রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা
জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস

বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধির পথপ্রদর্শক

নসরুল হামিদ

বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধির পথপ্রদর্শক

আজ ৯ আগস্ট। আমাদের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। এ দিনটির কথা অনেক মানুষই জানে না হয়তো। কিন্তু এ দিনটির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য এই যে, আমাদের জাতীয় উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধিকে বদলে দেওয়ার মতো একটি ঘটনা ঘটেছিল এদিন। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুজাতিক শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে মাত্র পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাসটিলা ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে (তখনকার সময়ে ১৭-১৮ কোটি টাকা হবে) কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদসমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্রগুলো এত সস্তায় কিনে নেওয়ার ঘটনা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের পরও বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদনের ৩১ দশমিক ৪৪ শতাংশ জ্বালানি, নামমাত্র মূল্যে কেনা এ গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি সুরাহা করে দেন। তাঁর এ সিদ্ধান্ত একটা চেঞ্জ গেম তৈরি করে দিয়েছে আমাদের জন্য। জাতির পিতা বুঝেছিলেন ভবিষ্যতে আমাদের দেশে শিল্পায়ন বা উন্নয়ন করতে গেলে প্রথমে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অর্থাৎ জ্বালানি ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কথাটি তিনি মাথায় রেখেছিলেন। তিনি আরেকটি বিষয় মাথায় রেখেছিলেন তা হলো, জ্বালানির জন্য বিদেশনির্ভরতা কমানো। নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে তিনি সব সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একটা বিষয় জেনে সবাই অবাক হবেন যে, এত বিশাল গ্যাসসমৃদ্ধ পাঁচটি কূপ নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়ার যে চুক্তিটি জাতির পিতা করেছিলেন তখনকার সময় তো বটেই বর্তমান বিশ্বেও জ্বালানি চুক্তিগুলোয় এমনটা ভাবা যায় না। জাতির পিতার এই সুদূরপ্রসারী চিন্তার কথা যখনই ভাবী তখনই একটা কথা মনে হয়, সে সময় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও কম সাহসের ছিল না। কারণ, সদ্যস্বাধীন দেশে আমাদের সমস্যাগুলো ছিল বহুমাত্রিক। দেশ পুনর্গঠনে দিনরাত জাতির পিতা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তখন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবকিছুরই অভাব। নয় মাসের যুদ্ধে আমাদের সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস করে গেছে পাকিস্তানি আর্মি। রিজার্ভে ছিল না কোনো টাকা। বাংলাদেশটাকে একেবারেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল জাতির পিতাকে। সেই সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। যে বৃহৎ শক্তিগুলো আমাদের স্বাধীনতা চায়নি তারাই আন্তর্জাতিক ফুড পলিটিক্স থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র ও ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করতে চেয়েছে। এত কিছুর পরও আমরা দেখতে পাই সারা জীবন বঙ্গবন্ধু যে রাজনৈতিক দর্শন লালন করেছেন তা হলো, একটি আত্মমর্যাদাশীল স্বনির্ভর জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা। একটি দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা। নিজস্ব খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ওপর বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই জোর দিচ্ছিলেন। এ কারণে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা করে দেশের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের সূচনা করেন। জাতির পিতা শুধু এ দেশ স্বাধীনই করেননি, প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব যতœ নিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন আমাদের জন্য। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে এ মন্ত্রণালয়ে আসার পর পুরনো ফাইলপত্র, আইন ও নীতিমালা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধু কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতেন। এক অসাধারণ দূরদর্শীসম্পন্ন নেতা না হলে এত কিছু ভাবা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। আমরা প্রতিদিন যখন কাজ করতে যাই তখনই বুঝতে পারি সব বিষয়েই বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য একটা গাইডলাইন তৈরি করে গেছেন। জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন দেশ গড়ার। এ সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে ভিত দরকার তার সবই করে গেছেন। এত স্বল্পসময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য এত কিছু করে গেছেন যে, এখন এই সময়ে এসে যখন ভাবী তখন অবাক না হয়ে পারি না। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ সমুন্নত রেখে রাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু আইনও পাস করে গেছেন। ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও সমুদ্র আইন পাস করেন। বঙ্গবন্ধু সমুদ্রে বিশাল এক সম্ভাবনা দেখেছিলেন। জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার সেই স্বপ্নের পথেই হাঁটছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির যে রূপরেখা দিয়েছেন তা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই এগিয়ে চলেছে। আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমায় রয়েছে তেল-গ্যাসের বিপুল এক সম্ভাবনা। জাতির পিতা একদিকে যেমন জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিতের জন্য কাজ করেছেন তেমনি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণেরও ভিত গড়ে দিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন, শুধু শহরকেন্দ্রিক চিন্তা না করে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে পল্লীগ্রামেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে। জাতির পিতা সে কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, খুবই অল্প সময়ে জাতির পিতাকে আমাদের হারাতে হয়েছে। তারপর দীর্ঘ এক সামরিক স্বৈরশাসনে আমাদের সব প্রতিষ্ঠানই নষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য না থাকায় স্বেচ্ছাচারভাবে দেশ চালিয়েছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার স্বপ্ন ধুলায় লুটিয়ে যায়। কিন্তু তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর দেশে গণতন্ত্রের নতুন করে যাত্রা হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ এগিয়ে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের লক্ষ্য দেশের মানুষকে নিরাপদ ও সহজলভ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষেই আমাদের প্রতিজ্ঞা শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা। সে লক্ষ্যে কাজও খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। গ্রিড অঞ্চলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সবার ঘরে আলো পৌঁছে যাবে। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষকে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে ‘সেবা বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।      

লেখক : প্রতিমন্ত্রী- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

সর্বশেষ খবর