রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড-১৯ : ভবিষ্যৎ কৃষি ব্যবস্থাপনা

শাইখ সিরাজ

কভিড-১৯ : ভবিষ্যৎ কৃষি ব্যবস্থাপনা

স্বাধীনতা-পরবর্তী আশির দশকে আমি যখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানটির জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষকের কাছে গিয়েছি, দেখেছি কৃষকের দুর্দিন, দৈন্যদশা। সে সময়টাতে আমার মনে হয়েছে, কৃষককে তথ্য দিয়ে হয়তো আমি সহায়তা করতে পারব। আমার মনে আছে, আমি যখন গিয়ে বলেছি, আপনারা ইরির উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করেন। তারা বলেছেন, ওই ধানের ভাত রাবারের মতো, ওই ধান চাষ করব না। তারা গম চাষ করবেন না, কারণ রুটি তো পাকিস্তানের খাবার। কিংবা ভুট্টা চাষের কথা বললে বলতেন, ‘ওই জুলফিকার আলীর ভুট্টোর বেইল নাই।’ কিন্তু আমি ক্রমাগত বলে গেছি, নতুন নতুন তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, টেলিভিশনের একটা শক্তি আছে, যা সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে। মানুষ দ্রুত তা গ্রহণ করে। আপনাদের নিশ্চয়ই সুজা খন্দকার অভিনীত স্যালাইন বানানোর কৌশল নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রটির কথা মনে আছে, যেখানে বলা হয়েছিল, আধ লিটার ফুটানো পানিতে একমুঠো গুড় আর তিন আঙ্গুলে এক চিমটি লবণ দিয়ে দেন ঘুটা ঘুটা। সেই ‘ঘুটা ঘুটা’ মানুষের মগজে ঢুকে গিয়েছিল। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ ও এনজিওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাম্পেইনে যত মানুষ স্যালাইন বানানো শিখেছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ টেলিভিশনের এ তথ্যচিত্র দেখে স্যালাইন বানাতে শিখেছে। টেলিভিশনের ক্ষমতা নিয়ে এটা একটা উদাহরণের কথা বললাম। আমিও চিন্তা করেছি, টেলিভিশনকে ব্যবহার করে কীভাবে বাংলাদেশের কৃষিকে পাল্টে দেওয়া যায়। কৃষি মানেই ধান-পাট বা ফসল নয়। পৃথিবীর সব দেশেই কৃষিকে আলাদাভাবে চিন্তা করা হয় না, বলা হয় কৃষি, কৃষি বাণিজ্য ও পুষ্টি। এর ফলে কৃষির বিভিন্ন উপখাতের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত বিষয়াদি একসূত্রে গাঁথা পড়ে।

একটা সময় আমি যখন অনুষ্ঠান করতে গ্রামে গিয়েছি, দেখেছি গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষকের বাড়ির কাচারিঘরের সামনে ভাতের ফ্যানের জন্য লাইন ধরে লোক দাঁড়িয়ে থাকত। ছিল খাদ্যাভাব। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। কভিড-১৯-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের কৃষক এ দেশের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে সমর্থ হয়। কৃষকের পাশাপাশি এ উন্নয়নযাত্রায় বিজ্ঞানী, গবেষক, মাঠ পর্যায়ের কর্মী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কৃষিতে ফলন বেড়েছে, মানুষের ভাতের অভাব কমেছে। নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি কৃষকের খাবার থালাটিতে ভাত ভরা থাকত, কোনায় থাকত এক টুকরো পিয়াজ আর একটা কাঁচা মরিচ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্লেটের অবস্থাও পাল্টেছে। ভাত কমে সেখানে যুক্ত হয়েছে সবজি, মাছ, মাংস, ডাল। কভিড-১৯-এর আগে কৃষিতে আমরা যে অবস্থানে ছিলাম, বলা চলে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছিলাম। ফসল বৈচিত্র্যের পাশাপাশি নানা ফল চাষও বেড়েছে। আগে ফলের দোকানে লাল ও কমলা রং চোখে পড়ত। অর্থাৎ আপেল আর কমলায় ভরে থাকত ফলের দোকানগুলো। এখন ফলের দোকানে যে রঙের বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা বাংলাদেশের কৃষকই এনেছে। কভিড-১৯-পূর্ব বাংলাদেশের কৃষির সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি সময়, সমৃদ্ধ একটি সময়। ফলে ফসলে অভাবনীয় প্রাচুর্য দেখেছি আমরা। ধানসহ সব খাদ্যশস্য, সবজি, ফল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে আমাদের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে কৃষক আজকের উৎপাদন সাফল্য অর্জন করেছে। এর পেছনে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের যেমন প্রভাব রয়েছে, একই ভাবে রয়েছে কৃষকের ব্যক্তি উদ্যোগ। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ করে কৃষক নিজস্ব প্রচেষ্টায় কিছুটা বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। এই তো গত নভেম্বরেই প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৯ বছরে দেশে প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ গুণ। ১২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ওই রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে স্থূলকায় ও খর্বাকৃতির মানুষের সংখ্যাও। দেশে খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি একটি নিশ্চয়তার জায়গায় পৌঁছে গেছে। তবে কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়লেও বণ্টনের প্রশ্নে কিছু অবহেলা রয়েছে। বলব কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আমাদের অবহেলা যথেষ্ট রকমের। জমি চাষ, ধান মাড়াই ও সেচে বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সবচেয়ে বড় সাফল্য থাকলেও হার্ভেস্টের ক্ষেত্রে কিংবা বীজ বপন, চারা রোপণ ও সার-কীটনাশক প্রয়োগে যান্ত্রিকীকরণ সে অর্থে অনেক পিছিয়ে। জমি চাষে ৯৫ শতাংশ কলের লাঙ্গল ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে ধান মাড়াইয়ে ৯৫ শতাংশ মাড়াই যন্ত্র বা থ্রেসার ও সেচব্যবস্থায় ৯৫ শতাংশ পাওয়ার পাম্প ব্যবহার হচ্ছে। আমি বলব, এর পেছনে ২০১০, ২০১১, ২০১২ সালে সরকারের কৃষিযন্ত্রগুলোয় দেওয়া সাবসিডি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ সময়ে এসে হার্ভেস্টে বা রোপণসহ সব ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত করা যে জরুরি হয়ে পড়েছে তার উদাহরণ- করোনা সময়ে বোরো ফসলে হাওরাঞ্চল বা দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে হার্ভেস্টার ব্যবহার করে ফসলহানির বিপর্যয় রোধ করা গেছে।

