শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

রঙ্গশালায় দেখি সুবিধাবাদীদের ফাঁদ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

রঙ্গশালায় দেখি সুবিধাবাদীদের ফাঁদ

মানুষ সবার মুখটা দেখতে পেলেও নিজের মুখটা দেখতে পায় না। বিস্ময়কর বিষয়। তার পরও এটাই চিরন্তন সত্য। তবে আয়নায় মানুষ নিজের মুখ দেখতে পায়। কিন্তু সেটা যে তার মুখ অন্যরা তার প্রমাণ দিলেও মানুষ তার আয়নার মুখটা যে তার মুখ তা নিজের চোখে দেখে প্রমাণ দিতে পারে না। মানুষ হয়তো অনেক বড়, কোথাও কোথাও খুব অসহায়, বিপন্ন। মানুষ নিজের মুখ নিজে দেখতে পায় না বলে আয়নায় দেখা মুখটাকে নিজের মুখ হিসেবে বিশ্বাস করে, সন্দেহ কী তাতে থাকে। সন্দেহ তো থেকেই যায়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের লড়াইয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত মন ও আবেগ। তার পরও বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। মানুষের মুখ কতটা তার নিজের, কতটা মুখোশ তা হয়তো হিসাবের অঙ্কে মেলানো কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। সম্ভবও হয়তো নয়। সময়ের ক্রমাগত পরিবর্তনে মানুষ নিজের ছবিকে আটকে রাখতে চাইল। মানুষের মুখের ছবি। যন্ত্রের ছবি কি মানুষের মুখ কখনো আঁকতে পেরেছে? মুখ হয়তো এঁকেছে, ভিতরের মনের ছবি কি আঁকা গেছে? মানুষ তো তার মুখ নিজে দেখতে পায়নি কখনো তবে যন্ত্রের ছবিটা কি সেই মানুষটার ছবি? নাকি অন্য কারও? মানুষের জীবনের কোনো একটা মুহূর্ত সময়ে আটকে ফেলার কৌশলটাই টেকনিক্যাল ভাষায় ফটোগ্রাফি।  Photos একটি গ্রিক শব্দ। যার অর্থ হলো Light এবং Graphos অর্থ Drawing মানে আঁকা, তাহলে Photography অর্থটা হচ্ছে আলো দিয়ে আঁকা। খুব সহজ বাংলায় যাকে ‘আলোকচিত্র’ বলে। সে আলোর মধ্যে এখন অন্ধকার ঢুকেছে। আলোকচিত্র কি তবে আঁধারচিত্র হবে? এ ছবিটা এখন ইতিহাসের সাক্ষী না হয়ে ব্যবসার ফাঁদ হয়েছে। পুরনো আমলের ছবিগুলো হাতড়ে দেখা যায়, সে সময় একা বা গ্রুপভিত্তিক ছবিগুলোর মানুষের মুখে হাসি ছিল না। কেমন একটা অনাড়ম্বর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব ছিল। উনবিংশ শতকের ছবিগুলোয় মানুষের মুখে হাসি না থাকার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সে সময় প্রযুক্তিগতভাবে ক্যামেরাগুলো খুব উন্নত ছিল না। এর ফলে ছবি তুলতে দীর্ঘ সময় লাগত। ইতিহাসে সর্বপ্রথম ক্যামেরায় ছবি তোলা হয় ১৮২৭ সালে। সে ক্যামেরার অ্যাপারচার সময় ছিল প্রায় আট ঘণ্টা, মানে ছবিটা ক্যামেরাবন্দী করতে আট ঘণ্টা লেগেছে। এ দীর্ঘ সময় মানুষের পক্ষে মুখে হাসি ধরে রাখাটা খুব কঠিন ও দুর্বোধ্য ছিল। অনেক সময় হাসি ধরে রাখতে গিয়ে ছবি নষ্ট হয়ে যেত। গোমরা মুখে ছবি তোলার এ বিষয়টির সঙ্গে সম্মতি প্রদান করেছেন জর্জ ইস্টম্যান জাদুঘরের প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক টড গুস্টাডসন। তিনি বলেন, ‘যদি ক্যামেরার অ্যাপারচার টাইম অনেক বেশি হয়, তাহলে আপনি ছবি তোলার ক্ষেত্রে এমন একটি সুবিধাজনক অঙ্গভঙ্গি বেছে নেবেন, যা আপনার জন্য কম কষ্টদায়ক হবে।’

এবার সেলফির বিষয়ে আসি। ইতিহাসটা ঘেঁটে নেওয়া যাক। ১৮৩৯ সাল। ফিলাডেলফিয়ার অ্যামেচার রসায়নবিদ তথা ফটোগ্রাফার রবার্ট কর্নেলিয়াস নিজের বাড়ির মুদি দোকানের পেছনে একটা ক্যামেরা বসিয়ে, তার ঢাকনা খুলে ছবি তোলার প্ল্যান করলেন। কিন্তু ছবি তোলার জন্য কাউকে পেলেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে ঢাকনা খুলেই ক্যামেরার সামনে স্থির হয়ে এক মিনিট পাথরের মতো তিনি থমকে বসে থাকলেন। তারপর লেন্স বন্ধ করে ছবি ডেভেলপ করে দেখলেন সেখান থেকে ছবি বেরিয়ে এসেছে। দাগেরোটাইপ সে ছবির পেছনে তিনি লিখলেন ‘The first light Picture ever taken, 1839.’ পৃথিবীর প্রথম সেলফি। এ দাগেরোটাইপ ছবির আবিষ্কার করেন ফরাসি দেশের জে এম দেগারে। এই প্রথম সেলফি।

আর এখন প্রতিদিন সেলফি আর সেলফি। সংখ্যায় কত, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রাচীনকালের গোমরা মুখে হাল আমলে হাসি ফুটেছে। যদিও এ হাসি কৃত্রিম। মুখটা হাসি হাসি থাকলেও ভিতরটা অস্থির, অস্বস্তিকর। আগে মানুষের ছবিতে মুখে হাসি না থাকলেও মনের ভিতরে হাসি ছিল। আনন্দ ছিল। এখন বাইরের মুখটায় হাসি আর মনের ভিতরে বিষণ্নতা, লোভ, আক্রোশ, প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা, স্বার্থপরতা।

ভাবা যায়, যে ছবি তোলা মানুষের স্মৃতিকে ধরে রাখা ছিল শুভ মাহেন্দ্রক্ষণকে আটকে রাখার অপরিহার্য অংশ সে ছবি তোলা এখন কারও কারও জন্য অর্থ ও ক্ষমতার কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা প্রতারণার ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সাদাকালো যুগের ছবি রঙিন যুগে প্রবেশ করে ছবি তোলাকে রঙ্গশালার রঙ্গলীলায় পরিবর্তিত করেছে। এ কৌশল কি একজন মানুষ করেছে নাকি অনেক মানুষ। নাকি সবাই। বিজ্ঞান বলছে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। বিজ্ঞানের এ তত্ত্ব এখানে কাজ করবে কিনা তা বলা হয়তো কঠিন কিংবা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে জেনে কিংবা না জেনে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষে এ কৌশলকে কেউ কেউ হয়তো সফল করতে ভূমিকা রেখেছেন। প্রতারক ও তথাকথিত ভ-রা ফাঁদ তৈরি করেছে আর কেউ কেউ এ ফাঁদে পা দিয়েছে। কেউ সরলভাবে, কেউ জটিলভাবে। কেউ নিরপেক্ষভাবে। এ ধরনের মানুষ কি অন্যরা তাদের প্রয়োজনে তৈরি করে? নাকি এরা নিজেদের প্রয়োজনে অন্যদের ব্যবহার করে তৈরি হয়?

খুব কঠিন প্রশ্ন। উত্তরটাও কঠিন। আবার সহজও। যে যেভাবে ভাবতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ভুঁইফোড় মানুষকে দেখছি। অনেকটা আগাছা-পরগাছা। দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, রং-রূপ-ঢং, ব্ল্যাকমেইল, টর্চার সেলসহ রাজা-মহারাজাদের মতো জলসাঘরে আসর বসিয়ে ক্ষমতা আর টাকাকে করায়ত্ত করার কৌশল বেছে নিয়েছে। এ জলসাঘর আধুনিক জলসাঘর কিন্তু প্রাচীনতা থেকে ধারণাটা খুব একটা ভিন্ন নয়। ঠগ! ঠিক ঠগ নয়, স্মার্ট ঠগ তৈরি হয়েছে আমাদের সমাজে। তার স্বরূপ ও ফল যে কতটা ভয়ানক আমরা বুঝতে পারছি হয়তো।

তার আগে ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা প্রতারক নটবরলালের কথা উল্লেখ করা দরকার। যিনি ভারতের সংসদের মতো ভবনকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রতারণা করে। বিখ্যাত লাল কেল্লা? তাও দুবার বিক্রি করেছেন। আর সর্বকালের সেরা তাজমহলকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনবার। ঠকিয়েছিলেন টাটা, বিড়লা, ধীরুভাই, আম্বানিদেরও। অদ্ভুত এক বিস্ময় নটবরলাল। বড় বড় গোয়েন্দা, অপরাধ বিশেষজ্ঞ তাকে নিয়ে ভেবেছেন, পুলিশরা তাকে পাকড়াও করেছেন। কিন্তু জেল ভেঙে পালিয়েছেন নটবরলাল। কানপুর আদালতে জজ একবার নটবরলালকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কীভাবে লোকদের ঠকাও।’ জজের কাছে এক টাকা চেয়েছিলেন তিনি। টাকা নিয়ে পকেটে পুরে নটবরলাল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি লোকেদের কাছে চাই, এভাবেই লোকেরা আমাকে দিয়ে দেয়। আমি কাউকে বন্দুক দেখিয়ে বা মারধর করে লুট করিনি। দেড় শ মামলার একটিতেও আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ বা আঘাত করার অভিযোগ নেই। আমি চেয়েছি ওরা দিয়েছে। ভারত সরকার চাইলে আমার বুদ্ধি ধার নিতে পারে। বিদেশিদের কাছে ভারতের ধার মিটিয়ে দেব আমি।’ বলা বাহুল্য, এক টাকা তিনি আর জজসাহেবকে ফেরত দেননি।

সেই অর্থে তিনি ভালো কি মন্দ তা সময় আর ইতিহাস বিচার করবে। আমাদের দেশে তার থেকেও বড় প্রতারকের জন্ম হয়েছে। এই বহুরূপী ঠগরা বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো তার তথাকথিত অফিস ও বাসায় খুব যতেœ ফ্রেমবন্দী করে ঝুলিয়ে রাখছে। এর মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছে, তাদের সঙ্গে রয়েছে প্রভাবশালী মহলের নিবিড় যোগাযোগ। খুব ভালো সম্পর্ক আছে। পুরোটাই হয়তো ঠকামি। কারণ যাদের সঙ্গে ছবিগুলো তুলছে তারা হয়তো এ বিষয়টা বুঝতেই পারেননি। এর অর্থ হচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হয়তো জানেনও না, তাদের ছবি বিক্রি করে ঠগরা ক্ষমতাধর ও দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠছে। তাদের নাম ভাঙিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছে। এখন ছবি তোলার ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। অন্য আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, তা হলো- একজন মানুষ যোগ্য কি অযোগ্য, সাধু কি শয়তান, ঠগ না সৎ তা লোকটার প্রকৃত গুণাবলি দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে না; বরং ব্রিফকেসের টাকার নোট দিয়ে মূল্যায়িত হচ্ছে। তার মানে, মানুষটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার টাকাটা। যার অবৈধ টাকা যত বেশি তার গ্রহণযোগ্যতা তত। এমন একটা অশুভ মনস্তত্ত্ব মানুষের মধ্যে কাজ করছে। এর ফলে আমরা প্রকৃত মেধাবী ও গুণীদের হারাচ্ছি আর অর্থশালী ভুঁইফোড় লোকদের প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণের দিকটি উপেক্ষা করছি। ধীরে ধীরে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এদের সঙ্গে টাকার অঙ্কে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠতে পারছেন না বলে পিছিয়ে পড়ছেন। এর জন্য রাজনীতিবিদরাও কম দায়ী নন।

সময় এসেছে এই সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করে তাদের সেলফির হাসিমুখ, পেছনের অদৃশ্য হাত, অদৃশ্যের ভিতরে অদৃশ্যের ঝাপসা শক্তিকে টেনে বের করে এনে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিশুদ্ধ করার। তবেই মুক্তি, না হলে বৃত্তের ভিতর বৃত্তের অদৃশ্য সমীকরণ সৃষ্টি হতেই থাকবে।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর