মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

নিঃসঙ্গবাসে জুলভার্ন হুমায়ূন আহমেদ ও ডিকেনসন

সাইফুর রহমান

নিঃসঙ্গবাসে জুলভার্ন হুমায়ূন আহমেদ ও ডিকেনসন

উড়োজাহাজ আবিষ্কারের অর্ধশতাব্দীকাল আগেই তিনি হেলিকপ্টারের কথা বলেছিলেন, রেডিও আবিষ্কারের বহু আগেই যে ব্যক্তি টেলিভিশনের কথা কল্পনা করেছিলেন, যেকালে মানুষ চাঁদে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারত না, তখনই যিনি চাঁদের বুকে বসতি স্থাপনের কথা বলে ছিলেন তিনি নিজে ছিলেন এক ঘরকুনো মানুষ। কল্পবিজ্ঞানের ওপর বিশ্বের সর্বপ্রথম রচিত ও সর্বাধিক সাড়া জাগানো গ্রন্থসমূহের লেখক জুলভার্ন। যে লেখকের নায়করা বিশ্বব্যাপী, আকাশে-পাতালে ভ্রমণ করেছেন অথচ নিজে কখনো ঘরের বাইরে পা দেননি, যিনি ৪০ বছর কাটিয়েছিলেন নির্জন চিলেকোঠায়।

এই আশ্চর্য মানুষ জুলভার্নের জন্ম হয়েছিল ১৮২৮ সালে ফ্রান্সের নানাতেস (Nantes) নামক স্থানে। বাবা ছিলেন আইনজীবী। তাই তাঁর ইচ্ছা ছিল তাঁর ছেলেও আইন ব্যবসা করে দুই পয়সা উপার্জন করতে শিখুক, সুখে থাকবে। কিন্তু জুলভার্নের আইন পড়ার দিকে তেমন আগ্রহ ছিল না। আইন পড়ার চেয়ে তিনি মনোযোগ বেশি দিতেন সাহিত্যচর্চার দিকে। এতে বাবা ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়ে অপদার্থ ছেলের মাসিক ভাতা দিলেন বন্ধ করে। অনেক কষ্টে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন জুলভার্ন। লেখালেখি করে একসময় অঢেল অর্থবিত্তের অধিকারীও হয়েছিলেন। জুলভার্নের হাতে তখন অনেক টাকা। তাই তিনি এবার চলে এলেন প্যারিস থেকে অ্যামিয়েনে। সেখানে এসে তৈরি করলেন সুন্দর ও মজার নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত একটি বাড়ি। প্রকান্ড এই উচ্চ অট্টালিকার ওপরে নির্মিত হলো একটি কক্ষ। সে কক্ষটি দেখতেও অবিকল নাবিকদের কেবিনের মতো। আসলে এটাও ছিল একটি চিলেকোঠা। যে চিলেকোঠায় তিনি আবদ্ধ থেকেছেন সারা জীবন। এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁর জীবনের শেষ ৪০টি বছর। আরেক ঘরকুনো বিখ্যাত মানুষ ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় অভিহিত। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে নির্জনতম কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি। জীবনানন্দ যে কী রকম ঘুরকুনো ছিলেন সে সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশের লেখা থেকে। তাঁর লেখা ‘মানুষ জীবনানন্দ’ বইতে তিনি লিখেছেন- জীবনানন্দ সমস্ত দিন ঘরে বসে টেবিলে মুখ গুঁজে লিখতেন। তাঁর সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ছিল লেখালেখি। লাবণ্য দাশ একটি স্কুলে পড়াতেন। সেই সঙ্গে নাটক-নভেল-থিয়েটার প্রভৃতি নানা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। নাটকের রিহার্সেল শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক সময় বেশ রাত হয়ে যেত। বাড়ি ফিরে দেখতেন জীবনানন্দ লেখাতেই ব্যস্ত। লাবণ্য দাশের সঙ্গে বিয়ের আগে কনে দেখার দিন লজ্জায় লাবণ্যকে তেমন কোনো প্রশ্নই করতে পারেননি জীবনানন্দ। শুধু লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- আপনার নাম কী। আইএতে কী কী সাবজেক্ট নিয়েছেন এবং কোনটি আপনার বেশি পছন্দ, এতটুকুই। এই হলো জীবনানন্দ। এই জীবনানন্দই কৈশোরে প্রেমে পড়েছিলেন। যদিও তাঁর প্রেম ছিল একতরফা। লজ্জায় প্রেমের কথা প্রেমিকাকে বলতেও পারেননি। জীবনানন্দের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বরিশাল শহরে। তরুণ জীবনানন্দ প্রেমে পড়েছিলেন চাচাতো বোন শোভনা দাশের। কাকা অতুলচন্দ্র দাশের বাড়িটি ছিল কবির বাড়ির লাগোয়া। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভালোবেসে গেছেন তাঁকেই। হয়তো সমাজে লোকলজ্জার ভয়ে মুখ ফুটে কোনো দিন কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। তবে দিনলিপির পাতায় পাতায় বন্দী করে রেখে গেছেন সেই অস্ফুট দুঃখগুলোর কথা। জীবনানন্দ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর উদ্ধার করা দিনলিপির পাতায় পাতায় ‘ণ’ নামে কোনো এক মেয়ের নাম লেখা আছে। দিনলিপিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জীবনানন্দ তাঁর দিনলিপিতে সংক্ষেপ ব্যবহার করতেই পছন্দ করতেন। তাই শুরুতেই লিখে নিয়েছিলেন ‘ণ=শচী’। জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহের মতে এই শচী-ই ছিলেন শোভনা।

শোভনা ছিলেন তরুণ জীবনানন্দের মুগ্ধ পাঠক ও শ্রোতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবি তাঁর নিজের কবিতা পড়ে শোনাতেন শোভনাকে। নিতান্ত অখ্যাত এক তরুণ থেকে বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি হয়ে ওঠার দিনগুলোয় শোভনা ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। ১৯২৭ সালে কলকাতার ৯০/২ এ হ্যারিসন রোড থেকে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ শোভনাকেই উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। কোনো কোনো জীবনানন্দ-গবেষকের মতে, এ শোভনাই ছিলেন বনলতা সেন! জীবনানন্দ নয় শোভনাকে বরং বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল অন্য একটি ছেলের সঙ্গে। অন্যদিকে ১৯৩০ সালে লাবণ্যপ্রভা দাশের সঙ্গে বিয়ে হয় জীবনানন্দের।

এ পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত মানুষের স্বভাবচরিত্রের সঙ্গে তিন সাগর বার নদীর ওপারের কোনো এক বিখ্যাত মানুষের আচার-আচরণের কীভাবে যেন হুবহু মিলে যায়। কবি জীবনানন্দের মতো জুলভার্নও ভালোবেসেছিলেন তাঁর চাচাতো বোন ক্যারোলিনা ট্রনসনকে। ক্যারোলিন অবশ্য জুলভার্নের চেয়ে বছর দেড়েকের বড় ছিলেন। জুলভার্নও জীবনানন্দের মতো ক্যারোলিনাকে উদ্দেশ করে কবিতা লিখতেন এবং সেই সঙ্গে নিয়মিত তাঁকে পড়ে শোনাতেন তাঁর কবিতা। এমনকি কিছু কবিতা ক্যারোলিনাকে উৎসর্গ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু লজ্জায় জুলভার্ন কোনো দিন ভালোবাসার কথা তাঁকে জোর দিয়ে বলতে পারেননি। ক্যারোলিনাও জুলভার্নের ভালোবাসার প্রতি সাড়া দেননি। ১৮৪৭ সালে জুলভার্নের বয়স যখন ১৯ বছর ক্যারোলিনার তখন ২০। ক্যারোলিনা তাঁর চেয়ে ২৪ বছরের বড় এক লোককে বিয়ে করেন। জুলভার্ন যেন তাতে ভগ্নহৃদয়ে পতিত হলেন শোকের সাগরে।

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদও ছিলেন গর্তজীবী লেখক। হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক যিনি জীবনে যা চেয়েছেন তা-ই পেয়েছেন, যা চেয়েছেন তা-ই করেছেন। রাজা হতে চেয়েছেন, রাজা হয়েছেন। বাদশাহি উপভোগ করতে চেয়েছেন, উপভোগ করেছেন। পৃথিবীর খুব কম লেখকই জীবনে এত ভোগবিলাস করার সুযোগ পান। খুব কম লেখকই জীবনে তাঁর যাবতীয় স্বপ্নকে সফল করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলেছেন- জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন শরৎচন্দ্রের চেয়ে বড়। মেরিটের দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন নিমাই ভট্টাচার্য্যরে সমান। আর হুমায়ূন আহমেদের নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন হচ্ছে- ‘আই অ্যাম রাইটিং ফর বাজার।’

হুমায়ূন আহমেদের একটা বড় সীমাবদ্ধতা ছিল তাঁর লাজুকতা। নিজেকে ‘গর্তজীবী’ বলার মধ্যে কি আমরা মিসির আলির মতো রহস্যের গন্ধ পাই না? আজকালের লেখকরা তাঁদের লেখা নিয়ে যেভাবে প্রচার করেন, সমানে কলাম লেখে কিংবা টকশোয় মুখ দেখাতে, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে মুখিয়ে থাকেন, তিনি কিন্তু ছিলেন ভীষণ প্রচারবিমুখ।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন হুমায়ূন আহমেদকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি বহুদিন ধরে টিভিতে, পত্রপত্রিকায়, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী। আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান?

উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন- ‘শোনো! এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালেখি জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে বেশির ভাগ সময়। তা ছাড়া হয়েছে কি, মানুষ তো গাছের মতো। গাছ কী করে। শিকড় বসায়। প্রতিটি মানুষেরই শিকড় আছে। আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত যে শিকড় আছে, সেগুলো ছিঁড়ে গেছে।’

এ তো গেল হুমায়ূন আহমেদের কথা। আরেক বিখ্যাত ঘরকুনো লেখক ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জন্ম ১৯১২ সালের ২০ আগস্ট কুমিল্লায়। যৌবনে তিনি সাহিত্যচর্চার জন্য স্থায়ীভাবে চলে যান কলকাতায়। জ্যোতিরিন্দ্রের লেখার অনুরাগী ছিলেন বেশকিছু বিখ্যাত লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে অভিহিত করেছেন লেখকদের লেখক হিসেবে। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন- তাঁর লেখা পড়ে লিখতে শেখা যায়। বর্তমান সময়ের শ্রুতকীর্ত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে বলেছেন- ছোটগল্প লেখায় মাস্টারপিস লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। তাঁর বিখ্যাত দুটো উপন্যাস ‘মিরার দুপুর’ ও ‘বারোঘর এক উঠোন’। এ ছাড়া তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ‘গিরগিটি’, ‘সিদ্ধেশ্বরের মৃত্যু’, ‘বন্ধুপত্নী’ প্রভৃতি কালজয়ী কিছু গল্প। সমবয়সী অন্য শিশুদের মতো ছোটবেলায় হইহই করে খেলাধুলা করা, বায়না ধরার ধাত জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মোটেও ছিল না। ছিল না মেলায় যাওয়ার উৎসাহ বা পুজোর সময় তিতাসের বুকে ভাসান অথবা পয়লা ভাদ্রে নৌকোদৌড় দেখার কোনো আগ্রহ। ভালো লাগা কাকে বলে, ভালো দৃশ্য কী- সেই কচি বয়সেই টের পেয়েছিলেন তিনি! ঘরে বসে বই পড়া আর আঁকাআঁকি এ ধরনের সৃজনকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বালক জ্যোতিরিন্দ্র।

সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার আর জ্যোতিরিন্দ্র ছিলেন সমসাময়িক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জ্যোতিরিন্দ্র সম্পর্কে লিখেছেন- কমলকুমার সেই সময় ছিলেন ডাকাবুকো ধাতের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ, আর জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ঘরকুনো, বর্ণচোরা ধরনের। দেশ পত্রিকার আমাদের সেই কার্যালয়ের উল্টোদিকে একটি নতুন চায়ের দোকান খুলল, সেখানে পরিবেশনকারিণী তিন-চারটি মেয়ে। কলকাতায় তখন এ রকম একটি হুজুগ উঠেছিল। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আমায় একদিন বললেন, তোমায় একটা টাকা দিচ্ছি, তুমি ওই দোকানে গিয়ে চা আর কাটলেট খেয়ে একটু দেখে এসো তো, মেয়েগুলো কী করে? আমি সরলভাবে বললুম, আপনিও চলুন না! উনি প্রায় কুঁকড়ে গিয়ে বললেন, না না, আমার চা সহ্য হয় না। বাইরের খাবার খাই না। তা ছাড়া ওইসব মেয়ে-টেয়ে, বুঝলে, তোমার কম বয়েস, তুমি বরং, বুঝলে...। সেই চায়ের দোকানে শেষ পর্যন্ত জ্যোতিদা বা আমি কেউই যাইনি, দোকানটিও অবিলম্বে উঠে যায়। কিন্তু চায়ের দোকান নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী অবিস্মরণীয় একটি গল্প লিখেছেন তার কিছুদিন পরেই। নিঃসঙ্গ কবিদের মধ্যে সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ নিঃসঙ্গ কবি ছিলেন এলিজাবেথ ডিকেনসন। আশ্চর্য কবি। দেড় হাজার থেকে সতের শ কবিতা লিখেছেন ছাপ্পান্ন বছরের জীবনে, কিন্তু জীবিতকালে ছাপা হয়েছে মাত্র গোটা সাতেক কবিতা। তাও কবির নাম ছাপা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় সত্তর বছর পরে প্রামাণ্য কাব্য সংকলন ও পত্র-সংকলন বেরিয়েছে। যত দিন বেঁচে ছিলেন তত দিন নিজের লেখা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। বাড়ির লোকে পর্যন্ত বুঝতে পারেনি একজন কবির জন্ম হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। টুকরো কাগজে, খাবারের ঠোঙায়, হিসাবের খাতায় ছোট ছোট পদ্য চোখে পড়ত। কিন্তু বাবা, ভাইবোন, কেউ গুরুত্ব দেয়নি ডিকনসনের সেসব লেখায়। কবি নিজেও দেননি। কবিতা লেখা হয়ে গেলে কাগজের টুকরোটা গোল করে পাকিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে টেবিলের দেরাজের মধ্যে রেখে দিতেন। মৃত্যুর আগে ছোট বোনকে বলে গেলেন, এ কাগজগুলো পুড়িয়ে ফেলো। পোড়াতে গিয়ে ঘাবড়ে গেল বোন ল্যাভিনিয়া। এ যে এক বিরাট স্তূপ! কী আছে এর মধ্যে? দু-এক জন বন্ধুকে ডেকে দেখালেন ল্যাভিনিয়া। তাদের পড়ে ভালো লাগল, এক কবির জীবনব্যাপী সাধনার ফল রক্ষা পেল আগুনের হাত থেকে। এলিজাবেথ ডিকেনসন গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, রবার্ট ফ্রস্ট, কামিংস্, অ্যামি লাওয়েলসহ আরও বহু কৃতসিদ্ধ কবি তাঁর রচনা থেকে প্রেরণা পেয়েছেন। ডিকেনসনের প্রভাব পড়েছে তাঁদের কবিতার ওপর। ডিকেনসনের কবিতা বিষয়ে একজন সমালোচক বলেছেন, এঁকে একদিক থেকে লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। দুজনই এমনভাবে লিখেছেন যেন এঁদের আগে কেউ কবিতা লেখেননি। অর্থাৎ, ডিকেনসন প্রচলিত কাব্যরীতির ঐতিহ্য অনুসরণ করেননি, পূর্বসূরিদের প্রভাব পড়েনি তাঁর রচনায়। তাঁর রচনা তাই মৌলিক, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কোনো কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না যে আলোচনা করে কাব্যরীতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল হবেন। ১৮৭৪ সালে এলিজাবেথ ডিকেনসনের পিতা এডওয়ার্ড ডিকেনসন হঠাৎ বোস্টন শহরে মারা যান। তার পর থেকেই ডিকেনসনের জীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। মৃত্যু পর্যন্ত এলিজাবেথ ডিকেনসন বাড়ির গেট পেরিয়ে বাইরে পা বাড়াননি। ১২-১৩ বছর বাড়িতে বসে বই পড়েছেন, কবিতা লিখেছেন, আর কখনো ইচ্ছা হলে বাগানে একটু বেড়িয়েছেন। অতিথি-অভ্যাগত বাড়িতে এলে কদাচিৎ তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন। নিঃসঙ্গতাই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। নিঃসঙ্গতা উপভোগ করার ক্ষমতা না থাকলে হয়তো তাঁর জীবনটা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠত। তিনি লিখেছেন- I might be lonelier/Without the loneliness. বাস্তব জীবনে কাউকে পেতে চাননি। নিঃসঙ্গতাই ছিল তাঁর বিলাস। অথবা, হয়তো, নিজের চেহারা নিয়ে হীনমন্যতার ভাব ছিল। পাছে এজন্য কেউ প্রত্যাখ্যান করে সে ভয়ে কোনো পুরুষের নৈকট্য কামনা করেননি। ১৭ বছরের একটা ছবি আছে; আর কোনো প্রতিকৃতি করাননি ডিকেনসন। অথচ তখনকার দিনে আমহার্স্ট শহরে ভ্রাম্যমাণ শিল্পীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন ছবি আঁকার জন্য।

এমিলি জানতেন তাঁর চোখ-মুখ দেখতে ভালো নয়। তাই কোনো অতিথি বাড়ি এলে ফুল হাতে করে দেখা করতেন। হয়তো ভাবতেন তাহলে অতিথির চোখ যাবে সুন্দর ফুলের ওপর; তাঁর অসুন্দর মুখ ঢাকা পড়ে যাবে। এ বিষয়ে তিনি নিজেই বলছেন- I take a flower as I go,/My face to justify./He never saw me in this life-/I might surprise his eye! এ কথা আমি আগেই বলেছি, বরেণ্য কোনো মনীষীর জীবনের ঘটনার সঙ্গে আরেক মনীষীর জীবনের ঘটনা আশ্চর্য ও কাকতালীয়ভাবে কীভাবে যেন হুবহু মিলে যায়। ডিকেনসনের উপরোক্ত ঘটনার সঙ্গেও সমাপতনভাবে মিলে যায় বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জীবনের একটি দিকের। ডিকেনসনের মতো জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীও দেখতে ভালো ছিলেন না। বিয়ে করার জন্য পারুল দেবীকে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী যখন দেখতে গিয়েছিলেন তখন সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গণেশ দত্তকে। গণেশবাবুর গায়ের রং ছিল মিশমিশে কালো। বিয়ের পরে জ্যোতিরিন্দ্র পারুল দেবীকে বলেছিলেন- ও পাশে থাকলে আমায় দেখতে একটু ভালো লাগবে সেটা ভেবেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম গণেশকে। সে যাই হোক, এঁরা ছাড়া আরও বহু লেখক-সাহিত্যিক ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকেই সাহিত্যচর্চা করতে বোধকরি বেশি পছন্দ করতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাঁকে পুর্ণিয়া জেলার উইলিয়াম ফক্নার বলে সম্বোধন করতেন সেই প্রণম্য লেখক সতীনাথ ভাদুড়ী, অমিয়ভূষণ মজুমদার, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি লেখক সাধারণত সভাসমিতি, বক্তৃতা ও লোকসমাগমে তেমন একটা যেতেন না। গল্প কেন লিখলাম? এ নামে জগদীশচন্দ্র গুপ্তের একটি রচনা আছে তাতে তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন যে, তাঁর স্ত্রীর তাড়না থেকে বাঁচার জন্যই তিনি কলম ধরেছেন। তাঁর স্ত্রী তাকে চুপ করে ঘরে বসে থাকতে দেখলেই হাতে পয়সা দিয়ে বলতেন বাজার থেকে ধনে কিংবা কাঁচালঙ্কা কিংবা পান কিংবা সোডা কিংবা মউরি কিনে আনতে। অনবরত বাজারে ছোটা এবং বউয়ের ফরমাশ খাটা এড়ানোর জন্যই তিনি কলম হাতে নিয়ে লেখার ভান করতেন। ভান করতে করতে একদিন গল্প লিখে ফেললেন। এটা বেশ একটা ভালো ধরনের রসিকতা বটে। কিন্তু এ কাহিনির পেছনের ম্যরাল হচ্ছে যে কোনো উপায়ে লেখক যে ঘরে আবদ্ধ থাকতে চান সেটাই কিন্তু এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতঃস্মরণীয় ফরাসি লেখক ভিক্তর হুগো ও গুস্তাভফ্লবের জীবনের অনেকটা সময় ঘরকুনো হয়ে কাটিয়েছেন। বিশেষ করে ফ্লবেরের শেষ জীবন একচ্ছত্রভাবে কেটেছে নিজের ঘরে। ভিক্তর হুগো তো রীতিমতো প্রকাশকের তাড়া খেয়ে রাতদিন ঘরে বসে লেখার জন্য নিজের সব পরিধেয় বস্ত্র অন্যত্র আটকে রেখে শরীরে শুধু ধূসর রঙের একটি শাল গায়ে জড়িয়ে লিখতে বসতেন, যাতে ইচ্ছা করলেই যেন ঘরের বাইরে বেরোতে না পারেন। সে এক আশ্চর্য ইতিহাস। সময়-সুযোগ হলে অন্য কোথাও লিখব এ নিয়ে। লেখার অন্তিমক্ষণে শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত উক্তিটির কথা মনে পড়ে। যিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘বাইরে এমন কিছু লোভনীয় নেই যা আমাকে প্রলুব্ধ করতে পারে।’ তো করোনাকালে আপনারা যাঁরা ঘর থেকে বেরোতে উন্মুখ হয়ে আছেন তাঁদের বলছি, মহান সেই মানুষগুলো কিন্তু ঠিকই পেরেছিলেন ঘরে থাকতে শুধু আপনিই পারছেন না।

লেখক : সুপ্রিক কোর্টের আইনজীবী।

Email : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর