মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ষড়যন্ত্র কিনা খতিয়ে দেখা দরকার

আলম রায়হান

ষড়যন্ত্র কিনা খতিয়ে দেখা দরকার

ঢাকায় ১৯৭৯ সালে পেশাগত জীবনের ভীরু সূচনায় দেশের রাজনীতি এবং অপরাধ বিষয়ে ধারণা হয়েছে মোটামুটি। যদিও তখন মনে করতাম, আমি সব জানি। একটি কথা আছে না, সবজান্তা শমশের। আমার অবস্থাও ছিল অনেকটা তাই। এই মূর্খ প্রবণতার একটি সুবিধাও ছিল। অর্বাচীন বালকের বালখিল্য আচরণে নেতারা বিরক্ত হতেন। ভিতরে ভিতরে রাগতেনও হয়তো। আর রাগলে মানুষের সত্য কথার হার বাড়ে। এ সুবিধা আমি পেশার শুরুতে পেয়েছি। আমার এ অগ্রহণযোগ্য আচরণে খন্দকার মোশতাক ছাড়া কেউ প্রকাশ্যে চটেননি। সাংবাদিক বলে কথা! তা যতই ছোট হোক। অবশ্য সে অবস্থা এখন আর নেই। এখন বড় বড় অনেক সাংবাদিক হালে পানি পাচ্ছেন না। যদিও তাদের কথাবার্তা-আচরণে প্রায়ই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সেই অমর লেখার কথা মনে পড়ে। তেল। তবু কথিত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। এদিকে সাংবাদিকের ‘আন্ডাবাচ্চায়’ ভরে গেছে সারা দেশ। অনেক কাক আবার ময়ূরপুচ্ছ পরে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। কাজেই সাংবাদিক মানে প্রায় ক্ষেত্রেই নানান বিশেষণের পাত্র হয়ে গেছে। আমাদের শুরুতে দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। সে সময় বর্তমান ধারার ধারক দু-চার জন যারা ছিলেন অথবা ছিল, তাদের ছিল ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা ছোট ইঁদুরের মতো অবস্থা; প্রকাশ্যে আসার সাহস পেত না। আমার আজকের প্রসঙ্গ পুলিশ। পুলিশকাহন। এ শিরোনামে অনুপ্রাণিত হয়েছি নবনীতা চৌধুরীর উপস্থাপনায় রাজকাহন দেখতে দেখতে। যদিও ‘কাহন’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ মোটেই ইতিবাচক মনে হয় না আমার। সাংবাদিকতার শুরুতে মাস কয়েক ডেস্কে কাজ করার পর অস্থির হয়ে ১৯৮০ সালে রিপোর্টিং শুরুর লগ্নে আমার বিট ছিল রাজনীতি ও অপরাধ। তখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের থিংক ট্যাংকের কুশীলবরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরো দেশ। ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতি ছিল সামরিক শাসকের বুটের নিচে। সভা-সমাবেশ ছিল সীমিত। তবে ঘরের রাজনীতি ছিল বেশ চাঙ্গা! রাজনীতিক কেনাবেচার হাট বসিয়েছিলেন বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসক। সে সময়ের বাস্তবতায় রাজনীতির ভিতরের খবর কম পরিশ্রমে বেশি পাওয়ার সুযোগ ছিল। সামরিক শাসকের ঘরোয়া রাজনীতিকালে কোয়ারেন্টাইন চলমান ছিল চলমান করোনাকালের মতো। রাজনীতির যোদ্ধারা ঘরে। কিন্তু কেউই অলস বসে ছিলেন না। সে সময় ঘরে বসা নেতাদের অনেক রূপ দেখেছি! কক্সবাজারের টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা গুলিতে নিহত হওয়া এবং পরবর্তী ঘটনাবলি, জাতীয়ভাবে উদ্বেগজনক এবং মর্মান্তিক এ ঘটনার প্রথমেই হোঁচট খেলাম গণমাধ্যমে সংবাদের প্লাবন দেখে। মনে হলো, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা এত খবর জানল কীভাবে! কেবল তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, রিপোর্টার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় হোঁচট খাবার ঘটনা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জেলার এসপির দায়দায়িত্ব নির্ধারণে রাষ্ট্রের দীর্ঘসূত্রতা এবং ঝিমুনিপ্রবণতা। ৮ আগস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জেনেছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তদন্তে কক্সবাজারের এসপির বিষয়ে কিছু পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ মন্তব্য নিয়ে এ পর্যায়ে আমার কোনো মন্তব্য  শোভন নয়। কারণ কী হবে কী হবে না, তা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পক্ষে