বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে এ বছর পবিত্র হজ ও ওমরাহ কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত। জিলহজের ৯-১৩ তারিখ হচ্ছে পবিত্র হজের নির্দিষ্ট সময়। এ সময়ের বাইরে হজ আদায় করা যায় না। ওমরাহর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। শুধু হজের দিনগুলো ছাড়া বছরের বাকি সময়ে ওমরাহ আদায় করা যায়। বিশেষ করে রমজানে ওমরাহর ফজিলত বেশি। তার পরও বিশ্বের মুমিন মুসলিম হজের জন্য বায়তুল্লায় আগে আগে গেলে হজের আগে ওমরাহ করে নেন। আবার অনেকে হজ ও ওমরাহর ইহরাম একসঙ্গে বেঁধে উল্লিখিত সময়ের আগেই ওমরাহ আদায় করেন এবং সে ইহরাম দিয়ে পবিত্র হজও সম্পাদন করেন। এখানে মানবজীবনে ওমরাহর গুরুত্ব ও নিয়ম তুলে ধরা হলো। এ বিষয়গুলো আমাদের সবার জানা একান্ত প্রয়োজন।
ওমরাহর ফজিলত : মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে হজ ও ওমরাহ পরিপূর্ণভাবে পালন কর।’ সুরা বাকারা, আয়াত ১৯৬। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সব গুনাহের কাফফারা। আর মাবরুর হজের প্রতিদান হলো জান্নাত।’ বুখারি, মুসলিম। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘তোমরা বারবার হজ ও ওমরাহ আদায় কর, কেননা এ দুটো দরিদ্রতা ও গুনাহকে সেভাবে মুছে ফেলে, যেভাবে কর্মকারের হাওয়া দেওয়ার যন্ত্র লোহার ময়লাকে দূর করে থাকে।’ নাসায়ি)।
ইহরাম বাঁধা ফরজ : পুরুষরা ইহরামের জন্য প্রস্তুতকৃত সাদা দুটি চাদর ও মহিলারা তাদের সাধারণ পোশাক পরে মিকাত ছেড়ে যাওয়ার সময় নিয়তের সঙ্গে বলবেন, ‘লাব্বাইকা ওমরাতান’ বা ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা ওমরাতান’। ওমরাহ যদি অন্যের পক্ষ থেকে হয় তবে অন্তরের নিয়তের সঙ্গে ‘লাব্বাইকা ওমরাতান আন’-এর পর তার নাম উচ্চারণ করতে হবে। পবিত্র কাবাঘর দেখার আগ পর্যন্ত তালবিয়া ও অন্য সব ধরনের দোয়া পড়তে হবে। তালবিয়া হলো, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইননাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাক’।ইহরামের নিয়ত করার পর যা নিষিদ্ধ : ১. পুরুষের জন্য সেলাই করা পোশাক পরা। ২. মাথার সঙ্গে লেগে থাকে এমন জিনিস দ্বারা মাথা ঢাকা। ৩. ইচ্ছাকৃতভাবে মাথার চুল ও শরীরের পশম কাটা বা ওঠানো। ৪. হাত-পায়ের নখ কাটা। ৫. আতর বা সুগন্ধি জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা। ৬. স্থলচর প্রাণী শিকার। ৭. স্বামী-স্ত্রী মিলন বা এ-জাতীয় বিষয়ে আলাপ-আলোচনা। ৮. বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া বা বিয়েতে আবদ্ধ হওয়া। ৯. মহিলাদের জন্য হাতমোজা ব্যবহার, মুখ ঢাকা। ১০. মক্কা ও মদিনার হারাম সীমানার গাছগাছালি কাটা, ভাঙা, ওপড়ানো (সর্বাবস্থায়)। ১১. মক্কা ও মদিনার হারাম সীমানায় পড়ে থাকা জিনিস নেওয়া। তবে তা মালিককে দেওয়ার জন্য ওঠানো যাবে। মুকাম্মাল মুদাল্লাল হজ ও উমরাহ, ১২০ পৃষ্ঠা।
মক্কায় পৌঁছার পর করণীয় : ১. তাওয়াফ ফরজ : মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফে যাওয়ার আগে অজু করে নিতে হবে। কেননা তাওয়াফের জন্য অজু শর্ত। নামাজের সময় নিকটবর্তী না হলে মসজিদে প্রবেশ করে সরাসরি তাওয়াফে যেতে হবে। তাওয়াফ শুরুর আগে পুরুষের জন্য ইজতিবা বা ডান কাঁধ খালি করতে হবে, অর্থাৎ চাদরের মধ্যভাগ ডান কাঁধের নিচে দিয়ে নিয়ে বাঁ কাঁধের ওপর ধারণ করতে হবে। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে হাজরে আসওয়াদ চুমো বা স্পর্শ করার মাধ্যমে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। চুমো বা স্পর্শ করার সুযোগ না হলে হাজরে আসওয়াদ বরাবর গিয়ে শুধু ডান হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদের দিকে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ইশারায় হাতে চুমো দিয়ে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। হাজরে আসওয়াদের আগের কোনো রুকনে ইয়ামানিতে পৌঁছা পর্যন্ত কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ ও যে কোনো ধরনের দোয়া পড়া যায়। হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করে আবার হাজরে আসওয়াদে এলে এক তাওয়াফ হয়। এভাবে সাত তাওয়াফ বা চক্কর শেষ করে উভয় কাঁধ ঢেকে, মাকামে ইবরাহিমের পেছনে নামাজ পড়ার উপযুক্ত স্থান পেলে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হবে। ভিড়ের কারণে সম্ভব না হলে কাবা শরিফের যে কোনো স্থানে পড়লেই চলবে। মাসায়েলে হজ ও উমরাহ, ১২০ পৃষ্ঠা।
২. সায়ি ওয়াজিব : এখন সায়ি করার জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ে যেতে হবে। শুধু সাফায় আরোহণের সময় এ আয়াত ‘ইন্নাস সাফা আল মারওয়াতা মিন শায়া-ইরিল্লাহ’ পড়তে হবে। পাহাড়ে আরোহণ করে কেবলামুখী হয়ে দোয়ার জন্য দুই হাত উঠিয়ে তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ বলে এ দোয়াটি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা শারিকালাহ, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, আনজাজা ওয়াদাহু, ওয়া নাসারা আবদাহু, ওয়া হাজামাল আহজাবা ওয়াহ্দাহু- তিনবার এ দোয়াটি ও মধ্যখানে অন্যান্য দোয়া পড়তে হবে। এরপর মারওয়ার দিকে যেতে হবে। কিছুদূর গেলে দুটি সবুজ চিহ্ন পাওয়া যাবে। দুই চিহ্নের মাঝে শুধু পুরুষদের হালকা দৌড়াতে হবে। সাফা-মারওয়ায় চলতে কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ, তসবি ও যে কোনো ধরনের দোয়া পড়া যায়। শরহে বোকায়া, হজ অধ্যায়, আসান ফিকাহ, দ্বিতীয় খ-, ১৮২ ও ১৮৩ পৃষ্ঠা। ৩. মাথার চুল খাটো বা মু-ন করা ওয়াজিব : সাফা-মারওয়ায় সায়ি শেষে মাথার চুল চার ভাগের এক ভাগ ছোট বা মু-ন করা উভয়টিই বৈধ। তবে মু-ন করাই উত্তম। কেননা মু-নকারীর জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার দোয়া করেছেন। আর মহিলারা মাথার সব চুল আঙ্গুলের এক গিরা পরিমাণ ছোট করবেন। এখন আপনার ওমরাহ হয়ে গেল। আসান ফিকাহ, দ্বিতীয় খ-, ১৮৭ পৃষ্ঠা।
লেখক : খতিব, মণিপুর বাইতুল আশরাফ (মাইকওয়ালা) জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।