২০০৪ সালে জাপান অ্যাগ্রিকালচার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকা- দেখতে জাপান গিয়েছিলাম। সেখানে তারা সামার টমেটোর চাষ করছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কীভাবে কৃষককে বেশি লাভবান করে তোলা যায় সে বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখেছি। দেখেছি কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে কীভাবে কৃষকের শ্রম কমিয়ে এনেছে। আমার দেশের কৃষক যখন ধান রোপণ করতে গিয়ে বিভিন্ন অকুপেশনাল হ্যাজার্ড বা স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হচ্ছে, তখন তারা কত কম সময়ে যন্ত্রের সাহায্যে কম পরিশ্রমে বেশি ফলন তুলছে। আমার বিভিন্ন দেশ সফরের উদ্দেশ্য ছিল সেসব দেশের কৃষিকৌশল সম্পর্কে আমার দেশের কৃষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের অবহিত করা। আইপিএম নিয়ে কত রকমের গবেষণা করেছে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য। তারা শুধু স্মেলে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গবেষণা করে প্যাটার্ন, কালার ইত্যাদি বিষয় যুক্ত করেছে। কৃষকের ফসল সুরক্ষিত মানে কৃষক সুরক্ষিত। গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসের সার্টিফিকেট উগান্ডার আছে, কেনিয়ার আছে বাংলাদেশের নেই।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেখানে শুধু ফসল কৃষির যন্ত্রের কথাই উল্লেখ আছে। অথচ সারা বিশ্বে কৃষির উপখাতগুলো যেমন ডেইরি, পোলট্রি কিংবা মাছ চাষে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন যেমন বাড়িয়েছে, সে খাতে তরুণদের সংযুক্তিও বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোরিয়া ২০২০ সালের মধ্যে শতকরা ২২ ভাগ ফার্মকে স্মার্ট ফার্মিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে কৃষি খাতে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের স্মার্টডিভাইসের বাজার তৈরির প্রকল্প নিয়েছে। অন্যান্য দেশ যে গতিতে কৃষি মেকানাইজেশনে গেছে, আমাদের গতি সে তুলনায় অনেক শ্লথ। উন্নত দেশগুলো মেকানাইজেশন শেষে যাচ্ছে ডিজিটাইলেজেশনে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনাসহ সবকিছু। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে। এখন পৃথিবীতে নতুন নতুন যেসব কৃষিযন্ত্র আসছে তাতে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস। প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার বা স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার যেমন কৃষকের সময় ও শ্রম বাঁচাচ্ছে, উৎপাদন খরচ কমিয়ে লাভের পরিমাণও নিশ্চিত করছে। আপনার যদি ১০০ গরু থাকে প্রতিদিন সেগুলোর দেখভাল করার জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হয়। তাদের পক্ষে সব ধরনের খোঁজখবর রাখাও সম্ভব নয়। অথচ একটা বোলাস গরুর পেটে বা একটা ডিজিটাল কলার গরুর গলায় পরিয়ে দিলে গরু কখন কী অনুভব করছে, খাবার ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, হিটে আসছে কিনা, মিসকারেজ হলো কিনা সব তথ্যই মুহূর্তে পেয়ে যাবেন আপনার স্মার্টফোনে। ২০০৪ সালে জাপানের টোকিও সিটির পাসোনা ২-তে দেখেছি মাটির আট তলার নিচে কৃষি হচ্ছে, সয়েললেস অ্যাগ্রিকালচার, ড্রিপওয়াটার ইরিগেশনে। আপনি যে ধরনের ফলন আশা করবেন, সে রকম ফলন পেতে পারবেন। ১টি টমেটো গাছ থেকে ৩০ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব। টমেটোর আকার থাকবে একই রকম। আমাদের কৃষিও সেদিকেই যাবে।

করোনাভাইরাসের সংকট আশা করি কেটে যাবে। সংকট কেটে গেলেও পুরোপুরি হয়তো দূর হবে না। জীবনাচারে নতুন নতুন বিষয়কে মেনে নিয়ে শুরু করতে হবে, সেটা হবে নিউ নরমাল। সেই নরমাল জীবনটা আদতে কতটা স্বাভাবিক হবে সেটাই প্রশ্ন। বিপদ এখন আমাদের চারদিক থেকে। করোনার মতো মহাদুর্যোগের ভিতরেই বাংলাদেশকে ভৌগোলিক কারণে নির্ধারিত সব দুর্যোগ একের পর এক পার করতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির শুরুতে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে কৃষির অনেক রকম ক্ষতি হয়েছে। আবার উত্তরাঞ্চলে আগাম বন্যা কৃষক তথা গ্রামীণ তৃণমূল জনগোষ্ঠীকে বহুমুখী সংকটে ফেলেছে। এখন বন্যাকবলিত দেশের উত্তর আর মধ্যাঞ্চলের ৩৩ জেলা। নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর ও দিনাজপুরের নিচু এলাকা আর গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। এখন কৃষকের খেতে তৈরি হচ্ছে আমন বীজতলা। আমন মৌসুমের জন্য ২ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে আউশের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এরই মধ্যে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে আউশের আবাদ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এ পাটের বেশির ভাগই প্রায় পরিণত অবস্থায় আছে। আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১২ দিনের মধ্যে তা কাটা যাবে। এ বছর ৮২ লাখ ৪২ হাজার বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বন্যায় এরই মধ্যে জামালপুর, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও রাজবাড়ীর নিম্নাঞ্চলের পাট সাত-আট দিন ধরে পানির নিচে আছে। এক সপ্তাহের বেশি পানির নিচে থাকলে পাট নষ্ট হয়ে যায়। অনেক জায়গায় বন্যার পানি নামছে, আবার অনেক জায়গায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যদিও বর্ষার শেষ ভাগে বন্যা আমাদের দেশের জন্য অনেকটা অনিবার্য। কোনো বছর বন্যার ক্ষতি কম হয় কোনো বছর বেশি। প্রতি বছর সাধারণত জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে বন্যার পানি কৃষকের জমি তলিয়ে দেয়, এ বছর জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহেই বন্যা দেখা দেওয়ায় কৃষক বেশি ক্ষতির মুখোমুখি। এবার বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিতে এমনিতেই বহুমুখী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। আবার বন্যা পরিস্থিতি যদি এর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়, তাহলে তা আমাদের কৃষি উৎপাদন থেকে শুরু করে নদীতীরবর্তী এলাকার জনজীবনের ওপর বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের দেশে প্রতি বছর যে বন্যা হয় তার ৯৩ শতাংশই আসে আন্তদেশীয় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে। মৌসুমি বন্যার ক্ষেত্রেও ৮০ ভাগ দায় বাইরের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সমন্বয় থাকার যথেষ্টই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে আশার কথা, ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নানামুখী প্রকল্প রয়েছে বলে জেনেছি।

আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরতে শুরু করেছেন। দেশে ফিরে শুরু হবে তাদের বেকার জীবন। ওদিকে গার্মেন্টেও ছাঁটাইয়ের কথা শোনা যাচ্ছে, অনেক গার্মেন্টের কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না। আবার অনেক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী যুক্ত হচ্ছেন কৃষিতে। তাদের হাতে অর্থ আছে, টেকনোলজি আছে, টেকনোলজি ব্যবহারের জ্ঞান বা দক্ষতাও আছে। ফলে শিল্পপতিরা এখন কৃষিশিল্পের দিকে অগ্রসর হবেন। এতে রাষ্ট্রের উৎপাদন বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে। আমাদের উন্নয়নের স্বার্থে সেদিকেই হয়তো যেতে হবে। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, পুঁজিপতিদের সঙ্গে সাধারণ কৃষক পেরে উঠবে না। আমরা দেখেছি, গার্মেন্ট ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমিতে গার্মেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। একসময় কৃষক তার জমি গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়ে পরিবার নিয়ে সেই গার্মেন্টের শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। কৃষিশিল্পের প্রসারে অদূর ভবিষ্যতে কৃষকের জমি শিল্পপতিদের হাতে চলে যাবে। কারণ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কৃষি একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও বিনিয়োগের কৃষি। এ ক্ষেত্রে কৃষককে সচেতন হতে হবে, সরকারেরও উদ্যোগ নিতে হবে, যেন কৃষক তার জমি হাতছাড়া না করে। কৃষককে ওই উদ্যোগের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিতে হবে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কৃষকের বিনিয়োগ ছিল সবচেয়ে বেশি। সে তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে। কৃষকের শ্রম-ঘাম-যন্ত্রণায় উৎপাদিত ফসলে খাদ্যের জোগান এসেছে, সমৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু এক অজানা কারণে কৃষক বরাবরই থেকে গেছে সমাজের, রাষ্ট্রের মূল স্রোত থেকে দূরে, আড়ালে। কভিড-১৯-পরবর্তী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কৃষক এক অনন্য মর্যাদার আসনে আসীন থাকবে- এমনটাই প্রত্যাশা করি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর