আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/ আসে নাই কেহ অবনী পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’ কবি কামিনী রায়ের এ কবিতাটি স্কুলজীবনে পড়েননি, পঞ্চাশোর্ধ এ রকম লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কবি তাঁর চারটি চরণে মানবতাবাদের এক বিশাল ক্যানভাস এঁকেছেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় এর অন্তর্নিহিত মানবিকতা, শক্তি, দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। করোনার এ নিদানকালে যার প্রাসঙ্গিকতা বিশ্বব্যাপী সমভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশেও করোনা চার মাস পেরিয়েছে। আক্রান্তের হার যেমন বাড়ছে, তেমন মৃত্যুর সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সীমিত সম্পদে সরকার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তা সত্ত্বেও এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, মোটামুটি সারা বিশ্বের চিত্রও একই। করোনা কেবল জীবন নিচ্ছে না, করোনা জীবিকার ওপরও হানছে মরণ ছোবল। হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে। দিন আনে দিন খায় মানুষের অবস্থা বড়ই করুণ। ব্র্যাক ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, করোনার কারণে ৩৬% লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছে। ৩% লোক চাকরি থাকলেও বেতন পায়নি। দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করে তার ৬২% কাজের সুযোগ হারিয়েছে। সরকার প্রদত্ত ১০ টাকা কেজি চাল কেনার লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। করোনা আরও কিছুকাল বহাল থাকলে সামাজিক বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। বিগত ১১ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের ধারাবাহিক সাফল্য হুমকির মুখে পড়বে। সরকারি চাকরিজীবী যে পর্যায়েরই হোক, একটু নিরাপদে আছে, কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই অনিশ্চিত। এজন্য সরকারের তরফ থেকে করোনায় বিপর্যস্ত মানুষকে চাল-ডাল, নগদ অর্থ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রতি মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান ও সীমিত আকারে ধনী লোক এগিয়ে এলেও সর্বগ্রাসী এ ক্ষুধা ও চাহিদার মোকাবিলায় তা অতি নগণ্য। আমাদের ধনী ব্যক্তিরা এগিয়ে এসেছেন সত্য কিন্তু আমরা একজন রতন টাটা পেলাম না, যিনি বলতে পারেন প্রয়োজনে সব বিত্ত-সম্পদ বিক্রি করে করোনাযুদ্ধে শরিক হব। আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরের কথা না-ই বা বললাম। গত প্রায় অর্ধশতক ধরে যাদের ব্রেস্ট ফিডিং করে গড়ে তোলা হলো এবারের করোনাসংকটে তাদের আচরণ, মনোভাব ও কার্যক্রম (ব্যতিক্রম বাদে) খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এ সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী সমস্যা মোকাবিলায় দেশের প্রতিটি লোককেই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেককে খেয়াল করতে হবে, আমার চারপাশের মানুষের অবস্থা কেমন। কে কোন সংকটে আছে। প্রত্যেকে যদি নিজের চারপাশে তাকাই তাহলেই সম্মিলিতভাবে সারা দেশের দিকে তাকানো হবে। উদ্যোগ নিতে হবে যাদের ন্যূনতম সামর্থ্য আছে তারাও যেন সীমিত পরিসরে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আপনার উপার্জনের মাত্র ১% বা শতকরা ১ টাকা বরাদ্দ করুন তাদের জন্য যারা এ দুর্যোগে বড় অসহায়। করোনা আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে দুই বেলা অন্ন জোগাড়ের অনিশ্চয়তা যাদের দুর্বল করে তুলেছে। এখন প্রশ্ন- কীভাবে ১% টাকা দিয়ে অন্যকে সহায়তা করা যাবে।
এ সূত্রটি আমাকে শিখিয়েছিলেন আমার মরহুমা জননী, আজ থেকে ২৫ বছর আগে। একদিন তিনি আমাদের তিন ভাইকে ডেকে বললেন, তোমরা সংসার খরচের বাইরে আমার ব্যক্তিগত তহবিলে তোমাদের উপার্জনের সামান্য কিছু টাকা দেবে। আমার ব্যক্তিগত খরচ আছে। আমরা জানতাম, সে টাকা তিনি গরিব-দুঃখী-আত্মীয়-দূরআত্মীয়-পাড়া পড়শি-ফকির-মিসকিনকে দেন। ২০০২ সালের এপ্রিলে মায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা এটা অব্যাহত রেখেছিলাম। মায়ের মৃত্যুর পর আমরা সে তহবিলে প্রতি মাসে সাধ্যমতো টাকা দিই এবং সে কার্যক্রম এখনো বহাল আছে। সময়ের প্রবাহে আমাদের ভাতিজা-ভাগিনারাও এতে সম্পৃক্ত হয়। এটিকে আমি 1% Club ক্লাব নাম দিয়ে ২০০২ সালের জুলাইয়ে (মায়ের মৃত্যুর পর) আধা-প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিই, এটি এখনো পর্যন্ত আমাদের পরিবারে সীমাবদ্ধ কিন্তু করোনার এ আকালে আমার মনে হয় এটিকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আসুন আমরা কবি কামিনী রায়ের কবিতার চরণ ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’- এ বাণীতে উদ্বুদ্ধ হই। প্রত্যেকে নিজস্ব পরিম-লে, তা যত ক্ষুদ্রই হোক, 1% Club গড়ে তুলি। এটি সরকারি-বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা-এনজিওসহ সব প্রতিষ্ঠানে গঠন করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কেউ সম্মত হলে কেবল তাকেই সদস্য করা যাবে। কোনোভাবেই এটি বাধ্যতামূলক বিষয় নয়। যে কেউ ইচ্ছা করলে যে কোনো সময়ে এ কার্যক্রম থেকে সরে যেতে পারে। এজন্য কোনো জবাবদিহিও থাকবে না। এটি সম্পূর্ণরূপে স্বেচ্ছাধীন খাত হিসেবে পরিচালিত হবে, এর কোনো Organization expenditure থাকবে না। তবু যদি কোনো খরচ অনিবার্য হয়, তবে তা মোট তহবিলের ৫%-এর বেশি কখনই হতে পারবে না। এ রকম স্বেচ্ছাধীন মানবিক সহায়তা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ও সমমনা ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে। এর কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় চরিত্র থাকবে না। সদস্যসংখ্যা একের অধিক হলেই হবে। ৫/৭/১০/ ২০ জন বা ততোধিক। প্রতি মাসে নিজেদের আয়ের স্বঘোষিত ১% ওই তহবিলে জমা দেবে। শতকরা ১% দিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। আপনার মর্জি, আপনি যা দেবেন। মাস শেষে সে অর্থ আপনার চারপাশের কোনো এক বা একাধিক অভাবী/সমস্যা -জর্জরিত/অসুস্থ ব্যক্তিকে দিই। একজন উদ্যোগী হলেই এ দায়িত্ব পালন করা যায়। আপনার বাসার গৃহকর্মী জানাল তার সন্তান অসুস্থ, আপনার গাড়িচালক জানাল গ্রামের বাড়িতে তার মা অসুস্থ- শয্যাশায়ী। আপনার অফিসের পিয়ন (অফিস সহায়ক) গুরুতর অসুস্থ, উন্নত চিকিৎসার জন্য তার আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন কিংবা কারও সন্তানের শিক্ষা ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। আপনার বাড়ির পরিচ্ছন্নতাকর্মীর খোঁজ নিন। খোঁজ নিন নিরাপত্তাকর্মীদের, প্রতিদিন সকালে যে ছেলেটি পত্রিকা দিয়ে যেত তার খোঁজ নিন। সহায়তার হাত প্রসারিত করুন।
লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা।Email : [email protected]