করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে প্রথম দিকে লকডাউনসহ সব অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম-কানুন মেনে কিছু কিছু অফিস-আদালত, কলকারখানা সীমিত আকারে চলছে। এরই মধ্যে পাঁচ মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ আছে। তবে করোনাসৃষ্ট এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গত ৭ এপ্রিল থেকে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করে আসছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ প্রোগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এসব অনলাইন ক্লাস সরাসরি পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে হেল্পলাইনও (নম্বর-৩৩৩৬) খোলা হয়েছে। ওই হেল্পলাইনে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের পরামর্শ সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ ভালো মানের শিক্ষকদের কাছ থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত বিনা খরচে শ্রেণিপাঠ ও পরামর্শ নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি পাঠানোর কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা যার যার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার খোঁজ নেবেন। তবে ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞদের মতে সংসদ টিভিতে যে পাঠদান হচ্ছে তা সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ কারণে রেডিওতে ক্লাস সম্প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইউনেস্কোর অর্থায়নে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচারের প্রস্তুতি শেষের পথে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং এ-টু-আই (ধপপবংং ঃড় রহভড়ৎসধঃরড়হ) সমন্বয় করে রেডিওতে ক্লাস সম্প্রচারের বিষয়টি ২৬ জুলাই থেকে রেকর্ডিং করছে; যা বাংলাদেশ বেতারে প্রচার করা হবে। আশা করা যাচ্ছে কোরবানির ঈদের পরই এ কার্যক্রমের সুফল পেতে থাকবে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কোথাও কোথাও অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অনলাইনে এখন ক্লাস হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু থেকে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জুলাইয়ের শুরু থেকে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করে আসছে। সবকিছুর লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখা। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বিশ্বব্যাপী একটি অতি জনপ্রিয় মাধ্যম। উন্নত দেশগুলোয় অনেক আগে থেকেই এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। অনলাইনের কল্যাণে এক দেশে বসে অন্য দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে সংযুক্ত হওয়া, লেকচার শোনা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, সর্বোপরি ডিগ্রি অর্জন তেমন আর নতুন কিছু নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে শহরের বাইরে ও গ্রামগঞ্জে দ্রুতগতির ইন্টারনেট নেই। অনেকেরই নেই ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন কিংবা স্মার্ট ডিভাইস। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যাতে ঘরে বসেই সাশ্রয়ী মূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা পেতে পারে সেজন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। পক্ষান্তরে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘেœ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি ল্যাপটপ (ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম) কর্মসূচি চালুর কথা ভাবছে সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৪০ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। ফলে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ কোটি তরুণকে আইসিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে।
এদিকে আমাদের দেশে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় প্ল্যাটফরম হচ্ছে জুম, গুগোল মিট, গুগোল ক্লাসরুম ইত্যাদি। কিন্তু এর সবই উন্নত বিশ্বের তৈরি এবং এর ব্যবহারে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। ফ্রি ভার্সনও পাওয়া যায় কিন্তু ক্লাস পরিচালনার জন্য যথেষ্ট সময় পারমিট করে না। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ও কোনো প্রস্তুতি না থাকায় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে এ প্রোগ্রামগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও তাদের স্থান করে নিয়েছে। আমরাও অনেকটা বাধ্য হয়েই সকল পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি, বেসরকারি, করপোরেট, অফিস-আদালত, যে কোনো মিটিংসহ যাবতীয় কার্যক্রম আজকাল এ অনলাইন পদ্ধতিতে চালাচ্ছি। বলা চলে করোনার কারণে বিশ্বের সব ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক ধস নামলেও এ অনলাইন প্ল্যাটফরমের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন খুবই তুঙ্গে। তবে খুবই আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এ-টু-আইয়ের কারিগরি সহযোগিতায় সম্প্রতি অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার জন্য চমৎকার একটি প্ল্যাটফরম উন্মুক্ত করা হয়েছে যা বিদেশি ওই প্ল্যাটফরমের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় বরং অনেক বেশি সুবিধা আছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ বা ‘মুক্ত ক্লাস’। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্বাভাবিক নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম ও সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমে কার্যকর ও সহজ উপায়ে চলমান রাখতে এ প্ল্যাটফরম প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের লাইভ ক্লাস ও লাইভ ট্রেনিং সেশন পরিচালনা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের জন্য মুক্ত ক্লাস কনফারেন্সিং সফটওয়ারের পাশাপাশি জুম, গুগোল মিট, মাইক্রোসফট মিটস, ওয়েবেক্স ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মাল্টিমিডিয়া ও অডিও-ভিজুয়াল কনটেন্ট, ডকুমেন্ট (পিডিএফ, ওয়ারপয়েন্ট, গ্রাফ/ ডায়াগ্রাম ইত্যাদি) এবং বিভিন্ন ধরনের লিংক সংযুক্ত করার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষার্থীদের দৈনিক হাজিরা, টিউটোরিয়াল, কুইজ, হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট, ফাইনাল পরীক্ষা ইত্যাদি সুরক্ষিতভাবে ও সহজে করা যায়।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আলোচনা, প্রশ্নোত্তরের সুযোগ, সর্বোপরি ফলাফলের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও সংরক্ষণের সুযোগ আছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উপযোগী করেও এ প্ল্যাটফরমটিকে কাস্টমাইজ করার সুযোগ আছে।লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ অধ্যাপক ও পরিচালক আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।