সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী ছিল অনিবার্য

শেখ হাফিজুর রহমান

করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী ছিল অনিবার্য

করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী ছিল অনিবার্য। কথাটি শোনার পর মনের মধ্যে খটকা লাগতে পারে, কেউ কেউ আমার ওপর বিরক্তও হতে পারেন। কিন্তু এটি আমার কথা নয়। বিজ্ঞানী, মহামারী তত্ত্ববিদ, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা এ কথা বলেছেন। মানব জাতির সম্মিলিত পাপের ফসল হচ্ছে করোনা মহামারী। এ পাপ পরিবেশ নষ্ট করার পাপ। এ পাপ প্রকৃতিতে বিদ্যমান ইকো সিস্টেমকে নষ্ট করার পাপ। এ পাপ প্রকৃতিকে জয় করার যে আত্মঘাতী মনুষ্য প্রচেষ্টা, সেই প্রচেষ্টায় আংশিক সফল হওয়ার পাপ। গত ৩ থেকে ৪০০ বছরের নগরায়ণ ও শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে পরিবেশের প্রতি ভয়াবহ যেসব বিপদ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে আছে-বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, গ্রিন হাউস এফেক্ট, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ওজন লেয়ারের নিঃশেষীকরণ, বন উজাড়ীকরণ ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস সাধন।

মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ, এবং নিজেদের আরাম আয়েশের পাকা বন্দোবস্ত করতে গিয়ে একের পর এক শিল্প বিপ্লব হয়ে গেছে। স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার থেকে শুরু করে বিদ্যুতের আবিষ্কার, কল-কারখানায় ব্যাপক উৎপাদন, তথ্য প্রযুক্তি ও অটোমেশন এবং সর্বশেষ সাইবার ফিসিক্যাল সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চার চারটি শিল্প বিপ্লব হয়ে গেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ও প্রযুক্তির প্রসার এবং তার হাত ধরে যে ধারাবাহিক শিল্প বিপ্লবসমূহ, নিঃসন্দেহে সেটি মানব সভ্যতার এক অনন্য অর্জন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমরা ব্যবহার করছি মানুষের আরাম-আয়েশ ও ভোগকে নিরঙ্কুশ করার জন্য। পুঁজিবাদের পুঁজি ও মুনাফা ভোগবাদের যে দৈত্যকে উসকে দিয়েছে, তাতে মানুষের লোভ গেছে বেড়ে, তৈরি হয়েছে নানা কৃত্রিম চাহিদা, ভোগ হয়ে গেছে বল্গাহীন। উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, খাল-বিল-নদী-ফুল-পাখি, সমুদ্রের রহস্যময় তলদেশ, ও নভোম-লীর সমন্বয়ে সৃষ্টিকর্তা নিপুণ কুশলতায় যে বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টি করেছেন, তার কল্যাণ নিশ্চিত করা ও ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছি না; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য। শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও উন্নয়নের ‘বাই-প্রোডাক্ট’ হচ্ছে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, পৃথিবীর গড়পড়তা উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস।

সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহ, ব্রিটেন ও উত্তর আমেরিকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার এবং শিল্প বিপ্লবের সুবাদে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছে, গড়ে উঠেছে চোখ ধাঁধানো উন্নত সব নগর। এভাবে ইউরোপ ও আমেরিকা সারা বিশ্বের সামনে উন্নয়নের একটি ‘রোল মডেল’ স্থাপন করেছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এশিয়া, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, ও ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহ উন্নয়নের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। ‘নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও উন্নয়নে’র জন্য যে মনুষ্য-উন্মত্ততা তার অভিঘাত গিয়ে পড়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপরে। বন উজাড় করে, পাহাড় কেটে, নদী-নালা ও খাল-বিল ভরাট করে, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে দেশে দেশে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে; আর পরিবেশ ও প্রকৃতি এ চাপ সহ্য করতে না পেরে সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নিচ্ছে।

গত ৩ থেকে ৪০০ বছরে মানুষের উৎপাদন ব্যবস্থা, যোগাযোগ, অবকাঠামো, শিক্ষা-গবেষণা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, যুদ্ধাস্ত্র, শিল্প, কৃষি ও চিকিৎসাব্যবস্থা এতটা উন্নত হয়েছে যে, মানুষ তার সভ্যতার কয়েক হাজার বছরে সেটি করতে পারেনি। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতার এ সৌধ নির্মাণ করতে গিয়ে মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে এবং করছে। ফলে দূষণ, উষ্ণায়ন, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি ও দাবদাহের মতো করোনা মহামারী এসে আবির্ভূত হয়েছে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে।

করোনা মহামারীর মাধ্যমে প্রকৃতি মানবজাতিকে সাবধান হতে বলেছে, বলেছে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মানুষ যে তার নিজের ধ্বংসের পথকে সুগম করছে, সেই বার্তাটি প্রকৃতি পাঠিয়েছে। এ বার্তাটি যদি বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দসহ সবাই যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে ভালো। নইলে পরিবেশ প্রকৃতিও বুঝিয়ে দেবে যে, প্রকৃতিকে জয় করতে চাওয়ার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে। ইউএন এনভাইরনমেন্ট প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন গত মার্চ মাসেই বলেছেন যে, প্রকৃতির ওপর অত্যধিক চাপ দেওয়ার কারণে করোনা মহামারীর মধ্য দিয়ে প্রকৃতি আমাদের বার্তা দিচ্ছে। এটি মানবজাতির জন্য ‘ওয়েক আপ কল’।

করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে চীনের উহান প্রদেশ থেকে, যেখানে আছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ‘ওয়েট মার্কেট’। এ পাইকারি বাজারে নানা ধরনের জীবিত ও মৃত মাছ, কচ্ছপ, মুরগি, শুয়োর, কুকুর, সাপ, গন্ধগোকুলসহ হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ও এদের মাংস কেনাবেচা হয়। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে চীনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ বা হিংস্র জীবজন্তুর কেনাবেচা এবং এসব প্রাণীদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। কেননা, বিশাল এ পাইকারি বাজারে হিংস্র প্রাণীরা মানুষের খুব কাছাকাছি চলে আসায় প্রাণীদের মধ্যকার ভাইরাস চলে আসে মানুষের মধ্যে। তারপর চীন থেকে সেটি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।

ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন জানিয়েছেন যে, এ শতাব্দীর ৭৫ শতাংশ সংক্রামক রোগ মানুষের মধ্যে এসেছে জীবজন্তুর কাছ থেকে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য বন উজাড় হচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে, নদী ভরাট করা হচ্ছে। ফলে জল ও স্থলের পশু, পাখি ও মাছেদের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর যেসব প্রাণী বেঁচে থাকছে, বনাঞ্চল সীমিত ও সংকুচিত হওয়ার কারণে তারা মানুষের কাছে সান্নিধ্যে চলে আসছে। এর ফলে মানুষের বসতি থেকে বহু দূরে বসবাসরত প্রাণীদের মধ্যে যে ভাইরাসগুলো ছিল সেগুলো চলে আসছে মানুষের মধ্যে। উল্লেখ্য, জনসংখ্যা ১০০ কোটি হতে হাজার বছর লেগেছে। কিন্তু গত ২০০ বছরে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৭ গুণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি। জনসংখ্যা এত দ্রুত বেড়েছে সংক্রামক রোগের টিকা ও ওষুধ আবিষ্কার, পাস্তুরায়ন ও প্রিজারভেটিভ দিয়ে দুধ ও অন্যান্য খাদ্য সংরক্ষণের প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার ও কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের বিপুল বৃদ্ধি ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির মাধ্যমে। পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের অনেক জমি প্রয়োজন। এ জন্য পশু-পাখি-সাপ, বাদুড় ও পোকামাকড়েরা যে বনাঞ্চলে থাকে, সেই বনাঞ্চলের বিপুল অংশ ধ্বংস করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এতে পশুপাখিরা চলে আসছে মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই মানব সমাজ একের পর এক সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ তালিকায় আছে- সার্স, বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস, ইবোলা, মার্স ও সর্বশেষ করোনাভাইরাস। এসব সংক্রামক রোগের সবই এসেছে প্রাণীদের কাছ থেকে। বিশেষ করে সার্স ও করোনাভাইরাস- এ দুটি সংক্রামক ব্যাধিরই উৎপত্তিস্থল চীন এবং এগুলো বাদুড় থেকে এসেছে বলে সংক্রামক রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন। ইবোলা খুব ভয়াবহ হলেও এটির বিস্তৃতি ছিল আফ্রিকার ৩টি দেশে। আর সার্স, বার্ড ফ্লু ও মার্স-এর বিস্তার থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দক্ষতা ও হাইটেক মেডিকেল গবেষণার কারণে। প্রকৃতি পূর্বেকার সংক্রামক ব্যাধির মধ্য দিয়ে বারবার যে বার্তা দিয়েছিল, বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দ যদি তাতে কর্ণপাত করতেন, যদি উন্নয়ন-উন্মত্ত মানব জাতি নিবৃত্ত হতো অরণ্য, নদী ও পাহাড় ধ্বংস করা থেকে, যদি বৈশ্বিক জনগোষ্ঠী নভোমন্ডল ও সাগরদূষণ কমিয়ে হ্রাস করতে পারত বিষাক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, তাহলে হয়তো আমাদের করোনা মহামারীর কবলে পড়তে হতো না। এমন বাস্তবতায় এ কথা বলা যেতেই পারে যে, করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী ছিল অনিবার্য এবং এটি হচ্ছে মানুষের লোভ, হাইটেক সভ্যতার হাই-ভোল্টেজ দূষণ ও নির্বিচারে বন্য প্রাণী হত্যা করার পরিণতি।  

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর