বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

২৬ বছরের নির্বাসন, আজও পায়ের তলায় মাটি নেই

তসলিমা নাসরিন

২৬ বছরের নির্বাসন, আজও পায়ের তলায় মাটি নেই

ঠিক ২৬ বছর আগে, এই অগাস্ট মাসে, আমাকে আমার দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল আমার দেশের সরকার। আমি কি চুরি ডাকাতি খুন ধর্ষণ বা কোনও রকম অপরাধ করেছিলাম? না, আমি শুধু বই লিখেছিলাম। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাক স্বাধীনতা, মানবতা, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকারের কথা লিখেছিলাম সেই সব বইয়ে। সব রকম বৈষম্য, অন্যায় আর অত্যাচার বিদেয় করে সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখছিলাম। ২৬ বছরে সরকার বদল হয়েছে বহুবার। আমাকে আমার দেশে কোনও সরকারই ফিরতে দেননি, কেন ফিরতে দিচ্ছেন না, সে বিষয়েও কিছু জানাননি।

এই ২৬ বছরের প্রথমদিকে ইউরোপ আর আমেরিকায় কাটিয়েছি এক যুগ। কিন্তু দেশে ফেরার আকুলতা আমার এত তীব্র ছিল যে দেশের দরজা বন্ধ বলে দেশের স্বাদ গন্ধ রূপ রস পেতে পশ্চিমবংগে যাতায়াত শুরু করলাম। বাংলা ভাষাই আমার দেশ। তাই বাংলা ভাষা আর বাংলা সংস্কৃতির পরিবেশ পেতে বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবংগকেই বেছে নিয়েছি বাস করার জন্য। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে তো বাস করা সম্ভব নয়। পাকাপাকিভাবে বাস করার অনুমতি মিলে গেল একদিন। ভারতের রেসিডেন্স পারমিট পেলাম, যেটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে মেয়াদ বাড়ানো যায়। ২০০৫ থেকে বাস করতে শুরু করেছি ভারতবর্ষে। প্রথমদিকে ৬ মাস করে বাড়ানো হতো আমার রেসিডেন্স পারমিট, এরপর ২০০৮ থেকে ১ বছর করে বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবছর আবেদনের এই ঝামেলাটি না করে ৫ বা ১০ বছর মেয়াদের রেসিডেন্স পারমিট দিয়ে দিলেই হয়! একবার তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, আমাকে নাকি ৫০ বছর মেয়াদের ভিসা দেবেন। বলাই সার। দেননি। ওই ১ বছর করে করেই বাড়িয়েছেন আমার রেসিডেন্স পারমিট। অনেক বিদেশি নাগরিক কিন্তু ভারতে পাকাপাকিভাবে বাস করছেন এভাবে দীর্ঘমেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে। আমার জন্য রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ ১ বছর করে বাড়ানো হলেও অনেকের পারমিট ৫ বা ১০ বছর করে বাড়ানো হয়।

সিপিএম যখন মুসলিম মৌলবাদীদের তুষ্ট করতে ২০০৭ সালে আমাকে পশ্চিমবংগ থেকে বের করলো, যখন কেন্দ্রের ইউপিএ সরকার আমাকে দিল্লির ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দী করে রেখে ক্রমাগত চাপ তৈরি করে আমাকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করলো ২০০৮ সালে, তারপর থেকে ২০১১র আগ অবধি আমাকে ভারতে রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়িয়েছে কিন্তু ভারতে বাস করতে দেয়নি, তখন কত মানুষ আমাকে বলেছে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তোমার আর রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না, তোমাকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে, তুমি কলকাতায় থাকতে পারবে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আকাশ থেকে পড়েছি যখন ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসে আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ ১ বছর থেকে কমিয়ে ২ মাস করে দিয়েছিলো। আর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই আবার ১ বছর থেকে কমিয়ে ৩ মাস করে দিয়েছে। আমি জানি না কী কারণ এর। বিজেপি সরকার কি আমার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে চাইছে? ওই ২ বা ৩ মাস কীসের সংকেত আমি জানি না। কলকাতায় বাস করার ব্যবস্থাও তো কেউ করে দেয়নি। পশ্চিমবংগে আজও আমি নিষিদ্ধ, ঠিক বাংলাদেশে যেমন নিষিদ্ধ।

মনে আছে পশ্চিমবংগ থেকে বামফ্রন্ট সরকার আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘ওরা যদি তসলিমাকে নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে তসলিমাকে গুজরাটে পাঠিয়ে দিক, আমি দেব নিরাপত্তা’। নির্বাচনী প্রচারের সময় কলকাতায় গিয়ে আমাকে কলকাতা থেকে কেন তাড়ানো হলো, সিপিএম গিয়ে তৃণমূল আসার পরও আমাকে কলকাতায় ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। ভারতে খুব কম রাজনীতিকই মোদিজির মতো জনগণের সামনে জোর গলায় সমর্থন করেছেন আমাকে। রাজনীতির ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হলেও আমার মতো নির্যাতিত নির্বাসিত সত্যিকার সেক্যুলার লেখককে কোনও দ্বিধা না করে সমর্থন করায় মোদিজির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থেকেছি। তিনি ক্ষমতায় এলে বছর বছর রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবো ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম ভারতে পাকাপাকি থাকার অনুমতিপত্র পেয়ে যাবো, নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় বাকি জীবন সাহিত্য রচনা করে যাবো। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় আসার পর আমার সমস্যা আগের মতো তো রয়েই গেছে। নিশ্চিন্তির বদলে, বসবাসের মেয়াদ কমিয়ে ২ মাস বা ৩ মাস করার পর দুশ্চিন্তাই বরং বাড়ছে। আমি তো কোনও অন্যায় করছি না। নিজের মতো করে আদর্শের কথা লিখি, এই সমাজের মেয়েদের শিক্ষিত, স্বনির্ভর আর সমানাধিকারের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার প্রেরণা দিই। সুইডেনের নাগরিক হয়েও, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাসিন্দা হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও আমি ভারতকে বেছে নিয়েছি বাস করার জন্য। কারণ ভারতের একটি ভাষায় আমি কথা বলি, আমি লিখি, আমি ভাবি, আমি স্বপ্ন দেখি। ভারতই দেখতে আমার দেশের মতো দেশ। ভারতই এই উপমহাদেশের একমাত্র দেশ, যে দেশে আমি বাস করতে পারি। এই উপমহাদেশের মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় বাস করার সুযোগ পাওয়ার জন্য মরিয়া। আর আমি এই দেশকে ভালোবেসে ইউরোপ আমেরিকা ত্যাগ করেছি। বিদেশের যশ খ্যাতি নিরাপত্তা নিশ্চিন্তি সব তুচ্ছ করে আমি ভারতের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছি। নির্বাসনের ২৬ বছর পার হওয়ার পরও যে দেশে আমি বাস করতে চাইছি, গত ১৫ বছর যাবৎ বাস করছি, এখনও চমকে চমকে উঠতে হয়, যখন আমার বসবাসের মেয়াদ আচমকা কমিয়ে দেওয়া হয়। কমতে কমতে আবার কবে শূন্যে এসে দাঁড়ায়, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়।

অনেকে মনে করে আমাকে বুঝি ভারত সরকার খাওয়াচ্ছেন পরাচ্ছেন, সরকারের অতিথি আমি। ভুল ভাবনা। আমি নিজের টাকায় থাকি, খাই, পরি, এবং বছর বছর ট্যাক্স দিই। মন্ত্রীদের কারও সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। কোনও প্রভাবশালী কাউকে আমি চিনি না। আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, সাধারণ জীবনযাপন করি। সাধারণ মানুষের সংগে মিশি। সাধারণ মানুষের ভিড়েই আমার চলাচল। যেহেতু নিজের দেশটি ২৬ বছর আগে দূরে সরে গেছে, সেই দেশের দরজা আমার জন্য চিরকালের জন্য বন্ধ, তাই নিজের দেশের মতো দেখতে দেশ, ভারতই আমার দেশ। এই দেশকে পরদেশ বলে কখনও আমার মনে হয়নি। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সংগে কোনও দেশের সংস্কৃতির যদি মিল থাকে, সে ভারতই। বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকত্ব পেলে, বা আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সবুজ কার্ড পেলে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আমি কিন্তু সব থাকা সত্ত্বেও ভালোবেসে নিজের দেশে বাস করতে চাই, সেটা সম্ভব নয় বলে বসবাসের জন্য প্রতিবেশী দেশকে বেছে নিয়েছি। ভালোবাসার মূল্য বাংলাদেশ দেয়নি। ভালোবাসার মূল্য যদি সামান্যও থাকে ভারতবর্ষের কাছে, তবে এ দেশে বসবাস নিয়ে আমার আর সমস্যা হবে না। মুশকিল হলো, আমি রাজনীতি বুঝি না, যদিও রাজনীতির শিকার হয়েছি জীবনভর।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর