বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

হত্যা ও ষড়যন্ত্র ঘৃণ্য অপরাধ

এম এ মান্নান

হত্যা ও ষড়যন্ত্র ঘৃণ্য অপরাধ

ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। আল্লাহ-প্রদত্ত জীবনবিধানের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে এর নামে। ইসলাম জগদ্বাসীকে সব ধরনের হানাহানি এবং হত্যা ও ষড়যন্ত্র থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আল কোরআন ও হাদিসে ষড়যন্ত্র, হানাহানি ও অকারণ হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’ বুখারি, মুসলিম। তিনি আরও বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীকে নিয়ে আসবে। হত্যাকারীর চুলের অগ্রভাগ ও মাথা নিহতের হাতের মুষ্টিতে থাকবে আর তার কণ্ঠনালি থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার রব! এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তাকে আরশের কাছে নিয়ে যাবে।’ তিরমিজি, মুসনাদ আহমাদ।

দুনিয়ার প্রথম হত্যাকান্ড ঘটেছিল হজরত আদম (আ.)-এর সময়। তাঁর ছেলে কাবিল ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিলেন হিংসাশ্রয়ী মনোভাব নিয়ে। হিংসাশ্রয়ী মনোভাব যুগে যুগে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। ইসলামের চার খলিফার তিনজন হজরত ওমর, ওসমান ও আলী (রা.) প্রাণ হারিয়েছেন হিংসাশ্রয়ী অপশক্তির হাতে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই প্রিয় নাতি ইমাম হাসান ও হোসাইন (রা.) নির্মম হত্যার শিকার হন। ক্ষমতালোভী পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ চক্রের হাতে তাদের প্রাণ যায়। মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসেও ক্ষমতালিপ্সার কারণে অসংখ্য হত্যাকান্ড ঘটেছে। আমাদের জাতীয় জীবনেও ষড়যন্ত্র, হানাহানি ও অকারণ হত্যাকা- ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করেছে।

হানাহানি ও অকারণ রক্তপাত মানবসমাজে বিভক্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে। যে কারণে ইসলামী অনুশাসনে হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া হয়েছে। সুরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে অকারণ হত্যাকে সমগ্র মানব জাতিকে হত্যার অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুরা নিসার ৯৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মুসলমানকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’

ইসলামে হত্যাকা-কে কবিরা গুনাহ ঘোষণা করে এ পাপে জড়িত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি এবং মানুষের জীবন রক্ষায় অবদান রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সুরা আল মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘এ কারণেই আমি বনি ইসরাইলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে কেউ কোনো হত্যার বিনিময়ে অথবা পৃথিবীতে গোলযোগ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবকুলকে হত্যা করল, আর যে কারও জীবন বাঁচাল সে যেন সমগ্র মানবকুলের জীবন বাঁচাল।’ ইসলাম এমনই এক জীবনবিধান যেখানে সকল ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি সর্বাধিক ঘৃণিত। ১. যে মক্কার হারামে নিষিদ্ধ বা গুনাহর কাজ করে ২. যে ইসলামে জাহেলি রাজনীতি কামনা করে এবং ৩. যে অবৈধ রক্তপাতের মানসে কোনো মুসলমানের রক্ত দাবি করে।’ বুখারি থেকে মিশকাতে।

পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হলো হত্যাকান্ড। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাতটি মহাপাপ থেকে বেঁচে থাক। এর প্রথমটি হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক বা অংশীদার করা। আর তৃতীয়টি হলো অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা’ বুখারি, মুসলিম। ইমাম কুরতুবি (রহ.) মুসনাদে বাজ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে যদি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে আল্লাহ সব মানুষকেই জাহান্নামে দেবেন। এর পরও অন্যায়ভাবে হত্যাকে কখনো মেনে নেবেন না।’ ইমাম কুরতুবি আরেকটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মানুষ যদি আরেকজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যায় মুখের একটি কথা দিয়েও সাহায্য করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার কপালে লেখা থাকবে- এই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে মাহরুম।’ আকদিয়াতুর রসুল।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মোমিন বান্দা যদি আল্লাহর কাছে এমন অবস্থায় হাজির হয় যে সে কারও রক্ত ঝরায়নি, অর্থাৎ কোনো হত্যাকান্ডে জড়ায়নি, তাহলে আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যায় তাকে ক্ষমা করে দেওয়া।’ মুসলিম।

একবার হজরত হামজা (রা.) রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে এমন পথ বলে দিন যা আমাকে সুখী করবে। তিনি বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা ও ধ্বংস করা- এ দুটির মধ্যে তুমি কোনটি পছন্দ কর? হামজা বললেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুনিয়া ও আখিরাতে সুখী হওয়ার জন্য তুমি এ কাজই করতে থাক।’ মুসনাদে আহমাদ।

হত্যা, ষড়যন্ত্র, হানাহানি থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত রাখতে হলে আমাদের সবাইকে আল্লাহর বিধান ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও যাবতীয় পাপাচার থেকে তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে।

যারা হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় তাদের পরিণাম সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। হত্যা ও ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের পরিণাম কখনো ভালো হওয়ার কথা নয়। আমাদের এই যুগে যারা এ ধরনের গর্হিত কর্মকান্ডে জড়িত তাদের পরিণতি দেখলে স্পষ্ট হয় আল্লাহর বিধান কতটা অলঙ্ঘনীয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে অসত্য পথ থেকে দূরে থাকতে এবং শান্তি ও কল্যাণের পথে চলার তৌফিক দিন। হত্যা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন দেশ ও জাতির সেসব সুসন্তানকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন।

                লেখক :  ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর