শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা

ড. আ. ন. ম. এহছানুল হক মিলন

করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা

কভিড-১৯ ভাইরাসটি ২০১৯ সালের ঠিক কোন সময়ে এসেছিল, সে সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য বিশ্ববাসী জানতে পারেনি, তবে প্রচলিত আছে- এ সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তিস্থল চীনের উহান প্রদেশে। আমরা জানি, সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত দেশগুলোর সংবাদমাধ্যম খুব কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত, সে ক্ষেত্রে কভিড-১৯ নামকরণের কারণে এ মহামারীর জন্ম ২০১৯ সালের কোনো এক সময়ে। পরবর্তীতে এ সংক্রামক ব্যাধিটি বিশ্ব পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে, বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো তখন এ মহামারীর ভয়াবহতা অনুমান করতে পারেনি। ২০২০ সালের নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য চীনের উহান— ইতালির মিলানের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ ছিল, যে কারণে ইতালি তার সর্বোচ্চ খেসারত দিয়েছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ কর্তৃত্বধারী দেশটি এ মহামারীকে মোটেই আমলে নেয়নি বরং যতক্ষণ পর্যন্ত না ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আক্রান্ত হলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ঘুমিয়ে ছিলেন, এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্ত ও দিকনির্দেশনা, ট্রাম্প প্রশাসনের মতো অনেকেই আমলে নেয়নি। অন্যদিকে আমরা করোনা বর্ষের পরিবর্তে ব্যস্ত ছিলাম অন্য এজেন্ডা নিয়ে।

৮ মার্চ, ২০২০ প্রাণঘাতী করোনার প্রথম সূচনা ঘটল বাংলাদেশে। ১৮ মার্চ বিনা প্রস্তুতিতে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়। স্বল্প ছুটি ঘোষণা দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ যেমন বই-খাতা, কলম, ট্যাব, ল্যাপটপ সঙ্গে না নিয়েই যার যার গ্রামের বাড়ি চলে যায়। পরবর্তীকালে ছুটি বাড়ানো হয় এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাতীয়ভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। দেশের প্রান্তিক জনগণ মহাউল্লাসে ঈদের ছুটির মতো আনন্দ উপভোগের জন্য দলে দলে লঞ্চ, স্টিমার, বাসে বা ট্রেনে পৌঁছে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে। করোনাকালে কীভাবে শিক্ষার্থীরা প্রাত্যহিক পড়াশোনা চালিয়ে যাবে, সে সম্পর্কে কোনো গাইডলাইন পায়নি। এমনকি ছুটির সঙ্গে সারা দেশকে লকডাউন করা হবে, এ বিষয়টি শিক্ষার্থীদের অবগত করার প্রয়োজনটি অনুভব করেননি শিক্ষাসম্পর্কিত বিশিষ্টজনেরা। পরে ২৭ মার্চ, সব অফিস-আদালত ছুটি ঘোষণা করা হয়। জুন থেকে অফিস-আদালত ফের চালু হলেও উত্তর মেলেনি শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে কী হবে। অনেকের ভাবনায় ছিল হুট করে করোনা যাবে চলে, সেই ফাঁকে সবকিছু হয়ে যাবে ঠিক, কোর্স ছোট করে সীমিত সিলেবাসে বা ১৯৭১ সালের মতো অটো প্রমোশন দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিরা একবারও জানার চেষ্টা করেননি বিশ্ব-মিডিয়া থেকে করোনার স্থায়িত্বের বিষয়ে। ভাবেননি কালক্ষেপণ না করে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। করোনার বাস্তবতা মেনে নিয়ে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে চালিয়ে নিতে হবে।

বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষাকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত কিংবা মালয়েশিয়া বাণিজ্যিকায়ন করেছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোটেই পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। অনলাইন এডুকেশন বিশ্বসমাদৃত, তাই বলে ক্লাসরুমের প্রয়োজন নেই, এমনটিও ছিল না, উভয়ের সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছিল পৃথিবীময়। বাংলাদেশ সে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ইতোমধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশের সেøাগানে উদ্বেলিত। ইন্টারনেটে ব্রডব্যান্ড ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত অব্যবহারকৃত ব্যয়ও বহন করছে বর্তমান সরকার। এ বিদ্যুৎ অপচয়কে সাশ্রয়ী ও ইন্টারনেটকে দেশের প্রান্তিক জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য শিক্ষায় করোনা অভিশাপ না হয়ে অনুঘটক (CATALYST) হিসেবে বিশ্বায়নের যুগে অনলাইন শিক্ষা প্রতিযোগিতায় আশীর্বাদ হিসেবে পেতে হবে বাংলাদেশকে।

অন্যদিকে পরিপূর্ণভাবে আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণের কারণে পাশের দেশ ভারতের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী আমেরিকার নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে ভর্তি হয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ওভাল অফিস থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা না দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে অনলাইন শিক্ষার বিকল্প নেই। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে লেখাপড়া চালুর চেষ্টা করছে। প্রসঙ্গত, অনেক সিনিয়র শিক্ষক মানসিকভাবে অনলাইন শিক্ষায় অনভ্যস্ত হওয়ায় অনলাইন ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও সরকারের অনলাইন শিক্ষক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।

করোনাকালীন বাজেটে শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পরও এবারের ২০২০-২১-এর বাজেটে কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বাজেটে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, এতে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২% ও মূল্যস্ফীতি ৫.৪%। যদিও মোট রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, বিদেশি উৎস থেকে ৮০ হাজার কোটি এবং ঘাটতি প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে বাজেট বিশেষ ভূমিকা রাখবে এটাই ছিল জনগণের আকাক্সক্ষা। ইউনেসকো কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশীয় শিক্ষাবিদের প্রত্যাশা ছিল এ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ২০% শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার। কিন্তু গতানুগতিকভাবে এ বছরও শিক্ষায় বরাদ্দ হয়েছে ১১.৬৯%। যদিও আমরা বরাবরই শুনি, শিক্ষা খাতে প্রায় ১৫% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ মানব সক্ষমতা উন্নয়নে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এবারও শিক্ষা খাতে বাজেটের বরাদ্দ বেশি দেখানোর জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ৮৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট বাজেটের ১৫.১০% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সারসংক্ষেপে বলা চলে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রাক্কলিত ২৪ হাজার ৯৪০ কোটি, যা আনুপাতিক হারে ৪.৩৯%, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রাক্কলিত ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি, যা জাতীয় বাজেটের আনুপাতিক হারে ৫.৮৩%, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে ৮ হাজার ৩৪৪ কোটি, যার আনুপাতিক হার ১.৪৭% ও অন্যান্য অপারেটিং, উন্নয়ন সব মিলিয়ে মোট জাতীয় বাজেটের ১১.৬৯%। বাকিটুকু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি, যা আনুপাতিক হারে ৩.১৬% এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্য ১ হাজার ৪১৫ কোটি, যা আনুপাতিক হারে ০.২৫% অর্থাৎ শিক্ষা বিভাগকে বেশি বরাদ্দ দেখানোর জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের বাজেটকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা, বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা অর্থাৎ জাতীয় বাজেটের আনুপাতিক হার ১৫.১০% দেখোনো হয়েছে। মূলত এটাই শিক্ষা খাতে বাজেটের শুভঙ্করের ফাঁকি।

এবারের মূল্যস্ফীতি ৫.৪% হলেও গত বছরের তুলনায় এ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ০.০১% অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় প্রকৃত অর্থে শিক্ষা খাতে বাজেটের বরাদ্দ কমেছে। এ বাজেট কভিড-১৯-এর ফলে শিক্ষার্থীরা যে নানামুখী ক্ষতির মুখে পড়েছে তার জন্য দু-তিন বছর মেয়াদি একটি শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি বাজেটের প্রয়োজনীয়তা ছিল। অন্যদিকে শিল্পবিপ্লবের চতুর্থ ধাপে আজ বিশ্ববাসী, তা মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা Artificial Intelligence,  Robotics, Nano Technology-এর চর্চা করছে। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার কোনো প্রস্তুতি এ বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। এমনকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আয় প্রবাসীদের মাধ্যমে উপার্জিত হলেও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষা অপরিহার্য হওয়ার পরও বাজেটে তা পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ মানবসম্পদ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের কর্মক্ষম নাগরিকের সিংহভাগ ১৫ বছর বয়স থেকে ৬৪ বছর বয়স প্রায় ৬৫% মাত্র ৫% যাদের বয়স ৬৫-এর ওপর আর ৩০% হলো ১৫ বছরের নিচে। এ দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট পে করার সময় ২০০৭ থেকে ২০৪২ সাল পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত রাষ্ট্র থেকে মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র হতে যে পরিমাণ মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন থেকে মুক্তি পেতে হলে শিক্ষা বাজেটে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি।

সামগ্রিকভাবে করোনাকালীন নন-রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক শিক্ষক ও নন-এমপিও শিক্ষকদের এ মহামারীকালীন দুর্যোগে বিশেষ ভাতা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যদিও নন-এমপিও শিক্ষকদের ৫ হাজার টাকা করে এককালীন ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, অন্যদিকে প্রায় ৪০ হাজারের মতো বিভিন্ন রকম কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদের জন্য কোনো অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতি বছর প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এনসিটিবি কর্তৃক প্রায় ১১৫০ কোটি টাকার বিনামূল্যের বই বিতরণ করে। যদি বর্তমান সরকার অনলাইন শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বইয়ের পরিবর্তে ট্যাব আকারে ই-বুক বিতরণ করে তাহলে আগামী দিনে ব্যয় অনেকাংশে সাশ্রয়ী হবে। কারণ, পাঠ্যপুস্তক পরবর্তী বছরে ব্যবহারযোগ্য নয় বলে পুনর্বার প্রিন্ট করতে হয়। অথচ ট্যাব পরবর্তী বছরের শিক্ষার্থীদের জন্য সরবরাহ করা যেতে পারে। ই-বুক, ই-লাইব্রেরি, বাংলাদেশ বেতারের দ্বিতীয় চ্যানেলটি, যা সংসদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় দূরশিক্ষণের জন্যই করা হয়েছিল। এর উপযুক্ত ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য ইন্টারনেট প্রভাইডারদের স্বল্পমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তাদের পরিচয় কোডের মাধ্যমে ইন্টারনেট দিতে হবে। সব লাইব্রেরির বইকে ই-লাইব্রেরিতে কনভার্ট করতে হবে।

                লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, আন্তর্জাতিকবিষয়ক          সম্পাদক-বিএনপি ও চেয়ারম্যান, এডুকেশন রিফর্ম            ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই)।

mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর