শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আর কি দেখা হবে প্রণবদার সঙ্গে!

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

আর কি দেখা হবে প্রণবদার সঙ্গে!

করোনায় দারুণ বিপর্যয়ের মাঝে ১০ মহররম পবিত্র আশুরা পালিত হলো। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইনকে কারবালায় হত্যা মুসলিম জাহানের জন্য এক বেদনাবিধুর দিন। অত্যাচারী ক্ষমতালোভী শাসকরা যে কত নির্মম হতে পারে তা কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা বিশ্বের মানব-সভ্যতার জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে রয়েছে। মহররমের দিনটি আমার খুব একটা ভালো কাটেনি। এমনিই আশুরার বিয়োগব্যথা, অন্যদিকে শখ করে কয়েকটি গরু পালতাম। বন্যায় চারদিক ভেসে যাওয়ায় ঘাস নেই, খড় নেই। গরু-বাছুরগুলোর ভালো খাবার নেই, যারা গরু-বাছুরগুলো দেখে তারা বলেনি। খড় ফুরিয়েছে বেশ কিছুদিন তা জানতাম। কিন্তু কয়েকদিন ধরে অন্য খাবারেরও অভাব তা জানা ছিল না। শোনার পর মনটা বড় কাতর হয়ে গেছে। আমি খাই, আমার ছেলেমেয়েরা খায়, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই কমবেশি খায়। কারও কোনো কষ্ট হয় না। পরম দয়ালু আল্লাহ আমাকে কয়েকটি গরু পালতে দিয়েছেন শেষ বয়সে। সেগুলোর কদিন থেকে খাবার নেই কিছুই জানি না- এই গুনাহ থেকে কী করে মুক্তি পাব। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, ভাতের থালায় চোখের পানি পড়লে দুঃখ বাড়ে, গুনাহ হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভাতের থালায় চোখের পানি পড়েছিল। সে গুনাহই যে এখনো শেষ হয়নি আবার নতুন গুনাহ। বোবা জানোয়ার মুখ ফুটে বলতে পারে না তাদের খাবার নেই। আল্লাহ কি মাফ করবেন। আসলে আল্লাহতায়ালা মানব-জাতিকে যে স্বল্প আয়ু দিয়েছেন তা যে কত যৌক্তিক হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। মানুষের কাজে, জীবজন্তুর কাজে, প্রকৃতি ও পরিবেশের কাজে লাগতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ কী! দেশ এক মহাসংকটের মধ্যে। সরকার হয়তো চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছে না। করোনা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যে ভানুমতির খেল দেখালেন তা অভাবনীয়! এমন নিন্দনীয় কাজ কেউ করতে পারে যা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। কত ডাক্তার-নার্স রাতদিন প্রাণপণে সেবা করে যাচ্ছেন অথচ চিকিৎসার নামে স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা যা করেছে বা করছে তার কোনো নজির নেই। অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ, প্রাণ গোপাল দত্তদের কথা শুনে যে ভরসা পাই অন্য অনেকের কথা শুনে তেমনটা পাওয়া যায় না। করোনার চিকিৎসা নিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি, করোনা নিয়ে জাল সার্টিফিকেট, করোনা পরীক্ষার নামে ভুয়া কারবার মানুষ কতটা সহ্য করবে। সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। এখন এই মহররমের মাসে আল্লাহ যদি দয়া করেন তবেই ভরসা।

সারা জীবন কাজ করার চেষ্টা করেছি। জীবনের সার্থকতা-ব্যর্থতা খুঁজিনি। সারা জীবন একটাই ভরসা ছিল জন্ম নিয়েছি ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর পথে কাজ করব। বোধশক্তি হওয়ার পর পাকিস্তানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলাম। বাঙালির অধিকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সেটাই আল্লাহর নির্দেশ জীবনের কর্তব্য বলে মনে হতো। ছেলেবেলায় বড় বেশি লাজুক ও নির্বোধ ছিলাম। বড় ভাইয়ের কাছে পড়তে বসে নিয়মিত মার খেতাম। শিক্ষা কতটা কী হতো বুঝতাম না। তবে মনের দিক থেকে যা অন্যায় মনে হতো তা কখনো মুখ বুজে সহ্য করতাম না। ’৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলাম। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন তখন টাঙ্গাইলের আলোচিত নেতা। ফজলুল করিম মিঠু, আল মুজাহিদী, ফজলুর রহমান খান ফারুক এরাই ছিলেন টাঙ্গাইলের ছাত্র নেতৃত্বের পুরোধাপুরুষ। শাজাহান সিরাজ তখনো গ্রাম থেকে আসেননি। ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের পর তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। এর আগেই আমাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বেশ কয়েকজনকে দেখেছিলাম। তাঁরা বাসাইল উপনির্বাচনের প্রচারে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। এরপর লেখাপড়া যা করেছি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছি তার চেয়ে বেশি। এর মধ্যে আবার ’৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগ দিয়ে সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম। সাধারণ সৈনিক হিসেবে সেখানে তিন বছর কাটিয়েছি। সেনাবাহিনীতে গিয়ে বুঝেছি, সেখানে ভর্তি হওয়া সোজা বেরিয়ে আসা কঠিন। ’৬৫-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যোগদান করে ’৬৭-এর অক্টোবর-নভেম্বরে ৬ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তারপর করটিয়া কলেজে ভর্তি, নিরন্তর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে বন্দী। আমি করটিয়া কলেজে, ছোটবোন রহিমা টাঙ্গাইল কুমুদিনীতে। রহিমার লেখা তখন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হতো। পারিবারিকভাবে আমাদের কাছে যেমন ব্যাপারটা ছিল গৌরবের, তেমনি ভারতীয় পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়ায় পাকিস্তানের কাছে ব্যাপারটা ছিল দেশদ্রোহের শামিল। বাবা, বড় ভাই জেলে থাকায় কখনো সংসারে দারুণ বিপর্যয় হতো, আবার বাবা বাইরে এলে কোর্টে গেলে সংসারে দারুণ স্বাচ্ছন্দ্য। ছেলেবেলায় মাঝেমধ্যে আমরা কি কষ্টই না করেছি। শত বিঘার ওপর ফসলি জমি থাকার পরও আমরা মাঝেমধ্যে ভালোভাবে খেতে পারিনি, স্কুলের বেতন দিতে পারিনি। আবার যেই বাবা জেল থেকে বেরিয়ে আসতেন অমনি পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যের সীমা থাকত না। তাই দুঃখ-কষ্ট আমাদের তেমন ভেঙে ফেলতে পারেনি। কষ্টের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল পাকিস্তান হানাদাররা। এখন এসব দেশ, দেশের নেতারা, সরকার কেউ ভাবে না। মুক্তিযুদ্ধে বাবা-মা-ভাই-বোনেরা সে যে কি অমানবিক কষ্ট করেছেন আমার ক্ষমতা নেই তা লেখার মধ্যে তুলে ধরার। এখন তো দেখি সবাই স্বাধীনতার জন্য জান-কোরবান করেছে। কতজনের কত ত্যাগ, আমাদের ত্যাগ সেখানে দুরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে নানা জনের নানা ষড়যন্ত্রের পরও বঙ্গবন্ধু অপরিসীম আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে তার সময়টা মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিলাম। খুব একটা টানাপোড়েন ছিল না। বাড়িঘর পুড়ে ফেলার জন্য বাবা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতেন, বকাঝকা করতেন এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখায় দেশের মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা পেয়েছিলাম। সম্ভ্রান্ত গুণীজনরা প্রায় সবাই আমাকে তাদের নিজেদের আত্মীয়স্বজন মনে করতেন। সামর্থ্যবান লোকজন তাদের সন্তান-সন্ততিকে যেভাবে লেখাপড়া করাত অন্য খরচ বহন করত কেন যেন বহু মানুষ আমাকে তাদের সন্তানজ্ঞানে আগলে রাখতেন। কেউ হয়তো ধান বিক্রি করেছেন ঢাকায় গিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়ে এলেন। কারও খেতে ভালো পাট হয়েছে, দাম ভালো না পেলেও কিছু টাকা তাদের কাদেরের জন্য রাখতেন। পাহাড়ের মানুষ কাঁঠাল বেচেছে সেখান থেকে টাকা দিতে হবে। শত চেষ্টা করেও তাদের ফেরানো যেত না। পুকুরের মাছ, গাছের আম-কাঁঠাল-লিচু-বরই-আনারস যখন যেটা হয় সেটা নিয়েই ছুটত ঢাকার বাড়িতে। মনে হতো তাদের এক সন্তান যেন ঢাকায় রয়েছে। কোনো কোনো সময় লোকজনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যেত। বেশি আনন্দ হলে চোখে পানি আসে, আমারও তেমনটা হতো। এমনি করেই কাটছিল দিন। মাঝেমধ্যে লেখাপড়ার চেষ্টা করতাম ছেলেবেলায় যা একেবারেই করিনি। বড় হয়ে দিনরাত মানুষের চাপে বই-পুস্তক থেকে তেমন জ্ঞান নিতে পারতাম না। তখন পর্যন্ত যে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম তার সবই আকাশ-বাতাস সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া।

হঠাৎ এলো ভয়াবহ কালরাত ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বিদ্যুৎ চমকের মতো সবকিছু এক ফুৎকারে ওলট-পালট হয়ে গেল। সেই ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা’র মতোন। এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলাম। ১৬ বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছি। সত্যিকার অর্থে সেই গৃহত্যাগ আজও গৃহে ফেরা হয়েছে কিনা বলতে পারি না। ভারতে নির্বাসিত জীবনে কষ্ট যেমন ছিল, তেমনই কখনোসখনো অভাবনীয় সম্মান গভীর ভালোবাসা পেয়েছি। জীবনে প্রথম কলকাতা গিয়েছিলাম ’৭২ সালের এপ্রিলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাকে নিয়ে যে অত মাতামাতি তার কিছুই জানতাম না। সে যাত্রায় কলকাতা আমাকে দারুণ সম্মান দিয়েছিল। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখার্জি, সোমেন মিত্র, অজিত পাঁজা, জ্যোতি বসু অনেককেই দেখেছিলাম সে সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আকাশবাণীতে কথিকা পাঠ করে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির যিনি হৃদয় স্পর্শ করেছিলেন সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে  তখনই পেয়েছিলাম। যে সম্পর্ক আজীবন স্থায়ী হয়েছিল। তবে এ কথা বলতেই হবে, আমি পরম ভাগ্যবান ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীন বাংলাদেশে যেদিন এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সে সময় বঙ্গভবনে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আমার নাম জেনেছিলেন। পরে ১৮ ডিসেম্বর, ’৭১ পল্টনের জনসভায় চার দুষ্কৃতিকারীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া নিয়ে এক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়ায় লে. জেনারেল অরোরা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাকে নিয়ে কথা বলেছিলেন। এমনি নানা কারণে তিনি আমাকে জানতেন। তাই প্রথম সাক্ষাতেই তাঁর অপার ¯েœহ পেয়েছিলাম বলে মনে হয়েছিল। পরের বছর এপ্রিলে বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে ইন্দিরাজির কাছে দিল্লি গিয়েছিলাম। কত বড় দেশ, কত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী মনে হয়েছিল কত আপনজন। ২ লাখ টন খাদ্য চেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধু চিঠি দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভারত আমাদের সেই দুঃসময়ে খাদ্য বরাদ্দ করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার তৃতীয়বার দেখা বা সাক্ষাৎ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ১৩-১৪ দিন পর। রাত ২টায় আমাকে গোহাটি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পালামে নামার সঙ্গে সঙ্গে ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাড়িতে। তিনি আমার মাথায় ও কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি বেঁচে আছ আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমার এবং তোমার দেশের সম্মান রক্ষা করে যা করণীয় সব আমি করব।’ এর পরের ইতিহাস বড় কঠিন। আমরা প্রায় আড়াই বছর প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে গিয়ে ১০৪ জন যোদ্ধা শহীদ হন। যার মধ্যে প্রথম ছিল বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল খালেক খসরু। আহত হয়েছিল ১ হাজারের ওপরে। ’৭৭-এ কংগ্রেস পরাজিত ও জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জনতা পার্টি বিজয়ী হলে মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের কপালে আবার দুর্যোগ নেমে আসে।

জিয়াউর রহমান মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে চুক্তি করে ভারত থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার প্রতিরোধযোদ্ধাকে এনে নানা নির্যাতন ক্যাম্পে বন্দী করেন। ৪-৫ হাজার মেঘালয়, আসাম, আগরতলা ও অন্যান্য স্থানে পালিয়ে বেড়ায়। প্রথম অবস্থায় পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে প্রায় ৬০ জনকে হত্যা করে। উপায়ান্তর না দেখে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রধান নেতা নেতাজি সুভাষ বোসের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সমর গুহ এমপির সঙ্গে পাটনায় জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে ছুটে যাই। সব শুনে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে বারণ করেন এবং আমাকে সাহায্য করতে অনেক নেতাকে ব্যক্তিগত চিঠি দেন। জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রচেষ্টায় ঝড় মোটামুটি থেমে যায়। ’৭৭-এর অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাওয়াদুল করিমের হাতে ইন্দিরা গান্ধীকে আমি একটি ব্যক্তিগত পত্র দিই। পত্র খুলে ইন্দিরাজি দেখেন হাতের লেখা। তিনি জাওয়াদুল করিমকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি টাইগারের কতটা বিশ্বস্ত?’ তিনি বলেন, বিশ্বস্ত না হলে এমন একটা পত্র আমার হাত দিয়ে পাঠান! তখন ইন্দিরাজি বলেন, ‘বেশ! আমি তো বাংলা ছাপার লেখা পড়তে পারি, হাতের লেখা পারি না। তুমি পড় টাইগার কী লিখেছে।’ প্রবীণ সাংবাদিক জাওয়াদুল করিম আমার চিঠিটি পড়েন। ইন্দিরাজি তখনই প্রণব মুখার্জিকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে যা বলার বলে দেন। এরই কয়েক মাস পর প্রণব মুখার্জির এক পারিবারিক ডাক্তারের বাড়িতে ’৭৮ সালের প্রথম দিকে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। অনেকেই মনে করেন ’৭২ সাল থেকেই আমি দাদাকে চিনি এবং জানি। কথাটা মোটেই সত্য নয়। অন্য অনেক ভারতীয় নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকলেও প্রণবদার সঙ্গে ’৭৮-এর আগে কোনো পরিচয় ছিল না। ইন্দিরাজি জানতেন তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ সহজ নয়। তাই তিনি প্রণবদার মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম দেখার এক-দেড় মাস পর আমি জীবনে প্রথম ৭ নম্বর তালকাটরা রোডে যাই যেখানে তখন রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে প্রণবদা থাকতেন। এরপর কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় এলে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে ২ নম্বর জন্তরমন্তর রোডে কিছুদিন ছিলেন। প্রণবদার বাড়ির পাশেই তখন জনতা পার্টির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি থাকতেন, যিনি পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই অটল বিহারি বাজপেয়ির বৈঠকখানাতেই আমি আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকীর প্রথম চেহারা দেখেছিলাম মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের এক ছবিতে। যেখানে লেখা ছিল ‘আলাউদ্দিন সিদ্দিকী অব বেঙ্গল’। এরপর প্রণবদা ১৩ নম্বর তালকাটরা রোডে আসেন। সেখান থেকেই ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হয়ে রায় সিনহা পাহাড়ের রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে উঠেছিলেন। প্রণবদার সঙ্গে চার বছর আগে শেষ দেখা। তিনি আজ প্রায় দুই সপ্তাহ অচেতন পড়ে আছেন। তাঁর ছেলে সংসদ সদস্য অভিজিৎ, মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি মুন্নীকে ফোন করেও খবর নিতে পারিনি। কারণ তাদের পাইনি। জানি না আল্লাহর ইচ্ছা কী। তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হবে কিনা, না সেই দেখাই ছিল শেষ দেখা- সবই আল্লাহ জানেন। আগামীতে প্রণবদাকে নিয়ে লিখব। দুঃসময়ের কত কথা কত স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে মনের মধ্যে তোলপাড় করে। একটা মানুষ কত বড় এবং কত আপন হতে পারে তা প্রণবদাকে ছাড়া আমি খুব বেশি মানুষের মধ্যে পাইনি। আল্লাহ যদি তাঁর হায়াত রেখে থাকেন তাহলে তাঁকে সুস্থ করে দিন, আর কিছু চাই না।

লেখক : রাজনীতিক।www.ksjleague.com

* নিবন্ধটি প্রণব মুখার্জির মৃত্যুর আগে রচিত।

 

 

 

সর্বশেষ খবর