শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার সঙ্গে আলাপ আলাপন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনার সঙ্গে আলাপ আলাপন

এবার শীতের পর ওমরাহ হজ পালন এবং জাপান সফরের পরিকল্পনা তো ছিলই, বাইরে আরও কিছু ঘোরাফেরার সুযোগ মিলেও যেত। ওমরাহর টাকা যেদিন জমা দেব ঠিক তার আগের দিন ঘোষণা এলো করোনার কারণে সৌদি সরকার ওমরাহ ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে। করোনা চীন থেকে ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে বেড়িয়ে জাপান ও মধ্যপ্রাচ্য- সব ঘাটে তার তরী ভিড়িয়েছে। কোনো কোনো দেশে সেকেন্ড রাউন্ড বা কোয়ার্টার ফাইনালে। এখন সে বিশ^ অতিথি, ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের রূপ নিয়েছে। বেশ কদিন ধরে ভাবছি করোনার সঙ্গে আলাপ করতে পারলে বুঝতে পারতাম তার আসল মতলব কী। দেশে দেশে বাঘা বাঘা গোয়েন্দাও ফেল মেরেছে বললে কম বলা হবে, তারা নিজেরাও কুপোকাৎ করোনার কাছে। কীভাবে করোনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় এসব ভাবনা মাথায় নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।

প্লেনটা সিমলা শহীদ ভগৎ সিং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এই মাত্র ল্যান্ড করেছে। এখান থেকে লাদাখ, যেখানে চীন-ভারত টক্কর লাগবে লাগবে ভাব, মাত্র ৭২০ কিলোমিটারের পথ। ভারতে ব্রিটিশ সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল সিমলা। অনেক রাজনৈতিক দেনদরবার, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সিমলায়। লাদাখের গ্যানজাম নিয়ে কোনো পরামর্শের মহড়া দেখতেই কি সিমলায় এলাম? এসব এলোমেলো যখন ভাবছি হোটেলের লম্বা লনে, তখন দেখি মাথায় রঙিন ফুলের মালা পেঁচিয়ে জড়িয়ে কেউ একজন যেন বসে আছেন একটু দূরে, দৃষ্টি তাঁর পর্বতমালার দিকে। কৌতূহল হলো, এক পা দুই পা করে এগিয়ে যেতেই একটু নড়েচড়ে বসলেন মনে হলো। এক্সকিউজ মি, আপনাকে চেনা...’ আমার বিস্ময়ভরা বাক্য শেষ করতে দিলেন না, ‘আমি করোনা, অফিশিয়াল নাম কভিড-১৯, চিনতে দেরি করলেন কেন? দেশে দেশে টেলিভিশনে আমাকে এত রংঢঙে দেখানো হয়, আমি অতি অতি সূক্ষ্ম হলেও আমাকে এমনভাবে দেখানো হয় যে, আমি ভোটে দাঁড়ালে কোনো কোনো দেশের নির্বাচন কর্তাব্যক্তিদেরও বাড়তি আয়-ব্যয়ের উপায় উপলক্ষ বন্ধ হয়ে যাবে।’

তবে তিনি কেন এ মুহূর্তে সিমলায় জানতে চাইলাম, মুচকি হাসলেন, ‘অনেকে আমাকে শুধু সংক্রামক ভাইরাস হিসেবে জানে বা ভাবে, আমার সৃষ্টি, বিকাশ ও বিশ্ব ভ্রমণসূচি, আতঙ্ক সৃষ্টির পেছনের রহস্য বোঝার সময় তারা পায় বলে মনে হয় না। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে ক্ষমতার লড়াই, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই তারই অতি আধুনিক একটি উপায় ও উপলক্ষ আমি। আমার কর্মসূচির ব্যাপ্তি ব্যাপক, তার সামান্য অংশই সবাই দেখছে এখন। আমি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম একটি ভাইরাস, কিন্তু আমার শক্তি ব্যাপক ও বহুমাত্রিক।’ দেখলাম ভালো পড়াশোনা আছে তাঁর। জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ সালের বইয়ে দেওয়া ভবিষ্যৎ দুনিয়ার প্রসঙ্গ আনলেন, এমনকি এই মাত্র মাস তিনেক আগে মার্কিন রাজনৈতিক ভাব-দার্শনিক নোয়াম চমস্কি আইসোলেশনে থেকে জুম সাক্ষাৎকারে কী বলেছেন কভিড-১৯ সম্পর্কে সে প্রসঙ্গও টানলেন। ‘বুঝলেন মশাই! সবই রাজনীতির খেলা, ব্যবসা ভাগানোর পাতানো খেলা, যেসব দেশে অতি চালাকরা সবাইকে বোকা বানিয়ে বহাল তবিয়তে থাকতে চায় সেসব দেশে আমার উপস্থিতির ব্যারোমিটার দেখেছেন? চুনোপুঁটিরাও কম যায় না। আমার দোহাই দিয়ে তাদের বড় বড় সমস্যা, দোষ ও দুষ্কর্ম ধামাচাপা দিতে পারছে। আমার মোকাবিলার নামে সবাইকে সম্মোহিত করে তারা নিজেদের আখের গোছানোর কাজ ঠিকই সেরে নিচ্ছে। আস্তে আস্তে আরও খেলা দেখতে পাবেন। আমাকে পাকড়াও করার কাজে আমার মতিগতি পাল্টানোর জোর প্রচেষ্টাও চলছে, কিন্তু কেন আমার উদ্ভব ও বিকাশ সেদিকে নজর না দিয়ে, নিজেদের শোধরানোর পথে না গিয়ে প্রতারণা ও শোষণে আরও সিদ্ধহস্ত হতে দেখছি অনেক দেশে অনেককেই।’ করোনা আমার দিকে একটু বাঁকা চোখে তাকালেন, বললেন, ‘কোনো কোনো দেশের প্রতি আমার একটা আলাদা টান আছে। আমি ভেবে রেখেছিলাম সেসব দেশে রয়েসয়ে যাব, কিন্তু তারাই তো তা করতে দিচ্ছে না। যেমন সব সময় সবার ‘পাশে থাকা’র কথা বলে সেসব দেশের আমজনতাকে আমার সামনে উপায়-উপকরণ প্রতিরোধ-প্রতিষেধক ছাড়া ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বশক্তিমানের দয়ায় ও সর্বসাধারণের নিজস্ব ভূমিকান্ড ভোগান্তিতে যদিও বা যেটুকু সাফল্য আসছে তা আত্মসাৎ করে নিজের সাফল্য বলে গর্ব করার এবং ব্যর্থতার উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর রেওয়াজ বাড়ছে। সবার কাছ থেকে এই ছিনিয়ে নেওয়া সাফল্যের দোহাই দিয়ে সবাইকে বোকা ভাবার সংস্কৃতি যে সমাজে সচল, সে সমাজে মৌনতার মানসিক যন্ত্রণা করোনার চেয়ে কম নয়। এসব দেশে আমি করোনা থাকব কি থাকব না কিংবা কত দিন থাকব সে বিবেচনার বল তো তাদের কোর্টে।’ আমার জানার বিষয়গুলো কেন জানি করোনা আগেভাগে ধরে ফেলেন। অকপটে স্বীকার করলেন, ‘অতীতের মহামারীগুলোর চাইতে আমাকে একটু বেশি কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। কেননা আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রসার মানুষের লোভকে লাগামহীন করে তুলেছে। মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা উৎসারিত লোভ ও আগ্রাসনই মানুষের মন্দ কাজের মূল। প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে যেখানে পরস্পরের সহযোগিতা সহাবস্থান করার কথা, সেই প্রকৃতিকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে মানুষ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পরিবর্তে প্রকৃতিকে ধ্বংসের উৎসবে মেতে উঠছে মানুষ। ক্ষমতালাভের হাতিয়ার হিসেবে মানুষ বিজ্ঞানকে এমনভাবে ব্যবহার করছে, আজ তার নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা প্রবল হচ্ছে। মারণাস্ত্র তৈরি করে তার বিক্রি বাড়াবার জন্য মানুষই যুদ্ধ বাধাচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে। পারমাণবিক অস্ত্র সঞ্চয় করে নিজের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে। সবাইকে বুঝতে হবে, আমি করোনা আমাকে আসতে হয়েছে যুগ যুগ ধরে মানবতার অবমাননা, বৈষম্য, লোভ-লালসা, মিথ্যাবাদিতা ও অহমিকার যে পাপাচার বিশ্বকে গ্রাস করছিল তার সমুদয় দূর করতে গোটা বিশ্বময় একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিতেই।’

কভিড-১৯-কে আমি কঠিন কর্কশ নির্দয় ও আতঙ্ক সৃষ্টিপটীয়সী ভাবতাম, তাঁকে এমন ইমোশনাল হতে দেখব ভাবিনি, তাঁর কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসছিল- ‘অনেক দেশে দেখছি আমাকে উপলক্ষ করে প্রতারণা-প্রবঞ্চনা, দুর্নীতি-দুষ্কর্ম যেন আগের মতো বেড়েই চলেছে। দেশে দেশে দেখছি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ এবং শোষণ-বঞ্চনার নতুন নতুন উপায় উপলক্ষ তৈরি হচ্ছে। বিত্তশালীদের আরও বিত্তবান হওয়ার মওকা মিলছে, মধ্যবিত্তকে নিম্নবিত্তের কাতারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মন্দার কথা বলে বেকারের বজরা ভারী হচ্ছে।’

এ পর্যায়ে করোনাকে লাউঞ্জের ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিতে দেখে কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না...। আপনার জন্য গরম পানি খেতে খেতে আমরা..., ‘অতিষ্ঠ হচ্ছেন, এই তো!’ আমি অতিষ্ঠ না বলে অন্য কোনো কূটকৌশলী সুশীল শব্দ বলতে যাচ্ছিলাম করোনা সে সুযোগ দিলেন না। ‘শুনুন, আমাকে মোকাবিলার জন্য অতি সাধারণ কয়েকটি ব্যবস্থাপনাই বা প্রসিডিউরই যথেষ্ট, কিন্তু আমাকে ভয়াবহ ভয়ঙ্কর রূপ দেওয়ার জন্য স্বার্থান্বেষীরা কঠিন করতে কসুর করেনি। কলেরা ও ডায়রিয়ায় রোগীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল ডি-হাইড্রেশন, জীবাণু পানিবাহিত বলে তাকে ঠেকানোর নামে রোগীকে পানি খেতে দেওয়া হতো না। অথচ পরে তো আপনারাই দেখলেন ওরাল স্যালাইন কলেরা-ডায়রিয়ার কেমন সহজলভ্য ও সহজসাধ্য ব্যবস্থা। করোনাকালে অনেক দেশে ওষুধ ও প্রসাধন কোম্পানির ব্যবসায়, স্বাস্থ্য উপকরণ ব্যবসায় পোয়াবারো ঘটেছে, রিপোর্ট জাল জোচ্চুরির, সিন্ডিকেশনের, চাকরি ছাঁটাইয়ের এবং আরও বেশি লুটপাটের সুযোগ পেতেই আমি যেন জটিল ও দীর্ঘায়িত হই সেজন্য আমার সংক্রমণ পরীক্ষাকে সীমিত সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, লকডাউনের কার্যকারিতাকে ছুটির ফাঁদে ফেলা হয়েছে, পরিসংখ্যানে পুকুরচুরির সুযোগে সেবা ও চিকিৎসাকে দুর্লভ ও ব্যয়সাধ্য করা হয়েছে। তবে লক্ষ্য করেছেন হয়তো আমাকে ভয় পাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যগত আক্রমণের অধিক শিকার হচ্ছে কিন্তু সচ্ছল ও ধনমানেরা, আর শিলনোড়ার এই নিষ্পেষণে নিঃস্ব হচ্ছে অসচ্ছল ও নিম্নবিত্তরা’। করোনা নিজেই স্বীকার করলেন, ‘মানুষে মানুষে বিভেদ ও দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে, রোগীকে সহানুভূতি জানাতে সেবা-শুশ্রƒষার মানবিক দাবি না মেটানোর মতো, এমনকি মৃত্যুর পরও পরিবারকে একঘরে করার পথ-পন্থাও সৃষ্টি করা হয়েছে। যারা সংক্রমণ পরীক্ষা, চিকিৎসাসেবাকে সহজসাধ্য করতে চেয়েছেন তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, বাধা দেওয়া হয়েছে। এসবের পেছনে কারণ একটাই...’। করোনা থামলেন, বললেন, ‘শব্দটি উচ্চারণেই এখন ভয় পান অনেকে। আমি কী করতাম।’ করোনার কণ্ঠে আঞ্চলিক টান শুনে সুদূর সিমলায় আমি বিস্মিত হলুম। এমন সময় আমার স্ত্রী ধাক্কালেন, বললেন, ‘অ্যালার্ম বাজছে।’

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর