শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি যাদের

ডা. অভিষেক ভদ্র

করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি যাদের

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের মৃত্যু মিছিল এগিয়েই চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়, কয়েক মাস ধরে প্রতিদিনই গড়পড়তায় ৩০-৪০ জন করোনাভাইরাসে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুবরণ করছেন।  আট মাস ধরে বিশ্বব্যাপী তা-ব চালানো করোনাভাইরাসের অনেক কিছুই প্রাথমিকভাবে অজানা থাকলেও ধীরে ধীরে গবেষকরা নানা তথ্যের রহস্য উন্মোচন করছেন। প্রতিনিয়ত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, এ কথা যেমন সত্য, তেমন উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক মানুষ সুস্থও হয়ে উঠছে। তাই সাধারণের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- করোনা-ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তো সবাই মৃত্যুবরণ করছে না? স্বাস্থ্যকর্মীরা শুরু থেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মাঝে যাদের অন্য অসংক্রমক রোগ আছে, তাদের নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জনসাধারণের মনেও ঘুরে ফিরে কিছু প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি আসলে কাদের বেশি? কাদেরই বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বেশি সতর্ক থাকা উচিত?

দেশ-বিদেশের অসংখ্য গবেষক নানা গবেষণার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তেমনি সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞানের শিক্ষক রোগতত্ত্ববিদ জুয়েল রানা ও নুরুজ্জামান খানের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের একদল গবেষক সারা বিশ্বে পরিচালিত এ রকম উল্লেখযোগ্য ৪১টি গবেষণাপত্র পুনরায় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের (মেটা-অ্যানালাইস) মাধ্যমে এ প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। দিন কয়েক আগে যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব গ্লোবাল হেলথ কর্তৃক প্রকাশিত বিখ্যাত ‘জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ’-এ এ-সংক্রান্ত একটি বিশ্লেষণাত্মক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, করোনা আক্রান্তের মধ্যে যাদের আগে থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল তার বেশিসংখ্যক মৃত্যুবরণ করেছেন। সারা বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগীর মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত, তাদের মৃত্যুঝুঁকি শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বিদ্যমান কিছু রোগ বা কো-মরবিডিটি যেমন উচ্চ রক্তচাপ (৩৬.৫%), হৃদরোগ (১১.৯%) ও ডায়াবেটিস (২২.০%)-এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। শুধু বহির্বিশ্ব নয়, এ ফল বাংলাদেশি উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত বা এসব রোগের উচ্চঝুঁকিতে থাকা রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে। আইসিডিডিআরবি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রায় ২০ শতাংশ পুরুষ ও ৩২ শতাংশ মহিলা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৮ সালের তথ্যমতে ৪০-৫৯ বয়সী ১৫.৫ শতাংশ বাংলাদেশির হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। সুতরাং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগীদের করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে খুব বেশি সতর্ক হওয়া উচিত এবং এ ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশি গবেষকদের এ বিশ্লেষণ আরও নিশ্চিত করে যে, সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা টিউমার ও শ্বসনতন্ত্র-সংক্রান্ত রোগে আক্রান্তরা করোনায় আক্রান্ত হলে শুধু করোনা আক্রান্তদের চেয়ে পূর্ববর্তী এসব রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিস ও ১.৫ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া যারা আগে থেকে স্ট্রোক বা অন্যান্য সেরিব্রোভাসকুলার অথবা কিডনি রোগে ভুগছেন, তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যুঝুঁকি শুধু করোনা রোগীর চেয়ে তিন-চার গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে ১৭-১৮ শতাংশ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। লিভার-সংক্রান্ত রোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকিও শুধু করোনায় আক্রান্তের তুলনায় প্রায় ২৫০ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। দুঃখজনক তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ও সি রোগে আক্রান্ত এবং প্রায় ৪ কোটি মানুষ ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত; যা আমাদের অধিক সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়।

জুয়েল রানা, নুরুজ্জামান খান, মোস্তাউরদ খানসহ এই বাংলাদেশি গবেষক দলটির পরামর্শ হলো, যেহেতু বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা টিউমার, শ্বাসতন্ত্র, কিডনি ও লিভার-জনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক এবং এদের করোনায় উচ্চ মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে, সেহেতু তাদের এ ব্যাপারে আগেই সতর্ক হতে হবে। কারণ করোনা আক্রান্ত হলে এদের শারীরিক জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে উন্নত  দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। উপরন্তু, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের  চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল। তাই করোনা সংক্রমণের আগেই যদি সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় অথবা হাসপাতালে ভর্তির সময় শুরুতেই তাদের যদি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়; তাহলে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যথাযথ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী রোগে আক্রান্ত করোনা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সর্বোপরি, এ গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ডাক্তার ও অন্য ব্যক্তিবর্গকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ করোনা রোগীদের চিহ্নিতকরণ ও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ভীষণভাবে সাহায্য করবে বলে গবেষক দলের বিশ্বাস।

লেখক : শিক্ষক, পপুলার মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর