রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড-১৯ মোকাবিলায় একলা চলো নীতি নয়

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

কভিড-১৯ মোকাবিলায় একলা চলো নীতি নয়

শিরোনাম বিষয়ে আলোচনার আগে প্রাণবিজ্ঞান নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলতে হবে। গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে প্রাণবিজ্ঞানকে (Life sciences) বিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর শাখা হিসেবে সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। তারই হাত ধরে বর্তমান একবিংশ শতাব্দীকে প্রাণবিজ্ঞানের শতাব্দী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রাণবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যেমন প্রাণরসায়ন (Biochemistry), অণুজীব বিজ্ঞান (Microbiology), বাইরোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, ইমিউনোলজি রয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ফার্মেসি মূলত প্রাণবিজ্ঞানের অংশ। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে প্রাণরসায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (Molecular Biology)। প্রাণবিজ্ঞানের এসব শাখার মধ্যে সবচেয়ে সামনের বিজ্ঞান হচ্ছে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (Biochemistry and Molecular Biology)। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশে এবং তার আগে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাণবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রাণরসায়নই সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক কামালুদ্দিন আহমদের উদ্যোগে। এ বিভাগ থেকেই পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ফার্মেসি, অণুজীব বিজ্ঞান, খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি আত্মপ্রকাশ করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৫৭ সালে প্রাণরসায়ন বিভাগে অনার্স কোর্স চালু হয় এবং সে সময় এ বিভাগটি ছিল সারা ভারতবর্ষে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ। ২০০৩ সালে আমি বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রাণরসায়ন বিভাগের নাম পরিবর্তন করে আমরা প্রাণরসায়নের সঙ্গে অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (Biochemistry and Molecular Biology)  যুক্ত করি। সময়ের চাহিদা মেটাতে আমরা তা করেছিলাম। একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বায়োকেমিস্ট্রিতে আলাদাভাবে নোবেল প্রাইজ না থাকলেও রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন আবিষ্কারের জন্য প্রতি বছর যে নোবেল প্রাইজ প্রদান করা হয়, তার এক বড় অংশ লাভ করেন বায়োকেমিস্ট বা প্রাণবিজ্ঞানীরা। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে বায়োকেমিস্ট্রি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায়। আমাদের দেশে কিংবা বিদেশে এমবিবিএস কোর্সের যে সিলেবাস, তাতে প্রথম বর্ষে বায়োকেমিস্ট্রি একটি অবশ্য পঠিত বিষয়। কিন্তু তা সর্বমোট ১৯টি কোর্সের মধ্যে একটি কোর্স মাত্র। বায়োকেমিস্ট্রি বা প্রাণরসায়নের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান আমলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের প্রাণরসায়ন বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য প্রাণরসায়ন বিভাগ থেকে পাস করা স্নাতকোত্তর গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। কারণ বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগে চার বছরের অনার্স, থিসিসসহ মাস্টার্স করে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রথম বর্ষে বা এমবিবিএস-পরবর্তী উচ্চতর পর্যায়ে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি পাঠদানের জন্য এ বিষয়ের মূল বিভাগ থেকে শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে চিকিৎসাশাস্ত্রে পাস করা এ বিষয়ে খুবই খ-িত জ্ঞানের অধিকারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এর বিপর্যয়কর ফল আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বাংলাদেশে করোনা মহামারীর দুঃসময়ে।

আমাদের দেশে চিকিৎসাশাস্ত্রে এমবিবিএস ও এফসিপিএস পর্যায়ে বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার ব্যবস্থা থাকলেও গত প্রায় ৫০ বছর ধরে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজির ওপর নির্ভর করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিপুল অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে, সেসব বিষয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান ও গবেষণার সক্ষমতা আমাদের দেশের চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে এ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্তদেরও নেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কঠিন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই মাত্র চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নের সুযোগ পায়। কিন্তু ওপরে বর্ণিত সীমাবদ্ধতার কারণে কঠিন সত্য হচ্ছে, বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিষয়ে আমাদের চিকিৎসকদের খুবই সীমিত জ্ঞানের কারণে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় তাঁদের নিতান্ত অপ্রস্তুত অবস্থা। এ পর্যায়ে করোনাভাইরাস এবং তা থেকে সৃষ্ট মহামারী, তা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা- এসবের পেছনকার বিজ্ঞান নিয়ে কিছু বলব। করোনা একটি ভাইরাস, যা পুরো জীবন্ত নয়। শুধু একটি জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে সে বংশ বিস্তার করতে পারে। ভাইরাস এবং সব জীবন্ত প্রজাতির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে ওই প্রজাতির মধ্যকার জেনেটিক উপাদান। মানুষ ও সব উচ্চতর প্রজাতি এবং এককোষী প্রজাতির ক্ষেত্রে এ জেনেটিক উপাদান হচ্ছে ডিএনএ। কোষের গোটা ডিএনএকে ওই প্রজাতির জেনোম বলা হয়। ভাইরাসের ক্ষেত্রে এ জেনোমটি হচ্ছে ডিএনএ অথবা আরএনএ। করোনা হচ্ছে এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস যা আমাদের দেহে প্রবেশ করে অতি দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে। ডিএনএ ভাইরাস থেকে আরএনএ ভাইরাসের বিশেষ পার্থক্য হচ্ছে, এ ভাইরাস দ্রুত নিজের রূপ পরিবর্তন করতে পারে। কারণ বংশ বিস্তারকালে এ ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান আরএনএর মধ্যে প্রতিনিয়ত মিউটেশন ঘটে। করোনাভাইরাসের নিউক্লিওটাইড (জেনোমের একক) মাত্র ৩০ হাজার। অর্থাৎ তার জেনোমের আকার খুবই ছোট। তাই এ জেনোমের সম্পূর্ণ নিউক্লিওটাইডের ক্রমবিন্যাস নির্ধারণ (যা ভাইরাসটি সম্পর্কে জানা এবং তার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন ও রোগ নিরাময়ে ওষুধ আবিষ্কারের জন্য অত্যন্ত জরুরি) বেশ সহজ। সেজন্য এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে প্রায় ৭০ হাজারের মতো করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন হয়েছে। জার্মানির GISAID (Global Initiative on Sharing All Influenza Data) নামের ডাটা ব্যাংকে এসব তথ্য জমা হচ্ছে এবং সবার জন্য তা উন্মুক্ত।

এবারে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার সবচেয়ে নির্ভুল পরীক্ষা আরটিপিসিআর (RTPCR) সম্পর্কে বলব। এ পরীক্ষা দ্বারা সরাসরি করোনার জেনেটিক উপাদান আরএনএর উপস্থিতি জানা যায়। রোগীর গলা ও নাক থেকে সংগৃহীত সোয়াব থেকে আরএনএ পৃথক করে তা থেকে ডিএনএ তৈরি করা হয়। পিসিআর মেশিনে সেই ডিএনএর অসংখ্য কপি তৈরি করে দেখা হয় করোনার আরএনএর সঙ্গে তার মিল আছে কিনা। এ বছরের শুরুতেই যখন করোনা শনাক্তকরণের এ নির্ভুল পরীক্ষা সম্পর্কে জানা গেল, তখন আমাদের দেশে আরটিপিসিআর পরীক্ষা সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানে যথেষ্টসংখক দক্ষ জনবল (বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার) ছিল। শুধু তাই নয়, সরকারি আইইডিসিআর ছাড়াও বিভিন্ন পাবলিক ও কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআরবি, ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, বিসিএসআইআর, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি নানা গবেষণা সংস্থার সংশ্লিষ্ট বিভাগের ল্যাবরেটরিতে পিসিআর মেশিন ছিল। আরএনএসহ প্রাণবিজ্ঞানের নানা গবেষণায় এ মেশিনের ব্যবহার শুধু নয়, অত্যন্ত ছোঁয়াচে ও প্রাণঘাতী জীবাণু নিয়ে কাজ করার জন্য সুরক্ষিত ল্যাবরেটরি ও সুরক্ষা পরিবেশ গড়ে তোলা বিষয়ে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা এখানে কাজ করেন। নিতান্ত পরিতাপের কথা, বাংলাদেশের চিকিৎসকসমাজের একলা চলো নীতি এবং আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন অযোগ্যতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকের বাইরে ভিন্ন শাখার (বায়োকেমিস্ট্রি, মলিকুলার বায়োলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার) দক্ষ জনবল না থাকায় মহামারী শুরুর অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েক মাস করোনা পরীক্ষার জন্য আরটিপিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়নি। একমাত্র সরকারি আইইডিসিআর পরীক্ষাগারে খুবই সীমিতভাবে কিছু পরীক্ষা হয়েছে। শুরু থেকেই বায়োকেমিস্টরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর বরাবর বারবার আবেদন করেছেন করোনা পরীক্ষায় তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে। তারা কর্ণপাত করেননি। আরও পরিতাপের কথা, করোনার সম্পূর্ণ জেনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য যে নমুনা প্রয়োজন তা ব্যবহারে বা প্রাপ্তিতে সরকারি অনুমোদন না থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গবেষণা শুরু করতে পারেনি। এর কারণ হলো চিকিৎসকসমাজ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং খোদ সরকার করোনা মহামারী মোকাবিলায় শুধু চিকিৎসকদের অংশগ্রহণকে যথেষ্ট মনে করেছে। সেজন্যই ১৭ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইরে আর কোনো বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। এমন অবস্থা একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও দেখা যাবে না।

যা হোক, দেশের এ মহাদুর্যোগে আমাদের গ্র্যাজুয়েট বায়োকেমিস্টরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন। নেতৃত্ব দেয় গ্র্যাজুয়েট বায়োকেমিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (জিবিএ)। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে দেশের সাহসী সন্তানরা যেমন জীবনদানে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি আমাদের বায়োকেমিস্টরা জীবনের ঝুঁকিকে পরোয়া না করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতাল যেখানে আরটিপিসিআর মেশিন চালু করা যায়নি বলে পড়ে আছে, সেখানে স্বেচ্ছাসবী হিসেবে চলে যান এবং মেশিনগুলো চালু ও সুরক্ষা ল্যাবরেটরি গড়ে তোলায় কাজ শুরু করে দেন। যে কোম্পানি মেশিনগুলো সরবরাহ করেছে, কিন্তু এগুলো চালু করার জন্য তাদের দক্ষ জনবল নেই, তারা সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে বায়োকেমিস্ট গ্র্যাজুয়েট স্বেচ্ছাসেবীদের যানবাহন ও থাকা-খাওয়ার সুবিধা করে দেয়। বায়োকেমিস্টদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এভাবেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনা টেস্টিং ল্যাবরেটরি চালু হতে শুরু করে। পরে বায়োকেমিস্ট ছাড়াও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি ও মাইক্রোবায়োলজি গ্র্যাজুয়েটরাও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এ মহতী কাজে যোগ দেন। জিবিএ অনলাইন ও প্রাকট্রিক্যাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে RTPCR সম্পর্কিত সব বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের অধিকতর দক্ষ করে তোলে।। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী দফতরের নজরে আমাদের আবেদন পৌঁছানো সম্ভব হয় এবং ২৯ এপ্রিল, ২০২০ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির কার্যালয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আমি জিবিএ নেতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে এক আলোচনায় মিলিত হই। ডিজি ও চিকিৎসক নেতারা করোনা মহামারী মোকাবিলা এবং করোনা টেস্টিং ও বায়সেইফটি ল্যাবরেটরি গড়ে তোলায় বায়োকেমিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হন এবং সে মর্মে গ্র্যাজুয়েট বায়োকেমিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বরাবর পত্র দিয়ে তা জানান। যদিও বাংলাদেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়াই সীমাহীন বঞ্চনার শিকার হয়েও বায়োকেমিস্টরা কাজ করে যাচ্ছেন, সেখানে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বায়োকেমিস্টদের প্রয়োজনীয়তার সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া গেল। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ২০ জন বায়োকেমিস্ট অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনতিবিলম্বে দেশের বিভিন্ন জেলায় জরুরি ভিত্তিতে আরও অধিকসংখ্যক বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি বিভাগ থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ প্রদান করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুবই উন্নত দেশগুলো যেখানে করোনা মহামারীর কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে, সেখানে অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশে যদি আমরা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো বর্তমান দুর্যোগে একযোগে সমন্বিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারি, তাহলে দরিদ্র জনসাধারণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নের যে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, দারিদ্র্যকে জয় করে উন্নত জীবনলাভের স্বপ্ন দেখছে, তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা, পেশাগত রেষারেষি, রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ, অর্থ অপচয়, দুর্নীতি, ভুয়া রিপোর্ট কিংবা অসৎ গণবিরোধীদের সরকারি আনুকূল্য প্রদানের কারণে বহির্বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তা আর মেনে নেওয়া যায় না। কঠিন হাতেই তা দমন করা প্রয়োজন। আমলা ও গোষ্ঠীতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে যার যে কাজ তাকেই তা করতে দিন। আমাদের সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অনুধাবন করতে হবে যে, অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছুসংখ্যক বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি গ্র্যাজুয়েটকে স্বল্প কয়েক মাসের জন্য নিয়োগ দিলে হবে না, সরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও আইইডিসিআরের মতো সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিসহ নিয়োগ প্রদানের দ্বারটি যদি উন্মুক্ত করা না হয়, তাহলে আমাদের এ দুর্দশা ও দুর্ভাগ্য যে আরও প্রলম্বিত হবে তা সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর জন্য উপযোগী ভ্যাকসিন ও ওষুধ নিজেরাই উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন কখনই হবে না। কিউবা, ভারত, ভিয়েতনামসহ তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশ এসব কাজ করতে পারলে, আমরা তা পারব না, তা কখনো এ দেশের সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে না। দুনিয়াব্যাপী চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার প্রাচীর উঠে যাচ্ছে।

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মানুষ রেষারেষির বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ রাখার পরিবর্তে সমন্বিত উদ্যোগে শামিল হচ্ছেন। সে কারণেই অবিশ্বাস্য কম সময়ে চীন ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তা ব্যবহার-উপযোগী করার দ্বারপ্রান্তে। মনে রাখতে হবে, আমাদের জনগোষ্ঠীর উপযোগী করে ভ্যাকসিন তৈরির সামর্থ্য আমাদের আছে। চলুন বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি এবং প্রাণবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিয়োজিত সবাই একযোগে তা সফল করি। আমরা তা পারব।

 

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক।

সর্বশেষ খবর