বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর ছায়ায়ই জাসদ নেতাদের বীরত্ব বাকিটা ব্যর্থতার

পীর হাবিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুর ছায়ায়ই জাসদ নেতাদের বীরত্ব বাকিটা ব্যর্থতার

১. করোনার ভয়াবহতা মুক্ত হয়নি পৃথিবী, প্রিয় স্বদেশ। অক্সফোর্ডের সারাহ গিলবার্টের ভ্যাকসিন আবিষ্কার বড় আশার আলো। আরও দেশ বলছে আশার কথা। বাজারে আসার আগেই কত প্রাণ ঝরে পড়ছে। কত মানুষ কাজ হারাচ্ছে। অর্থনীতি দেশে দেশে কত ভয়ঙ্কর রকম হোঁচট খাচ্ছে! আমাদের আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, তিন দফা অতিবৃষ্টি পাহাড়ি ঢলে বন্যায় দুর্ভোগে মানুষ। শেখ হাসিনা খাদ্য ত্রাণ অর্থ সাহায্যের উদার হাত মানুষের দুয়ারে বাড়িয়েছেন।

সামাজিকভাবে এখনো বিচ্ছিন্ন আছি। আগের মতো খবরাখবরও পাই না। দেশের চলমান অনেক ঘটনাবলির আগামাথাও বুঝি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কী যেন বলতে চায়, হিসাব মেলে না। বেশি ভাবলে চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়, ঘুমের ওলটপালট ঘটে। একজন প্রাণবন্ত এমপি নওগাঁর ইসরাফিল আলমও করোনায় হেরে চলে গেলেন। বড় অমায়িক নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। বেঁচে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রিয় অগ্রজ আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর পিতা মুক্তিযোদ্ধা সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সর্বশেষ বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেলেন। যাওয়া হলো না শেষ বিদায়ে। কানে বাজে অচেতন অবস্থায় মৃত্যুশয্যায় বলছিলেন, ‘তোমার আমার ঠিকানা বঙ্গবন্ধুর জমানা’। এরাই তো বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। আল্লাহভীরু পরহেজগার মানুষটিকে দয়াময় বেহেশত নসিব করুন। অবসরে যাওয়া আইন সচিব সৎ দক্ষ কর্মকর্তা আবু সালেহ শেখ জহিরুল হক করোনায় জীবন-মৃত্যুর মুখে। ’৭৫-উত্তর দুঃসময়ে রাকসুজয়ী ছাত্রলীগ নেতা আমাদের প্রিয় দুলাল ভাই সরল স্নেহপ্রবণ গণমুখী ছিলেন। আল্লাহ তাকে হেফাজত করুন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে শূন্য আসনেও নাকি শকুনদের চোখ পড়েছে। আহারে রাজনীতিদরা।

এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নকল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাকে অব্যাহতিও দিয়েছেন। এর আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলামের লাইসেন্সে তার এক বন্ধু মাস্ক সরবরাহ করে একই অভিযোগে আটক হন। আমিনও মামলা খেয়েছেন। আমিনের লাইসেন্সে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টাকার সরবরাহ কাজ, শারমিনকে ১৯ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়। কেউই নাকি বিল তোলেননি। এ ছাড়া ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শিশিরকেও নাকি উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমলা সচিবদের দাপুটে শাসনামলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার আশ্রয়ে আসা সুবিধাভোগীদের রমরমা বাণিজ্য, দম্ভ লুটপাটে, আওয়ামী লীগের এক দশকে একসময়ের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের অভিমান জমতে জমতে এখন মন পুড়ছে। এ তিন ঘটনায় বাণী ইয়াসমীন হাসি ও শামীমা দোলাসহ ছাত্রলীগ করে আসা সংবাদকর্মী ও দলের পদবিহীন নেতা-কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন। তাদের প্রশ্ন বড় বড় দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের না ধরে, সামান্য ক’ টাকার কাজ পাওয়া দলের দুর্দিনের ত্যাগী কর্মীদের বেইজ্জত করার নেপথ্যে দুরভিসন্ধি আছে। জেএমআইকের রাজ্জাক সবার আগে সবচেয়ে বড় মাস্ক কেলেঙ্কারি করেও কীভাবে দাপটে হেঁটে বেড়ান? কেন দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেরাদের ধরা হয় না? কর্মচারী আবজাল বউসহ দেড় হাজার কোটি টাকা লুটে বিদেশ চলে যান? মাফিয়া ডন মিঠুকে কেন ধরতে আইনের হাত ছোট ও দুর্বল? রূপপুরের বালিশ কেলেঙ্কারির দুর্নীতিবাজ কীভাবে পাবনায় এত বড় কাজ পায়? আইন কেন পাকড়াও করে না? আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে পদবি পাওয়া নেতারা হঠাৎ এক দশকে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েও কেন আইনের ঊর্ধ্বে? মন্ত্রী, এমপি ও জাঁদরেল সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অনুপ্রবেশকারীরা কীভাবে বেশুমার লোটে? হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ পাওয়া জি কে শামীমদের নেপথ্য শক্তি কেন আসে না আইনের কাঠগড়ায়? যারা শেয়ারবাজার লুটেছে, ব্যাংক ডাকাতি করেছে, খেলাপি ঋণের পরও বিলাসী জীবনে দেশ-বিদেশে সম্পদ গড়েছে, নানা খাতে যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা সেখানে আইনের হাত লম্বা হয় না কেন? কীভাবে দুর্নীতিবাজরা জামিন পায়, নয় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে? এসব প্রশ্নের যুক্তি তো অনেক শক্ত! কী জবাব আছে। একজন অপরাধীর প্রশ্রয় কত অপরাধীর জন্ম দেয়? অপরাধীদের পক্ষে কারা তদবির করে বেড়ায়?

বিগত বছরের সেপ্টেম্বরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যের ধূর্ত শিয়াল লোকমানও আটক হয়েছিল। গোটা দেশ জেনেছিল সেই সংবাদ। মোহামেমেডান ক্লাবের পরিচালক ইনচার্জ লোকমান বললে সবাই যত চেনেন, তার চেয়ে বেশি চেনেন মোসাদ্দেক আলী ফালুর একসময়ের বিশ্বস্তজন হিসেবে। আরও বেশি চেনেন তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দেহরক্ষী হিসেবে। তিনি ২০০১ সালে বিএনপি জোট বিজয়ী হলে সংসদে সংসদ নেতার অফিসকক্ষে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাঙচুর করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের রক্তে আসা ক্ষমতায় লোকমানদের কারা এত প্রতাপশালী করেছে? কারা বিসিবির পরিচালক করেছিল? কেবল তাকেই নয়, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর বজলুল হুদার শ্যালক হানিফ ভূইয়াকেও কারা বিসিবির পরিচালক করে? সেপ্টেম্বরের সেই অভিযানে ক্যাসিনো বাণিজ্যের অপরাধে কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ফিরোজসহ অনেকে গ্রেফতার হন। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকেও ঝড় তুলে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় খবর হয় সম্রাট দুঃসময়ের আওয়ামী লীগের রাজপথের কর্মী ও তার আয় নিজের ক্যাসিনো খেলা বাদে দলের কর্মীদের পেছনেই ঢালতেন। দলের কর্মসূচিতেও চাঁদা দিতেন, ব্যাপক কর্মীদের আনতেন এবং নির্বাচনসহ নানা সময়ে অনেক প্রার্থী ও নেতাকে অনুদান দিয়েছেন। ক্যাসিনো বাণিজ্য ঘিরে যুবলীগ নেতৃত্ব ঝড়ের মুখে উড়ে যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতারাও পদবি হারিয়ে বিদায় নেন। এত মাস হয়ে গেল ঢাকা নগরীতে কাদের পৃষ্ঠপোষকতায়, কাদের শক্তিতে কাদের ভাগবাটোয়ারার লোভে এমন অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য রমরমা ছিল জানা গেল না! তদন্ত এত দিন কী হলো তবে! বিস্ময়কর বিষয় যে ক্যাসিনো বাজিকর সেই মোহামেডান ক্লাবের শিরোমণি রাতের জুয়ার কারবারি লোকমান ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হয়ে অদ্ভুতভাবে আদালতের জামিনে এ বছর ১৯ মার্চ জেল থেকে মুক্ত হয়ে বুকভরে শ্বাস নিচ্ছেন! অথচ কোটি কোটি টাকার জুয়ার আয়ই নয়, বিদেশেও অর্থ পাচারের খবর বের হয়েছিল। আর কলাবাগানের ফিরোজ সেই ভাগ্যবান যিনি ২২ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হয়ে এ বছর ১ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্ত হন। বাকিদের খবর জানি না। তবে যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও জেলবন্দী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই তার শারীরিক অবনতির খবর পাওয়া যায়। লোকমানরা কেন জেলের বাইরে আর সম্রাটরা কেন ভিতরে এর কোনো যুক্তি মাথায় আসে না। আমরা তো সব অপরাধীর বিচার চেয়েছি, জেনেছি আইনের চোখে সবাই সমান। তাহলে? কোনো অপরাধেই আড়ালের কাউকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দেখলাম না! উল্টো এক দশকে নব্য আওয়ামী লীগারদের রমরমা ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগের দাম্ভিক চেহারা দেখেছি। আমরা চাই ছোট-বড় সব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক। যত খুচরা কাচকি আর মলা মাছ ধরা হয়, রাঘববোয়াল বা রুই-কাতলা একটাও জালে ধরা পড়ে না। ধরতে কোথায় যেন বড় অনীহা! এমনকি এক দশকে দল ও ক্ষমতায় আশ্রিত নব্য আওয়ামী লীগার ছাড়াও অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড বা কাউয়াদেরও তাড়ানোর বা তালিকাবদ্ধ করার উদ্যোগ নেই। জনগণের দল আওয়ামী লীগ ও জনগণের নেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতার উৎস হবে আদর্শিক কমিটেড নেতা-কর্মী ও জনগণ, কখনই আমলা বা হঠাৎ আসা নব্য আওয়ামী লীগার নয়। নয়া মুসলমান যেমন গরু খায় বেশি তেমনি নয়া আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ ও নেত্রী বন্দনা করে। এরাই সর্বনাশা চাটার দল। করোনাকালেও যারা দুর্নীতির মহোৎসবে ভাসে, তারা দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। এদের প্রতি স্বজনপ্রীতি বা এদের রক্ষা করার তৎপরতা যারা করে তারা বেনিফিশিয়ারি অপরাধী। লোভের বিষে বিষাক্ত সব অপরাধী দুর্নীতিবাজ লুটেরা, বড় ছোট সবার জন্যই আইনের কার্যকারিতা সমান করে আজ বিচার ও শাস্তিদান মানুষের দাবি। আইনের গতিকে স্বাভাবিক ধারায় চলতে হবে। দুদক বা আদালতে, পুলিশি তদন্তে কারও হস্তক্ষেপ আরেক ধরনের বেইমানি। ইমানের সঙ্গে ন্যায়বিচারের পাহারাদার হওয়ার সময় এখন সবার।

করোনাকালেও নকল টেস্ট রিপোর্ট, নকল মাস্ক, নকল ডাক্তার, নকল ওষুধ, অবৈধ হাসপাতাল কত কিছু ধরা পড়ছে! অবাক কা- ফাইভ পাস, সিক্স পাস নিউরোলজির ডাক্তার ধরা পড়ে! সাহেদ-সাবরিনাদের টেস্ট জালিয়াতি বিশ্বে মাথা নিচু করেছে। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের কন্যা জাল টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে আটক হন বিদেশ যাওয়ার সময়! কতটা লজ্জার বিষয়। কত হাসপাতাল চলছে অনুমতি ছাড়া! নিয়ম-নীতিহীন। স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতিগ্রস্ত দেউলিয়া ব্যর্থ অতি পুরনো কথা। এসব বিশ্বাসঘাতক কীভাবে এমন সর্বনাশ করেছে?

২. জাসদের একাংশের নেতা আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জে রতন গগনদের বাড়ি গিয়ে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শোনেন! সিরাজুল আলম খানসহ ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের সদস্য ছাড়া কোনো বাঙালি স্বাধীনতার কথা চিন্তাই করেননি! স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আ স ম রবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকলেও এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। সব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের প্রতি আমি সম্মান রাখলেও ইতিহাসের সন্তান ডাকসু ভিপি রব ভাইয়ের মুখে এমন কথা বেমানান। এতে আমি ব্যথিত এবং তাঁর ব্যাখ্যার সঙ্গে তোফায়েল আহমেদ ও নূরে আলম সিদ্দিকীর ব্যাখ্যা, মতামত চাইছি। স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের মৃত্যুতে স্মরণে রব এ কথা বলেন। পরাজিত হানাদার বাহিনীর দোসররা এমনটা বলেনি। পাকিস্তানের নথিপত্র, আন্তর্জাতিক দলিল-দস্তাবেজ, গণমাধ্যম, কোথাও যে মিথ্যা নেই সেখানে ইতিহাসের সন্তান আ স ম রব কীভাবে এমন বলেন! আ স ম রবকে বাদ দিয়ে তো স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হবে না, তাহলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কোথায় নির্মোহ সত্য বলে প্রশান্তির মৃত্যুবরণ করবেন, সেখানে তা নয় কেন এমন বক্তব্য? এমনটা স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখে তৃপ্তির হাসি তুলে দেয়।

শেখ মুজিবের গড়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে না এলে, বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য কর্মী না হলে, সেই সংগঠনের নেতৃত্বে ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে জায়গা না হলে কি মুজিব বাহিনীর চার নেতা বা স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতার নাম ইতিহাসে লেখা হতো? সাম্প্র্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রকে জন্ম থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেনে নিতে পারেননি বলেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে, আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়ে তার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম শুরু করেন। ’৬১ সালেই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ ফজলুল হক মণিকে দিয়ে বিদেশি দূতাবাসে স্বাধীন বাংলাদেশের লিফলেট প্রচার করান গোপনে। সিরাজুল আলম খান তখন তাঁদের কর্মী। ’৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর মানিক মিয়ার মধ্যস্থতায় ভারতীয় উপদূতাবাসের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে ভোররাত পর্যন্ত বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াইয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরুকে চিঠি দেন সমর্থন চেয়ে। সেই চিঠিতে স্বাধীনতার রূপরেখাও দেন। পরে ’৬৩ সালের শুরুতে আগরতলা যান ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে নেহেরুকে বিষয়টি বোঝাতে। নেহেরুও তাঁর বার্তা দেন। সে দীর্ঘ ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুও আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করে তাঁর লক্ষ্য অর্জনে নামেন, ছয় দফা দেন, জনগণকে তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব বা আগরতলা মামলার প্রধান আসামি হন। ৩৮ মাস জেল খেটে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মুক্ত হন, আইয়ুবেরও পতন হয়। তিনিই তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্নে, নেতৃত্বে, সংগ্রামে, দলকে শক্তিশালী করেন, ’৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে একক নেতায় পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুই আমাদের মহান স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনিই নেতা ও সফল মহানায়ক। স্বাধীন দেশের জাতির পিতা। ছাত্রলীগ ষাটের দশকে স্বাধিকার স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রলীগ বা ডাকসুর নেতৃত্বে থাকার সুবাদে অনেকে নায়ক হয়েছেন। কিন্তু রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লক্ষ্য ও নির্দেশ পালনে তাঁরা ছিলেন মাঠের সফল ছাত্রনেতা বা কর্মী। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা বা নির্দেশের বাইরে তাঁদের কিছুই করার ছিল না। নিউক্লিয়াস স্বীকৃত কিছু নয়, হলে তাঁদের নিজেদের কয়েকজনের চিন্তা। বঙ্গবন্ধু জানলেও চিন্তা করেছেন প্রচার করুক এ তো তাঁরই লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও ভারতে গিয়ে আশ্রয় এবং ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থন সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায়। মুজিবনগর সরকার, মুজিব বাহিনী সব। সেদিন সিরাজুল আলম খান থেকে আ স ম রবরা অনেক কিছুই যে জানতেন না এটাই তাঁরা জানেন না। পিতাই সন্তানকে জন্ম দেন, পথ দেখান, পিতার নির্দেশ-ইচ্ছাই বড় হয়ে সন্তান পূরণ করে। এখানেও হয়েছে তাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামকে নেহেরুর মৃত্যুর পর তাঁর ক্ষমতাসীন কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও তেজের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে লন্ডনের ভারতীয় হাইকমিশনের ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি যিনি নাথবাবু নামে পরিচিত তাঁর সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুকে যুক্ত করেন। ’৬৯-এ মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান, সেখানে নাথবাবুর সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের কথাও পাকা হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এক ব্যক্তি এক ভোটের নির্বাচন দিলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নেন। গণরায়ে বিজয়ীর বেশে একক নেতার আসনে উঠে আসেন। জানতেন ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না আর তাঁর চাই স্বাধীনতা, তবে হঠকারিতা নয়। তাই জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। তিনিই ইন্দিরাসহ সবার সঙ্গে আলাপ করে সব চূড়ান্ত করেন। চিত্তরঞ্জন সুতারের ঠিকানাই তো বঙ্গবন্ধু মার্চ একাত্তরে জানান মুজিব বাহিনীর চার নেতাকে, যা তাঁরা আগে কেউ জানতেন না। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনই জনগণের ঐক্যে স্বাধীনতার সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধে টেনে নেয়। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীন দেশের নাম বাংলাদেশ, স্লোগান জয় বাংলা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা চূড়ান্ত করেন। এ নিয়ে ‘আমিই সিরাজুল আলম খান’ বইয়ের বর্ণনার অনেক অসত্য বয়ানকে তথ্য ও সন তারিখসহ তোফায়েল আহমেদ জবাবে অসার করে দিয়েছেন। আর দুনিয়াজুড়ে গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, আটক ও ঢাকার গণহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। মেজর জিয়া অনেকের মতো ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। দুপুর ২টায় ভুল করেছিলেন তাই সন্ধ্যা ৭টায় সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা পাঠ করেন। ২৬ মার্চ দুপুর ১২টায় করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। অথচ আ স ম রব ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জ বসে জিয়ার ঘোষণা শোনেন! তাজ্জব লাগে। যে ঘোষণা ফেনী পর্যন্ত শোনা যায়নি। সেটি তিনি শোনেন। অথচ মুজিব বাহিনীর চার নেতা ও স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে রবও ২৭ মার্চ কেরানীগঞ্জ যান। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানও ছিলেন। ৭ মার্চ সিরাজুল আলম খান ও তোফায়েল আহমেদ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘লিডার আজ স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে জনগণ মানবে না’। বঙ্গবন্ধু এক ঝটকায় তাঁদের কাঁধে রাখা হাত সরিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জনগণের নির্বাচিত নেতা, তাদের আমি নেতৃত্ব দেব, তারা নয়।’ তোমরা কাজে যাও বলে তিনি ওপরে যান। ৭ মার্চের ভাষণে গোটা জাতিকে স্বাধীনতার ডাকে যেমন এক মোহনায় আনেন তেমনি শর্ত দিয়ে পাকিস্তানি সেনবাহিনীকেও আটকে দেন। সেদিন সিরাজুল আলমের কথা শুনলে বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী হতেন আর ঢাকায় বোমা হামলায় পাকিস্তানি শাসকরা রক্তগঙ্গা বইয়ে দিত। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে সারা দেশে প্রতিরোধের দুর্গ গড়েছিল সামরিক-বেসামরিক বীর জনতা।

সিরাজুল আলম খানের বই নিয়ে তোফায়েল আহমেদদের জবাবের পর আনোয়ার হোসেন মঞ্জুুর বাসভবনে গভীর রাতের আড্ডায় আমি সিরাজুল আলম খানের অনেক কথার জবাবে বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুই আপনাদের জন্ম দিয়েছিলেন, আপনারা বঙ্গবন্ধুর সফল কর্মী ও সংগঠক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সফল না হলে আপনাদের রাজনীতির ইতিহাসে জন্মই হতো না। স্বাধীনতা আপনারা নয়, বঙ্গবন্ধুই দেখেন আর সেই সংগ্রামে কাজে লাগান সবাইকে। এতে তিনি বিরক্ত হন।

একাত্তরের টাইগার সিদ্দিকী খ্যাত কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান ও ’৭৫-এর প্রতিরোধযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম শাজাহান সিরাজকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত মুজিব বাহিনীর চার প্রধান ও স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতার কথা না লিখে স্বাধীনতার ইতিহাস হয় না। স্বাধীনতার পর মত-পথের অমিল ঘটলেও আমিও একমত। শাজাহান সিরাজও বলেছিলেন একবার, ভুল আমরা সবাই করেছি। তিনি নিজ উদ্যোগে সমাবেশ করে অকপটে স্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার মহানায়ক। ভুল সবাই করে। এটাও সত্য কারও পাল্লা ভারী কারও হালকা। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে জাসদ সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধে উঠে আসা আদর্শিক তারুণ্যের সর্বনাশই করা হয়নি, জাতীয়তাবাদী দেশপ্রমিক শক্তিকেই দুর্বল করা হয়নি, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অশান্তই করা হয়নি, দেশের সর্বনাশটাও ঘটানো হয়েছে। জাসদের ব্যর্থ নেতা মেজর জলিল মৌলবাদী হয়ে মরেছেন। সিরাজুল আলম খান পৃথিবীর এক নিঃস্ব ভাসমান মানুষ। শাজাহান সিরাজ বিএনপি-জামায়াত সরকারের মন্ত্রী হয়ে ক্যান্সারে নিঃসঙ্গতায় ভুগে মরেছেন।

প্রিয় রব ভাই আপনি এখন কোথায় কেমন আছেন? দুর্বল জাসদের আদর্শের বাতি জ্বালিয়ে পথ হাঁটছেন হাসানুল হক ইনু। আমি তাঁর পথেরও সমর্থক নই, তবে মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে চলাটা সমর্থন করি। কিন্তু আজ প্রায় ৫০ বছর পরও দেখি সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব ও শাজাহান সিরাজের বীরত্ব ও গৌরবের ইতিহাস তো বঙ্গবন্ধুর পাদপ্রদীপেই লেখা। তাঁর ছায়া থেকে সরে গিয়ে সাফল্য কই? কেবল ভ্রান্ত নীতি, উগ্র হঠকারিতা, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক পথে ব্যর্থতা লজ্জা ও গ্লানির। মাঝখানে ভ্রান্ত নেতৃত্বের পেছনে গিয়ে কত আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর করুণ পরিণতি তো দেশ ও রাজনীতিরই ক্ষতি করেছে। সব ভাঙনই সর্বনাশা, যেমন পদ্মার তেমন রাজনৈতিক দলের। মানুষের কল্যাণ কখনো আনে না। জাসদের চড়া ভুলের মাশুলের মাঝেও অন্তত নিজেদের গৌরব তো সেই জাতির পিতার ছায়ায় থাকা বীরত্বের সময়টাই দিতে পারে, তাই না?

               

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর