুত পরীক্ষার ব্যাপকতা বৃদ্ধি করা। ছ. উপরোল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করে করোনা সংক্রমণ রোধ ও মৃতের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা একটি Time Bound Road Map  প্রস্তুত করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তবায়ন। জ. বর্ণিত বিষয়াবলি দেশব্যাপী বাস্তবায়ন একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীর অন্য দেশও তা পারেনি।

সুতরাং তাদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সমন্বয় করে করোনা যুদ্ধের মোকাবিলা করা একান্ত আবশ্যক। ঝ. কভিড-১৯ আক্রান্তের অধিকাংশ ক্ষেত্রে জ্বর, রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি এবং ফুসফুসের অস্বাভাবিক চিত্র পরিলক্ষিত হয়। তাই অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার সুযোগ পাওয়া না গেলে এসব ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা উচিত। এ বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করা। করোনা সংক্রমণের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম (Worldometers, ৩ জুলাই, ২০২০)। যার বর্ধনশীল হার লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার দুরন্ত গতির মতো বাড়ছে এবং মৃত্যুর মিছিল যেভাবে বাড়ছে তাতে বাংলাদেশে কভিড-১৯-এর ভয়াবহতার আশঙ্কা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনার এ ভয়ঙ্কর থাবা থামাতে আমাদের ব্যর্থতা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা কি ধারণা করার মতো? অথচ বাঙালি তো সেই জাতি যারা ১৯৭১ সালে দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল। যারা কলেরা, বসন্ত, পোলিওসহ জনস্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক রোগব্যাধিকে নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, অর্থনীতির তেজি ঘোড়াকে উজ্জীবিত করে দারিদ্র্য ও জরাগ্রস্ত এ দেশটিকে উন্নতির স্বর্ণশিখরের দিকে ধাবিত করে আসছিল। আমাদের জাতীয় জীবনে এ দুর্লভ সফলতাপ্রাপ্তি সম্ভব হয়েছিল এ দেশের জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অংশীদারিত্ব। কিন্তু সে জাতি দুর্ধর্ষ করোনার ভয়ঙ্কর থাবায় পর্যুদস্ত হতে চলেছে। এর অন্যতম কারণ দেশের সব নাগরিককে করোনা নিয়ন্ত্রণে অংশীদারিত্ব গ্রহণে উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হওয়া। করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় অতি সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মানাতে সমর্থ না হওয়া। এ দেশকে করোনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করতে পরীক্ষার ব্যাপকতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নিয়মানুবর্তিতা চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশে কভিড-১৯ শুরু হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস। দিনের পর দিন বিপদ বৃদ্ধিই পাচ্ছে। এ মুহূর্তেই অভূতপূর্ব এ মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় এ দেশের সরকার ও জনগণের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া একান্ত আবশ্যক, আর তা এখনো অসম্ভব নয়।

 

লেখক : জেনারেল সেক্রেটারি Rabies in Asia Foundation Bangladesh Chapter.

সর্বশেষ খবর