বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ

তসলিমা নাসরিন

কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ

১. সুশান্ত সিং রাজপুতকে নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। ওঁকে কেউ হত্যা করেছে, নাকি নিজেই ফাঁসিতে ঝুলেছেন, যদি এ আত্মহত্যাই হয় তবে কারণ কী তার, স্বজনপোষণ নাকি অন্য কিছু? পুলিশ কোনও খুনের আলামত পাচ্ছে না, কিন্তু বিতর্ক থামছে না। হোমরা-চোমরাদের জিজ্ঞাসাবাদে নিচ্ছে পুলিশ।

জিয়া খান তো আত্মহত্যা করেছিলেন, কই তাঁর ওই আত্মহত্যা আসলেই আত্মহত্যা কিনা, নাকি কেউ তাকে হত্যা করেছিল, এ নিয়ে কোনও তোলপাড় তো হয়নি। দিব্যা ভারতিকে কি হত্যা করা হয়েছিল নাকি তিনি পাঁচ তলার জানালা দিয়ে নিজেই লাফ দিয়েছিলেন মরবেন বলে, আজও কিন্তু এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনও উত্তর মেলেনি। সবচেয়ে অবাক হই, শ্রীদেবীর মতো বিখ্যাত অভিনেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়েও কোনও সংশয় প্রকাশ করেনি বড় কোনও মিডিয়া বা সংগঠন, বা নামি দামি কেউ অথবা বলিউডের কেউ। আগের দিন নাচলেন মানুষটা। পরের দিন বাথটাবের জলে ডুবে মরে গেলেন!! ঘরে একজন উপস্থিত ছিলেন সে সময়। ডেথ সার্টিফিকেটও আনাড়ি হাতে লেখা ছিল। এ নিয়ে কাউকে জেরা করা হয়নি। বিদেশের মাটিতে মারা গেলেই কি জবাবদিহি করতে হয় না, আর সাতখুন মাফ হয়ে যায়?

পুরুষেরা আত্মহত্যা করলে সহজে বিশ্বাস করা হয় না এ আত্মহত্যা, মেয়েরা আত্মহত্যা করলে এ আত্মহত্যা বলেই মানুষ চটজলদি বিশ্বাস করে ফেলে। কারণ তো ওই একই, মেয়েদের হৃদয় এত কোমল, তাদের এত আবেগ, তারা পারে না বাস্তবতার মুখোমুখি হতে।

কত মেয়েকেই তো হত্যা করা হয়, কত মেয়েকেই তো আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে সমাজ। এসব নিয়ে কি সত্যিই তোলপাড় হয়? হয়তো মেয়েদের জীবনকে মূল্যহীন ভাবা হয় বলে তাদের মৃত্যুকেও মূল্যহীন ভাবা হয়। সাধারণ মেয়েদের অপঘাতে মৃত্যু হলে কেউ পরোয়া করে না, অসাধারণ মেয়েদের বেলায় অনেকটা তাই। কিছু কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে।

আজ টুইটারে আমি এ প্রশ্নটি করেছিলাম, সুশান্তর বেলায় প্রশ্ন উঠছে হত্যা না আত্মহত্যা, শ্রীদেবীর বেলায় কেন প্রশ্ন ওঠেনি হত্যা না ড্রাউনিং? একজন বললেন, ‘বয়সটা ম্যাটার করছে। শ্রীদেবীর বয়স বেশি, কেরিয়ারের শেষ। সুশান্তের অল্প বয়স, কেরিয়ারের শুরু।’ তাই বুঝি? জিয়া খানের বয়স তো সুশান্তের চেয়েও কম ছিল, তাতে কী হয়েছে!

শ্রীদেবীর বয়স বেশি বলে তেমন কোনও তরঙ্গ সৃষ্টি হয়নি! অমিতাভের তো বয়স শ্রীদেবীর চেয়েও বেশি। আজ তিনি গত হলে মানুষ হাউমাউ করে কাঁদবে না? শুধু কি কাঁদবেই! সুশান্তর জন্য কত ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে ফেললো, অমিতাভের জন্য হয়তো আরও বেশি করবে।

২. সংযুক্ত আরব আমিরাত বলে দিয়েছে জনগণ যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রিয়জনকে ঈদের উপহার দেওয়া থেকে বিরত থাকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেখা-সাক্ষাতের পরিবর্তে সামাজিক মাধ্যম, ই-মেইল ও টেলিফোনে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে বলা হয়েছে। আত্মীয় ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করা যদি অতি জরুরি হয়, তাহলে সাক্ষাতের সময় সামাজিক দূরত্ব যেন অবশ্যই বজায় থাকে। গৃহকর্মীদের বলা হয়েছে বাইরের কারও সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ না করে এবং কিছু জরুরি জিনিস যদি তাদের গ্রহণ করতেই হয়, যেন পিপিই পরে গ্রহণ করে। আরব আমিরাতে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ৩৪৫ জন। কিন্তু আরব দেশ হয়েও ঈদের মতো মূল ধর্মীয় উৎসবের অনেকটাই বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে। বড় জমায়েত বন্ধ রাখতে হবে। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যরে আলিঙ্গনই তো ঈদের মূল আনন্দ, সেই আলিঙ্গনও করা চলবে না। করোনার কামড় থেকে বাঁচতে হলে এই পথই অনুসরণ করতে হবে। আরব আমিরাতের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত সকলেরই গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে এক এক করে অনেকেরই তো মৃত্যু হচ্ছে করোনায়। ঘরেই স্বজনদের সঙ্গে ভালো মন্দ খাওয়া... এটুকুতেই ঈদের উৎসবকে সীমিত রাখা উচিত। মহামারীর সময় বড় বড় গরু জবাই করে খানাপিনার উৎসব করলে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের করোনার করুণ মৃত্যুকে মোটেও পরোয়া করা হয় না। আমরা কি শোকের সময় আনন্দ করি? বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে তো চুলোই নাকি ধরাতে হয় না। বাড়িতে বাড়িতে তো মৃত্যু হচ্ছেই, আমাদের গোটা গ্রহই তো আমাদের বাড়ি। এই গ্রহে গত কয়েক মাস যাবৎ আনন্দ তো নেই। ঈদের পর যদি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে মুসলিমদের নির্বুদ্ধিতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবী আবারও চিৎকার করবে।

লোকে যত চিৎকারই করুক, এ কথা সত্য যে আরব দেশে মানুষ ক্রমশ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে, এ নিশ্চয়ই খুব ভালো লক্ষণ। কিছুদিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত মঙ্গলগ্রহে যান পাঠালো। কে বলেছে মহাশূন্যে শুধু ইউরোপ আমেরিকাই যান পাঠাবে, আর আরব দেশগুলো পড়ে থাকবে মাটিতে, ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে! যত বেশি অন্ধকার কাটিয়ে আলোয় আসবে মানুষ, তত স্পষ্ট হবে তারা, তাদের বুদ্ধিদীপ্ত অবয়ব।

৩. সাদ্দাম হোসেনকে খুন করে ইরাককে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিল আমেরিকা। গণতন্ত্রের পথেই নাকি ইরাকে সুখ শান্তি ফিরে আসবে। কোথায়, অনেক বছর তো হয়ে গেল! গণতন্ত্রের সব শাসকই তো জনতাকে শোষণ করছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, সন্ত্রাস, হত্যাকা- এসব ঢেলে দেশটাকে কি হাল করেছে, দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। সাদ্দামের অত্যাচারে অনেকে অতিষ্ঠ ছিল তা ঠিক, কিন্তু সাদ্দামকে সরিয়ে যারা এলো, তাদের অত্যাচারেও তো জনগণ অতিষ্ঠ। তেল উৎপাদন করে দেশ, অথচ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও বিদ্যুতের অভাবে মানুষকে ভুগতে হয়। মুসলমানের দেশে দুর্নীতি কেন ঘটে? মানুষ যদি ধর্ম পালন করেই, তাহলে দুর্নীতি কেন করে? ধর্ম তো লোভ, লালসা, অন্যকে ঠকানো, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার বিপক্ষে বলেছে। তাহলে দুর্নীতিবাজরা যদি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও, তিরিশটা রোজা রেখেও দুর্নীতি বন্ধ না করে, তবে নামাজ-রোজার জন্য আদৌ কি পুণ্য হবে তাদের?

 

ইরাকের সরকারবিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে তিনজনকে মেরে ফেলেছে সরকারের পুলিশ বাহিনী। গত বছর মিছিলের ৫৫০ জনকে মেরে ফেলেছিল, আর ৩০,০০০ মানুষকে আহত করেছিল। প্রতিবাদ মিছিলে যে সরকার গুলি চালায়, সে সরকার কোনও গণতান্ত্রিক সরকার নয়। একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্র আসার কথা ছিল ইরাকে, আজও আসেনি। আদৌ কোনও দিন আসবে কিনা কে জানে।

৪. আরব দেশগুলো যেভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। অবৈধভাবে হজ পালনের চেষ্টা করায় হজ সিকিউরিটি ফোর্স ২৪৪ জনকে আটক করেছে। সৌদি প্রশাসন জানিয়েছে, অনুমতি না পাওয়ার পরেও তারা প্রটোকল ভেঙে হজ পালনের চেষ্টা করছিল। তাদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন আরও জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কড়া নিরাপত্তা বজায় রেখে সীমিত পরিসরে হজ পালন হচ্ছে। অনুমতি না থাকলে কেউ যেন এ বছর হজ পালনের চেষ্টা না করে। এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বড্ড কঠিন।

৫. চীন আর ভারত কি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে? আমি কোনও দিন কোনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি। কিন্তু আজ প্রকৃতির কাছে আমার প্রার্থনা... পৃথিবীতে যেন আর কোনও দিন এক দেশের সংগে আরেক দেশের যুদ্ধ না বাধে। এই করোনা মহামারীই কি বুঝিয়ে দেয়নি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছেও আমরা মানুষ কত অসহায়? মানুষ এখন সব এক হয়ে মিলে মিশে মানুষের সব শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, তা নয়, মানুষ মানুষকেই ঘৃণা করছে, মানুষকেই হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। এর চেয়ে বড় অকল্যাণ আর কী হতে পারে! পারমাণবিক বোমার দুটো দেশে যখন ঝগড়া বাধে, আমরা জনগণ তো এমনিতে অসহায়, আমরা আরও অসহায় হয়ে পড়ি।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর