শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

লে. জেনারেল রবার্ট বেডেন-পাওয়েল

ড. নিজামউদ্দিন আহমেদ

লে. জেনারেল রবার্ট বেডেন-পাওয়েল

যে কোনো গণআন্দোলন অস্থির বেগমাত্রা দ্বারা চালিত। তাই ৭ জুন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ প্রতিবাদকারীরা যখন যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে সপ্তদশ শতাব্দীর ক্রীতদাস দালাল এডওয়ার্ড কলস্টনের ভাস্কর্য নামিয়ে ফেলল ব্যাপারটা অনেকটাই বোধগম্য ছিল। হতবুদ্ধিকর যদিও তাদের ‘বর্ণবাদী নির্মূল কর’ ষাট ভাস্কর্যের তালিকায় বিশ্বব্যাপী স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বেডেন-পাওয়েলের ব্রোঞ্জের প্রতিকৃতির অন্তর্ভুক্তি। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সক্রিয় কর্মীদের দাবি বেডেন-পাওয়েল, যিনি পরিচয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল রবার্ট স্টেফেন্সন স্মিথ, দ্বিতীয় বোয়ার যুদ্ধে (১৮৯৯-১৯০২) যখন মাফেকিং গ্যারিসনে সংরুদ্ধ ছিলেন, তখন ২ হাজার কালো আফ্রিকানের খাদ্য ও পানি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তাঁর জীবনীকার টিম জিল সুনিশ্চিতভাবে ‘বেডেন-পাওয়েল’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এটা চরম মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে তিনি লঙ্গরখানা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং অশ্বারোহী বাহিনীর সব ঘোড়াকে গুলি করে মেরে ফেলেন যাতে তিনি তাদের আহার জোগান দিতে পারেন।’ বেডেন-পাওয়েলের ‘কতকটা স্বেচ্ছায়’ ২১৭ দিনের অবরোধকাল পুরোটাই ভাবোচ্ছ্বাস। তিনি সামরিক অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিলেন, ছিলেন অবাধ্যতায় দোষী। যদিও তাঁকে আদেশ করা হয়েছিল বোয়ার রাষ্ট্র (ট্রান্সভাল ও অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট)-এর সীমানায় শুধু একটা অস্থাবর অশ্বারোহী বাহিনী বজায় রাখতে, বেডেন-পাওয়েল সেখানে ভা-ার সঞ্চিত করেন, সৈন্যঘাঁটি স্থাপন করেন। সংরুদ্ধকালীন অধিক সময়েই পলায়ন করতে বেডেন-পাওয়েলের অধীনে যথেষ্ট সৈন্যশক্তি ছিল, তার আরও কারণ বোয়ারদের কামানশক্তি ছিল দুর্বল, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে তিনি শহরটাতে সেই পর্যন্ত রয়ে গেলেন যখন তাঁর সৈন্যরা অনাহারে মৃতপ্রায়। ইতিহাসবেত্তা থমাস প্যাকেনহাম ‘দ্য বোয়ার ওয়ার’ (১৯৭৯) বইয়ে অভিমত দিয়েছিলেন যে, বেডেন-পাওয়েল স্থানীয় আফ্রিকার সৈন্য ও অসামরিক জনসমূহের রসদ ব্যাপকহারে হ্রাস করে তাদের বলিদান করেছিলেন। প্যাকেনহাম ‘দ্য সিজ অব মাফেকিং’ (২০০১) বইয়ে বেডেন-পাওয়েলের প্রতি তাঁর দোষারোপ প্রত্যাহার করেন। বেডেন-পাওয়েল ১৮৯৬ সালের মাতাবেল্যান্ড বিদ্রোহের যুদ্ধবন্দী আফ্রিকান উপজাতীয় প্রধান উইনির বিচার করেন এবং মৃত্যুদ- কার্যকর করেন। মাফেকিংয়ে বেডেন-পাওয়েল প্রত্যক্ষ করেন কীভাবে তাঁর স্টাফ অফিসার লর্ড এডওয়ার্ড সেসিল সাদা ছেলেদের (১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী) নিয়ে মাফেকিং ক্যাডেট কোর সংগঠিত করেন, যারা পাহারা দিয়েছে, বার্তা প্রেরণ করেছে, হাসপাতালে সহায়তা করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষরা যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে পেরেছে। কথাগুলো ডেভিড সি স্কট ‘দ্য সিজ অব মাফেকিং’ (১৯০৮) বইয়ে উল্লেখ করেছেন, যার সমর্থন পাওয়া যায় বেডেন-পাওয়েলের লেখা ‘স্কাউটিং ফর বয়েজ’ বইয়ে। ক্যাডেটদের কর্মকা-ে উজ্জীবিত হয়ে বেডেন-পাওয়েল ১৯০৭ সালের আগস্টে ডরসেটের পুল হারবারের ব্রাউনসি আইল্যান্ডে একটি পরীক্ষামূলক তাঁবুবাসের আয়োজন করেন যাতে যুক্তরাজ্যের ছেলেরা মাফেকিংয়ের ক্রিয়াকলাপ থেকে লাভবান হতে পারে। বয় স্কাউট আন্দোলনের জন্ম হলো। তিন বছর পর তাঁর অনুজ বোন অ্যাগ্নেস গার্ল গাইডস আন্দোলনের সূচনা করেন।

বেডেন-পাওয়েল, যাঁকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ সক্রিয় স্কাউট এবং গার্ল গাইড, এবং ২১৬টি দেশ ও অঞ্চলের লাখ লাখ ভক্ত স্নেহ করে বি-পি সম্বোধন করে, তিনি ১৯১০ সাল থেকে তাঁর সামরিক-পরবর্তী জীবন যুবকদের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নিবেদিত করেছিলেন। যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ বিষয়ে অল্পসংখক সাহসী সাবেক সৈন্যের সঙ্গে বেডেন-পাওয়েল ১৯০৮ সালের মতো অতীতকালেই স্বীকার করেন : ‘বিগত দিনগুলোয় অনেক ভুল করা হয়েছে। এখন প্রথম বিবেচনা হলো সর্বোৎকৃষ্ট কীভাবে আমরা মানুষকে সাহায্য করতে পারি তাদের গায়ের রং যা-ই হোক না কেন।’ মাফেকিংয়ে বর্ণবাদসংক্রান্ত অভিযোগের এক দশকের মধ্যে বি-পি ‘বিশ্বভ্রাতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা করেন, এ ঘোষণা দিয়ে যে, ‘স্কাউট সব বিশ্বের বন্ধু’। তাই কল্পনা করা কঠিন যে, বেডেন-পাওয়েল জঘন্য বর্ণবাদ দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করতেন।

BLM সক্রিয় কর্মীরা আরও দাবি করেন যে, বেডেন-পাওয়েল ‘নাৎসিদের বিষয়ে প্রবল আগ্রহান্বিত ছিলেন এবং অ্যাডলফ হিটলারের মাইন কাম্ফ (My Struggle, 1925) ও হিটলার যুব আন্দোলনের প্রশংসক ছিলেন।’, অনুমানটা সম্ভবত ১৯৩৭ সালের বি-পির পত্র থেকে যা তিনি লিখেছিলেন লন্ডনে হিটলার যুব আন্দোলন প্রধানের সঙ্গে আলাচনার পর। সৌহার্দ্যরে হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা হয়তো বেডেন-পাওয়েলের অকৃত্রিম সরলতা, কারণ ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর নিয়োজিত হওয়ার পর থেকে নাৎসিরা বিরোধী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতাদের বন্দীশিবিরে কারারুদ্ধ এবং আতঙ্কিত করে আসছিল। একই সময়ে হিটলার ইয়ুথ ঘোষণা করে যে, তারাই শুধু জার্মানির যুবদের প্রতিনিধিত্ব করে, যার ফলে নব্য দেশের তরুণ শত্রু হিসেবে ১৯৩৪ সালে স্কাউট আন্দোলনকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৪০ সালের নাৎসি পরিকল্পনা অনুযায়ী আরও ২ হাজার ৮০০ জনের সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হতো। সব ধর্ম, বর্ণ, দেশ, সমাজ এবং শ্রেণির তরুণ ও বয়স্করা ‘আরও সুন্দর পৃথিবী তৈরি’ করার লক্ষ্যে যুবদের সম্পৃক্ত করতে স্কাউটিংকে গ্রহণ করেছে। মনুষ্যের চরিত্র সন্নিবেশিত আছে স্কাউট প্রতিজ্ঞা ও আইনে যার বয়স এখন শতাব্দী যোগ এক ডজন বছর। আল্লাহ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে, সর্বদা অন্যকে সাহায্য করতে, স্কাউট আইন মেনে চলতে। বেডেন-পাওয়েল যে স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত করেছেন তা অনেক কাল ধরে সমগ্র বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে পড়া প্রচন্ড আবেগ।

লেখক : একাত্তর মুক্ত স্কাউট দলের সভাপতি, বেডেন-পাওয়েল ফেলো।

সর্বশেষ খবর