শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

শোকের মাস আগস্টে স্বাধীনতাবিরোধীরা সক্রিয়

এইচ টি জোবায়ের সৈকত

আগস্ট মানেই বাংলাদেশের কাছে বিভীষিকা। শোকের মাস আগস্ট। ষড়যন্ত্রের মাসও। আজও ষড়যন্ত্র চলছে। পাক হানাদার বাহিনী  ১৯৭১-এ তাদের দেশীয় দোসরদের সাহায্যে নির্মম অত্যাচার চালায় আগস্টে। একাধিক বধ্যভূমি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের রক্তে। ব্যাপক গণহত্যার পাশাপাশি চলে মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন। ’৭১-এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হয় বর্বরতার চূড়ান্ত নিদর্শন। পাকিস্তানিদের বাঙালি নিধন কর্মকান্ডে মদদ জুগিয়েছে চীন। মুখ ঘুরিয়ে ছিল আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ। কিন্তু প্রতিবেশীর দুর্দশায় চুপ করে থাকতে পারেনি ভারত। ভারতীয় সেনাদের সার্বিক সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পরাস্ত হয় পাকিস্তান। কিন্তু বিদেশিদের চক্রান্ত আজও শেষ হয়নি। আগস্ট এলেই যেন বেড়ে যায় শত্রুর হিংস্রতা। তাই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুন করার পর ২০০৪-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের জন্ম আগস্টেই। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্যেই ছিল রক্তাক্ত পরিণতির বীজ। ব্রিটিশরা ভারতের পূর্ব প্রান্তকে পশ্চিম প্রান্তের পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেয়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠে পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর লুণ্ঠনের মুক্তভূমি। ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বাড়তে থাকে পাক অত্যাচার।  রাজনৈতিক অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানিদের। ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে পাক অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেন। তার পরই শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট নামে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। ২৫ মার্চই রক্তাক্ত হতে শুরু করে বধ্যভূমি। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন পাকিস্তানিদের হাতে। ২ লাখের বেশি মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়। তবে সে অত্যাচার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ভারতীয় সেনার সার্বিক সহযোগিতায় মহান মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। শত-সহস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তার পরও ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীরা এখনো বাংলাদেশকে অস্থির করে তোলার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ’৭১-এর আগস্টের প্রতিটি দিনই ছিল ভয়াবহ। মার্চেই শুরু হয়েছিল বাঙালি নিধন। আগস্টেও তা চলতে থাকে। ৩ আগস্ট ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে ছোট গ্রাম নকশী সেদিন রক্তাক্ত হয়েছিল পাক সেনার অত্যাচারে। রাজাকার আর আলবদরদের সহযোগিতায় বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় নকশীর মাটিতে। ৪ আগস্ট আটোয়ারী গণহত্যা পাক বর্বরতার আরেক নিদর্শন। আটোয়ারী উপজেলার ধামোর ইউনিয়ন থেকে জনা পঁচিশেক মানুষকে পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করা হয়। এর পরদিনই চুয়াডাঙ্গায় আট মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। গ্রামবাসীও রক্তাক্ত হন পাক হানাদারদের গুলিবর্ষণে। ৭ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া ইউনিয়নের রামনাথ হাটের গণহত্যা সেখানকার মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। গ্রামবাসীকে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হয়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় শিশু ও কিশোরদেরও। দুই দিন ধরে গণহত্যা চালিয়ে স্থানীয় নুরুল ইসলামের বাড়িতে পাক হানাদাররা মৃতদের কবর দেয়। নেত্রকোনার দুর্গাপুরে শুধু জানাজায় অংশ নেওয়ার অপরাধে পাক হানাদাররা গণহত্যা চালায়। ১৬ আগস্ট স্থানীয় সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে রশি দিয়ে বেঁধে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয় নিরীহ গ্রামবাসীদের দেহ। তারপর সেই লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় সোমেশ্বরী নদীতে। খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুন্দরবন প্রভৃতি জায়গায় একাধিক বধ্যভূমিতে চলতে থাকে পাকিস্তানিদের হত্যালীলা। বানিয়াচং উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কাগাপাশা ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত মাকালকান্দি রক্তাক্ত হলো ১৮ আগস্ট।

১৯৭১ সালে আগস্টের শেষ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। আর সেই মঙ্গলবারই নরসিংদী ও সুনামগঞ্জের মানুষদের কাছে ছিল ভয়ানক অমঙ্গলময়। দিনের শুরুটা অবশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। এদিন শিবপুর থানায় সফল আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। পুঠিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল বিক্রমে ৩৩টি লাশ ফেলে রেখে পালাতে হয় পাক সেনাদের। ৪ ঘণ্টার গুলিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনার ক্যাপ্টেন সেলিমও প্রাণ হারায়। এর পরই পাক সেনারা নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর গণহত্যা চালায়। রাজাকার-অলবদররা শান্তি বৈঠকের নামে গ্রামবাসীদের ছিরামিসি উচ্চবিদ্যালয়ে জমায়েত করে। তার পরই নৌকায় পিঠমোড়া করে বেঁধে চলে গুলির বৃষ্টি। ১২৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।  জনশূন্য গ্রামে চলে লুটতরাজ। শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলাতেও ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। ৩১ আগস্ট পাক হানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মিরপুর ইউনিয়নের শ্রীরামসী গ্রামে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় নারকীয় তা-ব চালিয়ে গ্রামের সহজ-সরল ১২৬ জনকে হত্যা করে। আগস্টের শেষ দিনে অবশ্য পাকিস্তানেরও ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায়।

’৭১-এর পরও আগস্টে হত্যালীলা বন্ধের বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে নিহত হন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, (তাঁর বাসায় হামলা চালিয়ে) তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াত, (তাঁর বাসায় হামলা করে)  তাঁর কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।  বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান। তার পরও চলছে তাঁদের খুন করার ষড়যন্ত্র। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অল্পের জন্য সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও শ-পাঁচেক নেতা-কর্মী আহত হন।

চক্রান্ত এখনো থামেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয়েছে ঘাতক-দালাল নির্মূল ও যুদ্ধাপরাধীদের সাজাদান প্রক্রিয়া। ভারত অবশ্য সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে থেকেছে। বঙ্গবন্ধু নিজেই ’৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লিগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বলেছিলেন, ভারতের ১৪ হাজার জওয়ান বাংলার মাটিতে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু কখনো কোনো ঔপনিবেশিক মানসিকতা ছিল না ভারতের। তাই পাক বাহিনীকে পরাস্ত করেও ভারতীয় সেনা একমুহূর্তও থাকেনি বাংলাদেশে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তবু ভারতবিরোধিতার নামে দেশটিকে দুর্বল করার খেলায় মত্ত। তাই আগস্ট শুধু শোকের মাস হিসেবেই নয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাজাকারদের ষড়যন্ত্র বানচালের ভাবনাকেও গুরুত্ব দিতে হবে আগস্টে। নইলে সর্বনাশ।

সর্বশেষ খবর