খোলাসা করে বলা সম্ভব নয়। তবে বিরাজমান আইনের আলোকে আমার কিছু নিবেদন আছে। আমজনতা হিসেবে যতটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছি তাতে কেবল কক্সবাজারের এসপি নন, দায় আছে ডিসিরও। পুলিশ  আইনে ওসি প্রদীপের কাছে ওপরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে এসপির করণীয় এবং তার ওপরের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে বলা আছে। এটি আমার মনে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জেনেছি, ওসি প্রদীপের ব্যাপারে করণীয় ছিল কক্সবাজারের ডিসির, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে; যা সব জেলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যদিও সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান পুলিশ প্রশাসনের শৃঙ্খলার মূলে কুঠারাঘাত করে গেছেন। এর সঙ্গে আরও অনেক উপদ্রব যুক্ত হয়ে যার হাতে ট্রিগার, তার হাতে ক্ষমতা চলে গেছে। এর পরও আইনের এখনো যে এখতিয়ার বিরাজমান তা প্রশাসনের কর্তারা প্রয়োগ করেন বলে তো মনে হয়। আর কে না জানে, আইনে দেওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ না করা কেবল অযোগ্যতা নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধও। সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের কাছে আমার বিনীত নিবেদন - বিরাজমান আইনে এসপি মাসুদ ও ওসি প্রদীপের ঘটনার বিষয়ে গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হোক। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক ঘটনার নেপথ্যে ’৭৫-এর থিংক ট্যাংকের কারসাজি থাকতে পারে। মজ্জাগত এই রকম একটি ধারণা থেকে ১০ আগস্ট আমি এসপি মাসুদকে ফোন করেছিলাম। তিনি আমার পূর্বপরিচিত। কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম তিনি পুলিশ বিভাগের চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে কোনো ব্যাংকে চাকরি করেছেন কিনা। সঙ্গে সঙ্গে চটে গেলেন। কঠিন গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘এসব খবর পান কোথায়!’ তার আচরণে ‘ভড়কে’ গেলাম। তিনি বললেন, ‘একটি মিটিংয়ে আছি, পরে ফোন দিচ্ছি।’ এসপি আর ফোন দেননি। তার প্রতিক্রিয়ায় নিশ্চিত হলাম, এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাচ্ছেন না। তবে আমি মনে করি, পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ চাকরি পাওয়ার আগে মাসুদ সাহেব কোনো ব্যাংকে চাকরি করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া জরুরি। কেননা কেবল আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, জামায়াতের যে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে হলে যা যা প্রয়োজন হয় তা দিগন্ত টেলিভিশনে চাকরিপ্রার্থীর অনেকের অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছি। আর সবাই বোঝেন, দিগন্ত টিভির তুলনায় ব্যাংক তো হিমালয়সম। কাজেই খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। একই সময় খোঁজখবর করা প্রয়োজন ওসি প্রদীপের নিচে যে এত অন্ধকার জমা হলো তারই বা রহস্য কী!

তিনি কি বেপরোয়া খুনের নেশায় মেতেছিলেন কেবল টাকা কামাবার জন্য, নাকি প্রদীপের পেছনে অন্য কলকাঠি সক্রিয় ছিল, ছিল ষড়যন্ত্র। মনে রাখা প্রয়োজন, ষড়যন্ত্র কেবল ব্যক্তি বা সরকারের বিরুদ্ধে হয় না, ষড়যন্ত্র হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। এ অঞ্চলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আর ব্রিটিশের আগমন, মোগল সাম্র্রাজ্যের পতন, এলোমেলোভাবে ভারত বিভাজন, ’৭১-এ পাকিস্তানের নির্মমতা এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্বরতম হত্যাকান্ড তো ইতিহাসের বিচারে এই সেদিনের ঘটনা!

               লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর