বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

কভিড-১৯ ও ভার্চুয়াল আদালত

ব্যারিস্টার মুনা চৌধুরী

কভিড-১৯ ও ভার্চুয়াল আদালত

৫ ও ৯ আগস্ট, ২০২০ থেকে সব দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত, ট্রাইব্যুনাল, হাই কোর্ট খোলার ঘোষণা এবং আইনজীবীদের শারীরিক উপস্থিতিতে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক আদালতের পাশাপাশি ভার্চুয়াল আদালত চলবে তার নিজের মতো করে সীমিত কার্যাবলি নিয়ে এবং পরে সম্পূরক আদালত হিসেবে ভার্চুয়াল আদালত ন্যায়বিচার প্রদানে জনগণকে সুফল দিয়ে যাবে। কভিড-১৯ একটি নজিরবিহীন ও ক্রমাগত পরিবর্তনশীল সমস্যা। এর শুরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা থমকে গেলেও ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে পৃথিবী আবারও সচল হচ্ছে। সংবিধানে সংরক্ষিত জনগণের মৌলিক অধিকার ‘ন্যায়বিচার’ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল আদালত বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেছে। মে, ২০২০-এ এক যুগান্তকারী ঐতিহাসিক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’-এর সূত্রপাত করে ভার্চুয়াল আদালত চালু করে। ভার্চুয়াল আদালতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মামলাকে ‘urgent’/‘অতীব জরুরি’ হিসেবে গৃহীত হতে হবে।urgent শব্দটির পরিভাষা প্র্যাকটিস ডিরেকশনে অস্পষ্ট কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিচারকদের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে তাদের নিজের বিচারিক বিবেচনায় মামলাকে urgent হিসেবে গ্রহণ করার। যার অর্থ আপনার মামলাটি শুধু তখনই আদালত গ্রহণ করবে, যখন সংশ্লিষ্ট বিচারক আপনার মামলাকে urgent হিসেবে অনুমোদন দেবেন, নচেত নয়।

ভার্চুয়াল আদালতের বেশ কিছু সাফল্য আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাই। ভার্চুয়াল আদালত সীমিত পরিসরে হলেও এখানে ফৌজদারি, দেওয়ানি- দুই ধরনের মামলাই দায়ের হয়েছে এবং মামলার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গৃহীত হয়েছে ফৌজদারি জামিন দরখাস্ত। আমাদের দেশে প্রায় ৮০% হাজতির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি অর্থাৎ যারা বিনা বিচারে জেল খাটছেন। এদের জামিন পাওয়ার সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার রয়েছে। ইতোমধ্যেই লক্ষণীয়, জুন নাগাদ ২৩ হাজারের বেশি হাজতিকে জামিন দেওয়া হয়েছে, যা ভার্চুয়াল আদালতের একটি ইতিবাচক অর্জন। এ ছাড়া ৫০০-এর মতো শিশু বন্দীকেও ভার্চুয়াল আদালত ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে ভার্চুয়ালি অনেক বেঞ্চ কাজ করছে যেমন ফৌজদারি, দেওয়ানি, কোম্পানি, রিট, ইত্যাদি। ভার্চুয়াল আদালতের প্রধান সাফল্য বেঞ্চের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েছে, সেই সঙ্গে আমাদের আইনজীবী ও বিচারকরা এই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছেন। সুখকর বিষয় হচ্ছে, দেওয়ানি মামলা হয়েছে তবে স্বল্পপরিসরে কমসংখ্যক বেঞ্চ নিয়ে। তাই জনগণ সব ধরনের দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে পারেনি যেমন বর্তমান কভিড-১৯-এর দুর্যোগে চাকরি চলে যাওয়া, সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়া, কভিড-১৯-এ আক্রান্ত মৃতের স্বজনদের সাকসেশন মামলা, বণ্টন মামলা, নিষেধাজ্ঞা, দেনমোহর, খোরপোশ, ইত্যাদি বিষয়। তা ছাড়া এ দুর্যোগে প্রভাবশালী দুষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত, অন্তরিন থাকায় নারী নির্যাতনও বেড়ে গেছে এবং এ-জাতীয় মামলাও অনেক ক্ষেত্রে হয়নি। এ অবস্থায় অনেক আইনজীবী তাদের মক্কেলদের শালিস বা কোর্টের বাইরে সমঝোতার পরামর্শ দিয়েছেন; যা ‘শালিস আইন, ২০০১’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাস্তবতায়, শালিসের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত জনগণের মধ্যে এ নিয়ে বিরাট সংশয় আছে যার অন্যতম কারণ শালিস/arbitration আমাদের দেশে এখনো নবজাতক পর্যায়ে আছে এবং এর ইতিবাচক ফল নিয়ে জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই সন্দিহান। ভার্চুয়াল আদালতের আরেকটি সাফল্য মামলা দায়েরের সহজ পদ্ধতি, যা এ প্রযুক্তিতে অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবীদের পক্ষেও সহজে ব্যবহার্য। কম্পিউটার ব্যবহারে অনভিজ্ঞ আইনজীবীরাও খুব অল্প সময়ে ভার্চুয়াল প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হতে পেরেছেন। যে কোনো নতুন বিষয়ে সীমাবদ্ধতা থাকবেই এবং ভার্চুয়াল আদালতও এর ব্যতিক্রম নয়।

অনেক আইনজীবীর মতে ‘অতীব জরুরি’ শব্দটির একটা পরিষ্কার পথনির্দেশনামূলক সূত্র দেওয়া উচিত যেমন কী কী বিষয় urgent  হবে আর কী কী বিষয় ঁৎমবহঃ হবে না; কারণ যার যার নিজের মামলা তার কাছে urgent । যদিও এর বিপরীতে অনেকের মত আছে, ভার্চুয়াল আদালত বিষয়টি যেহেতু আমাদের কাছে এখনো নবজাতক-সদৃশ যার প্রতিদিন বিবর্তন হচ্ছে আর আমরাও এর সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছি, তাই urgent -এর সুস্পষ্ট পরিভাষা ও ব্যাখ্যা আপাতত অস্পষ্ট থাকাই শ্রেয়। ভার্চুয়াল আদালতের আরেকটি সীমাবদ্ধতা - মামলা দায়েরের প্রতিটি পদক্ষেপ ভার্চুয়াল নয়, অনেক পদক্ষেপই বাস্তবে নিতে হয় যেমন ওকালতনামায় বার সিল বসানো, বাস্তবে পিটিশন ছাপিয়ে ও স্পিড মানি বেঞ্চ অফিসারকে দেওয়া, ফৌজদারি মামলার নথি তোলার জন্য কোর্টে যাওয়া, ইত্যাদি। যদিও নথি তোলার বিষয়টি ভীষণ জটিল যা সময়ের বিবর্তনে দেশজুড়ে ৬৪টি জেলার সব আদালতের ভার্চুয়াল হওয়ার মধ্য দিয়ে মিটে যাবে। মামলার বিষয়বস্তুর গোপনীয়তা ভার্চুয়াল আদালতের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হতে পারে। ভার্চুয়াল নিম্ন আদালতে মামলার গোপনীয়তা রক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে যেহেতু বেশির ভাগ আইনজীবী ব্যক্তিগত জিমেইল থেকে মামলার তথ্য পাঠাচ্ছেন; যা গুগলের এখতিয়ারে চলে যাচ্ছে। উপরন্তু মামলার তথ্য পাচারসংক্রান্ত দুর্নীতির সুযোগ এখানে থেকে যেতে পারে।

সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এ মামলার বিষয় গোপন রাখার আইনি বিধান প্রাধিকারযোগ্য, যেমন আইনি উপদেষ্টার সঙ্গে গোপনীয় যোগাযোগ [ধারা ১২৯], পেশাদার যোগাযোগ [ধারা ১২৬], রাষ্ট্রের অফিশিয়াল রেকর্ড [ধারা ১২৩], ইত্যাদি। ভার্চুয়াল আদালতে ডিজিটাল সুরক্ষা ও তথ্য গোপনীয়তা কতখানি রক্ষিত তার পরিমাপ এখনো শতভাগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়গুলো ভাবা হয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো দূর করার কথাও বলা হয়েছে। ভার্চুয়াল কোর্টকে আরও সাবলীলভাবে পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, সেই সঙ্গে বেগবান ইন্টারনেট সংযোগ। এ দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজারো অভিজ্ঞ আইনজীবী, বিশেষ করে জেলা বারগুলোয় যারা জীবনভর আইন পেশায় নিযুক্ত, কিন্তু তারা এ ভার্চুয়াল নব্যপ্রযুক্তিতে অভ্যস্ত নন। আইন পেশায় নিযুক্ত এসব অভিজ্ঞ আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কোর্ট কর্মকর্তাদের আরও বেশি করে ভার্চুয়াল মামলা পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রযুক্তিতে ব্যবহার্য সরঞ্জামসমূহ যেমন অ্যান্ড্রয়েড ফোন, কম্পিউটার, স্ক্যানার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ, ইত্যাদি তাদের জন্য সুলভমূল্য ও সহজলভ্য করার পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।

লেখক : নিবন্ধিত আরবিট্রেটর কুয়ালালামপুর রিজিওনাল সেন্টার ফর আরবিট্রেশন।

সর্বশেষ খবর